নিবন্ধ

কিশোর ক্লাসিকসের অনুবাদে সত্যজিৎ

সায়নদীপ গুপ্ত Nov 21, 2020 at 10:17 am নিবন্ধ

..........................................

হিরে মানিক জ্বলে : ষোড়শ পর্ব 

................................................ 


সাহিত্যের কুলীন সারিতে অনুবাদের জায়গা কখনোই সেভাবে আদৃত নয়। তার জন্য আলাদা পুরস্কার নেই, ধূপ-দীপ-সিঙারা সমেত আলোচনাসভা নেই, নিদেনপক্ষে একটা সংবর্ধনাও নেই। লিটল ম্যাগাজিনের কল্যাণে দু-চারটে বিশেষ সংখ্যা-টংখ্যা জোটে বটে, রাশভারী প্রবন্ধ বা খিটখিটে পুথিপত্তরের অনুবাদে পণ্ডিতি বাহবাও মিলে যায়। কিন্তু গদ্যের আঙিনায় তার জন্য মর্যাদার জলচৌকিখানা কেউ পাতে না। এই সিরিজের প্রাণপুরুষ, রায়মশাইয়ের কথাই ধরুন। ফেলুদা-শঙ্কু লেখার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সন্দেশের জন্য ইংরেজি গল্পের অনুবাদ করেছিলেন, সর্বসাকুল্যে পাঁচটি। অথচ তাঁর লেখা কিশোরসাহিত্যের অনন্য সব মৌলিক সৃষ্টির আড়ালে এমন রত্ন প্রায় চাপা পড়ে গেল। পাঠকের মনে জায়গা পেলেও স্বয়ং স্রষ্টাকে আর এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।  

ঠিক কী কী কারণে সত্যজিৎ রায়ের গদ্য-অনুবাদ এমন আকর্ষণীয়? পাঁচখানি গল্পের ক্ষুদ্র পুঁজির ওপর একবার ভাল করে চোখ বোলালেই তা মালুম হবে। ‘ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা’ এই তালিকায় প্রথম, ১৯৬৭ সালে বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে সন্দেশের জন্য কলম ধরেছেন সত্যজিৎ। কাহিনির সূত্রপাত ডাঃ হার্ডকাস্‌লের মৃত্যুর পরে তাঁর বাড়িতে পাওয়া খামবন্দি একটি লেখা থেকে। খামের উপর লেখা ছিল, “গত চৈত্র মাসে উত্তর-পশ্চিম ডার্বিশায়ারে...”। ব্যাস, এইখানেই পাঠককে টেনে রাখার ম্যাজিক শুরু। মূল গল্পের “spring of last year” সত্যজিতের কলমের খোঁচায় বাঙালির ক্যালেন্ডারের পাতায় নেমে এল! একজন দক্ষ অনুবাদক শুধু ভাষান্তরই করেন না, সেই সঙ্গে তাঁকে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ফারাকও মাথায় রাখতে হয়। তবেই সে অনুবাদের সার্থকতা। এই দক্ষতার স্বাক্ষর বিভিন্ন ভাবে লেখায় রেখেছেন সত্যজিৎ। প্রসঙ্গত এর পনেরো বছর পরে তাঁর অনূদিত দ্বিতীয় গল্পটির দিকে ফিরে তাকাই। ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’, প্রথমটির মতো এইটিরও লেখক আর্থার কোনান ডয়েল। গল্পের নায়ক এসেছেন তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের সুদৃশ্য ম্যানরে, সেখানে কাকার অসুস্থতার প্রসঙ্গে সেই ভাই, এভারার্ড কিং বলেন, “হুঁ... তাও ট্যাঙস ট্যাঙস করে চালিয়ে যাচ্ছে”। অনুবাদক সত্যজিতের যাবতীয় মুন্সিয়ানা ঐ ‘ট্যাঙস ট্যাঙস’ শব্দবন্ধে, যা একান্তভাবেই কথ্য বাংলাভাষার আবেদনে সম্পৃক্ত; ডয়েল সাহেবের ইংরাজি হিউমরের হাজার যোজন দূরে এর নিবাস! আপাতভাবে অচেনা নিসর্গ, শহুরে রাস্তাঘাট, সরাইখানা ও অভিজাত ব্রিটিশ অট্টালিকার বিবরণের মাঝে খাঁটি বাঙালিয়ানা উঁকি দিয়ে যায় এভাবেই। 

সত্যজিতের পাঁচটি অনুবাদের তিনটিই আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা গল্পের। এ থেকেই বোঝা যায় সত্যজিৎ হোমসের স্রষ্টার কাজের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। সত্যজিৎ-অনূদিত শেষ গল্পটিও কোনান ডয়েলের লেখা ‘The Jew’s Breastplate’-এর ভাষান্তর। মাঝের দুটি গল্প দুই প্রখ্যাত কল্পবিজ্ঞান কাহিনিকার, রে ব্র্যাডবেরি ও আর্থার সি ক্লার্কের রচনা থেকে অনূদিত। এই দুজনই তাঁর বন্ধুস্থানীয় এবং সম্ভবত সেই কারণেই এঁদের লেখার অনুবাদ করতে তাঁকে বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। সেটা অবশ্য পোড়াতে হয়েছিল সবকটি গল্প একত্রিত করে সংকলনভুক্ত করার সময়। বন্ধুদের সম্মতি চেয়ে লেখা চিঠি চলে যায় মূল প্রকাশকের ঘরে, তাঁরা বেঁকে বসায় সে বইয়ের আশা কার্যত ছেড়েই দেন সত্যজিৎ। আসলে প্রফেশনালিজম বস্তুটি বাংলা পুস্তকব্যবসায় এমনিতেই পথভোলা পথিক, তার উপর সামান্য এক মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু অনুবাদ নিয়ে যে এত নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়তে হতে পারে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। শেষটায় আনন্দ পাবলিশার্সের প্রকাশক প্রয়াত বাদল বসুর ঐকান্তিক চেষ্টায় সে বই দিনের আলোর মুখ দেখে। ১৯৮৫ সালের সন্দেশের পুজোসংখ্যা থেকে শীতকাল অবধি পরপর তিনবারেই শেষ তিনটি অনুবাদ লেখেন তিনি। বোঝাই যায়, এই কাজগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্দেশ পত্রিকার প্রতি আশু কর্তব্যসাধন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একটানা মৌলিক কাহিনি ভাবা ও লেখা সে সময় স্বাভাবিকভাবেই সম্ভবপর ছিল না, অথচ সেই ধকলের ছাপ এতটুকু আসেনি এই কাজগুলিতে। 

তুলনামূলক বিচারে অনুবাদ নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প। এক ভাষার পাঠককে ভিন্ন ভাষার আস্বাদনে মজিয়ে তোলা, তার সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপ থেকে তাকে বের করে এনে বৃহত্তর আঙিনায় হাজির করা, অথচ এক মুহূর্তের জন্যও তার মননকে পাঠগত কোনো বাধার সম্মুখীন হতে না দেওয়া – একজন দক্ষ অনুবাদক এই সবকিছুই করেন নিপুণভাবে, নিক্তিতে মেপে। সাহিত্যিক সত্যজিৎ তাঁর নিজের সৃষ্ট আইকনিক চরিত্রগুলির মাধ্যমেই কিশোর পাঠকদের নাড়ি বুঝে নিয়েছিলেন। অনুবাদ করার সময় আগাগোড়া সেই ছাঁচ মাথায় রেখে গেছেন। তাই ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’ পড়তে গিয়ে ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ বা ‘ঈশ্বরের ন’ লক্ষ কোটি নাম’ পড়ার সময় শঙ্কু ও সন্ডার্সের কথোপকথনের অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ব্যতিক্রম সম্ভবত রে ব্র্যাডবেরি রচিত ‘Mars Is Heaven’ (বঙ্গানুবাদে, ‘মঙ্গলই স্বর্গ’), যেখানে লেখার ক্ষেত্রে মূলানুগ হওয়ার তাগিদেই চিরাচরিত রে-ব্র্যান্ড লেখনীর ধাঁচ অনুপস্থিত। তার বদলে খুব সন্তর্পণে পারস্পরিক বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে দিয়ে কাটাকুটি খেলতে খেলতে গল্প এগিয়ে চলে; সত্যজিতের অভিঘাতধর্মী লেখার স্টাইলের থেকে যা অনেকটাই আলাদা। বলাই বাহুল্য, এই গল্প বলার আসরে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে তাঁর অলংকরণ দক্ষতা। ‘ব্রেজিলের কালো বাঘ’ গল্পে পেন অ্যান্ড ইঙ্ক পদ্ধতিতে রেখার ক্রিসক্রসে বাঘের ভয়াবহতা থেকে পরিস্থিতির অসহায়তা, সবটুকুই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অনায়াসে। আবার আর্থার ক্লার্কের গল্পের অনুবাদে শ্যাডো পেইন্টিং করে রাতের ছমছমে পরিবেশ গড়ে তুলেছেন। ‘ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা’ গল্পের প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর বিবরণে যে দানবীয় গঠন ও আতঙ্কের হদিস আছে, তা যথাযথ ভাবে বোঝাতে তিনি সাদাকালোর ব্যবহারে ছবি আঁকলেন প্রাণীটির পরিপ্রেক্ষিত থেকে। ডাঃ হার্ডকাস্‌লের মুখের ভাব ও তাকানোর ভঙ্গিমা দেখলেই প্রাণীটির বীভৎসতা ও উচ্চতা, দুইয়েরই আন্দাজ মেলে। প্রাণীটিকে সরাসরি দেখিয়ে পাঠকের কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়াও হল না, আবার মূল চরিত্রের বিস্ময় ও ভয় আমাদের মধ্যে চারিয়েও দেওয়া গেল। একেবারে অন্য স্বাদের কাজের নজির দেখা যায় সত্যজিৎ-কৃত মোল্লা নাসিরুদ্দিন কথাসমগ্রে। ইদ্রিস শাহ্‌ রচিত ‘The Pleasantries of The Incredible Mulla Nasruddin’ বইটি থেকে অনূদিত এই লেখাগুলির সঙ্গে সরল জ্যামিতিক নকশায় অলংকৃত মোল্লার হাজারো মজার ভঙ্গিমা এই সংকলনকে সামান্য অনুবাদ থেকে অসামান্য কথাশিল্পের নিদর্শনে রূপান্তরিত করেছে। প্রতিটি বইপ্রেমী বাঙালির শৈশব এই চরিত্রের সঙ্গে জুড়ে থাকলেও, আদতে ইনি যে তুর্কির সম্পদ সেকথা সত্যজিতের রেখচিত্রের মধ্যেই স্পষ্ট। নাসিরুদ্দিনের বেশভূষা থেকে পারিপার্শ্বিক, সবকিছুই চিত্রিত হয়েছে তার দেশগত পরিচয়ের বৈশিষ্ট্য সূক্ষ্ম মাত্রায় মিশিয়ে। 



সত্যজিৎ রায় নামক মহীরুহকে তাঁর সৃষ্টির এক ক্ষুদ্র পরিসরের আতসকাচে দেখার চেষ্টা করা নেহাতই শিশুসুলভ। তবু, পাঠক হিসেবে একথা ভাবলে অবাক হতে হয়, বরাবর কল্পবিজ্ঞানের গল্পে অশুভের পরাজয় দেখিয়ে আসা সত্যজিৎ অনুবাদের সময় বেছে নিচ্ছেন রে ব্র্যাডবেরি ও আর্থার সি ক্লার্কের এমন দুটি গল্প যার থিম আদ্যোপান্ত দুরতিক্রম্য অন্ধকারে ঢাকা। সন্দেশে নিয়মিত শিশু ও কিশোরপাঠ্য লেখা জোগান দেওয়ার তাগিদে কলম ধরতে হতো যে সত্যজিৎকে, তিনি হয়তো সচেতনভাবেই ডার্ক থিমের আধিপত্য থেকে কিছুটা দূরে রাখতে চেয়েছিলেন নিজের লেখাকে। কিন্তু তারপরেও তাঁর কলমে আমরা পেয়েছি ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ বা ‘প্রোফেসর হিজবিজ্‌বিজ্‌’-এর মতো গল্প, যা আপাতভাবে কিশোরপাঠ্য হয়েও ঘোরাফেরা করেছে মানবমনের অন্ধকার আনাচ-কানাচে। পাঠকের বয়েস যাই হোক না কেন, তার মনের বয়েসকে কখনোই খাটো করে দেখেননি সত্যজিৎ। আর সেজন্যই বোধহয় অনুবাদের জন্য ‘Mars Is Heaven’ বা ‘The Nine Billion Names of God’-এর মতো জটিল, বহুমাত্রিক, আতঙ্ক কিংবা অনিশ্চয়তায় ভরা প্লট বেছে নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি।  


ঋণস্বীকার – 

(১) রং তুলির সত্যজিৎ, দেবাশীষ দেব 

(২) পিওন থেকে প্রকাশক, বাদল বসু 


[প্রচ্ছদের ছবিগুলি ইন্টারনেট এবং সত্যজিৎ রায়ের সংশ্লিষ্ট বইগুলি থেকে নেওয়া হয়েছে] 

[কভার ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]


#সত্যজিৎ রায় #নিবন্ধ সিরিজ #Satyajit Ray #Series #Translation #ব্লু-জন গহ্বরের বিভীষিকা #ব্রেজিলের কালো বাঘ #আর্থার কোনান ডয়েল #Arthur Conan Doyle #মোল্লা নাসীরুদ্দীন #Ray Bradbury #Arthur C. Clarke #রহস্য #রোমাঞ্চ #থ্রিলার #Thriller #সায়নদীপ গুপ্ত #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

214990