লিটারে ৬০ পয়সা : দঃ ২৪ পরগণায় আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের প্ল্যান্ট যাদবপুরের অধ্যাপিকার
মানুষের জীবনধারণের আবশ্যিক এক উপাদান পানীয় জল। সারা পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আজও পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। কোথাও অপ্রতুলতা কোথাও বা পরিশুদ্ধ জলের অভাব - সমস্যা প্রধানত দ্বিমুখী। পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে পানীয় জলের সমস্যা বহুদিনের। স্বাধীনতার ৭৫-এ দাঁড়িয়ে পানীয় জল জনিত সমস্যা আজও এরাজ্যে প্রায়শই স্থান দখল করে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠার বা নিউজ চ্যানেলের ব্রেকিং আপডেটের, হয়ে ওঠে নির্বাচনী ইস্যু।
পশ্চিমবঙ্গের এক বৃহৎ অংশে বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান সমস্যা হল জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি। ভারত সরকারের তথ্যানুযায়ী, এ দেশে আজও লক্ষাধিক মানুষ আর্সেনিক যুক্ত জল ব্যবহার করেন।দীর্ঘদিন আর্সেনিক যুক্ত জল ব্যবহার ত্বকের রোগ এবং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। আর্সেনিক দূষণ কার্ডিওভাসকুলার রোগেরও কারণ হতে পারে এবং শিশুদের জ্ঞানের বিকাশকে সীমাবদ্ধ করে তাদের আইকিউ কমিয়ে দেয়।
Central Ground Water Board এর তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, আসাম, মণিপুর এই ছয়টি রাজ্যে আর্সেনিক যুক্ত জলের পরিমাণ সর্বোচ্চ। পশ্চিমবঙ্গের দুই ২৪ পরগণা ও মুর্শিদাবাদ জেলা দেশে পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এই সমস্যা থেকে নিস্তার পেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল অধ্যাপক ড. অশোক গাডগিল এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের Global Change Programme –এর পুরোভাগে থাকা অধ্যাপিকা জয়শ্রী রায়ের নেতৃত্বে ২০১৬ সাল থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ধপধপি গ্রামের একটি সরকারি স্কুলে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের (ECAR) একটি প্ল্যান্ট পরিচালনা করে চলেছেন। এই ECAR (Electrochemical Arsenic Remediation) সিস্টেম পানীয় জল থেকে আর্সেনিক দূরীকরণে অত্যন্ত কার্যকরী পাশাপাশি স্বল্পব্যয়ীও।
এই ECAR পদ্ধতিরই মূল লক্ষ্যই হল গ্রামীণ এলাকায় অল্প খরচে আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা। এই পদ্ধতিতে সাধারণ ইস্পাত প্লেট লো-ভোল্টেজ বিদ্যুতের সাহায্যে জলে আয়রন-অক্সাইড তৈরি করে যা জলে থাকা আর্সেনিক-কে শোষণ করে নেয়। এই প্রক্রিয়ায় আর্সেনাইট (যা অত্যন্ত বিষাক্ত ও পৃথক করা কঠিন), সেটিকে আর্সেনেট-এ রূপান্তরিত করা হয়। প্রক্রিয়া শেষে প্রাপ্ত জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত সীমার (প্রতি ১ লিটার জলে ১০ মাইক্রোগ্রাম) চেয়েও কম হয়। এই প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ মডেলটির খরচ এবং আনুষাঙ্গিক বিদ্যুৎ ও অন্য খরচ সামলেও আর্সেনিক-মুক্ত জল অত্যন্ত কম খরচে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। স্বল্প অর্থের বিনিময়ে ধপধপি-তে আর্সেনিক মুক্ত জলের ব্যবস্থা করেছেন গবেষকদের দল। এই ECAR পদ্ধতির মাধ্যমে এলাকার অধিবাসীরা দশ লিটার আর্সেনিক-মুক্ত জল পাচ্ছেন মাত্র ছ-টাকায়, অর্থাৎ ৬০ পয়সা প্রতি লিটার। এটি নামীদামী কোম্পানির পিউরিফায়ারের তুলনায় যেমন অনেক কম ব্যয়বহুল পাশাপাশি অনেক বেশি বিশুদ্ধ। বর্তমানে অনেক দূরবর্তী স্থান থেকেও মানুষ ধপধপি-তে আসছেন স্বল্প খরচে আর্সেনিক-মুক্ত জল সংগ্রহে।
আরও পড়ুন : কৃষি আর পর্যটনকে মেলাচ্ছেন পাণ্ডুরং তাওয়ারে : উপকৃত অসংখ্য কৃষক / টিম সিলি পয়েন্ট
এই প্রজেক্টটির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করেছে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Lawrence Berkeley National Laboratory, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের UGC, Indian Council of Social Science Research (ICCSR), USAID-এর Higher Education Solutions Network এবং ভারত-মার্কিন Science and Technology Forum। পঞ্চায়েত, জেলা-স্তরের পাশাপাশি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারী স্তরের সাহায্যে দুই বছর সময়ে এই প্রজেক্টটি গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন : ৬০০ একর বনভূমি সংরক্ষণ : দামোদর কাশ্যপের লড়াই ঠাঁই পেয়েছে পাঠ্যবইয়েও / টিম সিলি পয়েন্ট
এই ECAR পদ্ধতির পরিচালন ব্যয় অত্যন্ত কম (০.০৪ মার্কিন ডলার) এবং সিস্টেমটির পরিচালনা করাও বেশ সহজ। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণও কম (৩ ভোল্ট DC) এবং সহজেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অধিবাসীদের মাধ্যমে এর পরিচালনা করা সম্ভব। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই ECAR পদ্ধতি ও ধপধপি-তে এর সফল প্রয়োগ ভবিষ্যতে দেশের অন্যত্রও পানীয় জল দূষণের বিরুদ্ধে মুক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
..........................
[কভার ছবি : অধ্যাপিকা জয়শ্রী রায় ও প্রজেক্ট দলের সদস্য শ্রীমান মাইপতি ECAR প্ল্যান্টের জল পান করছেন ]
# Arsenic Water #Jayasree Roy #পানীয় জল #আর্সেনিক দূষণ #ধপধপি #দঃ ২৪ পরগণা #Water Treatment Plant #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal