ব্যক্তিত্ব

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘প্লে-বয়’ : বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে গল্প লিখেছিলেন সমারসেট মম

অলর্ক বড়াল July 7, 2022 at 7:35 pm ব্যক্তিত্ব

ইয়ান ফ্লেমিং‌-এর জেমস বন্ড চরিত্রটিকে নিয়ে আলোচনা করতে বসলে অবশ্যই তার ‘ওম্যানাইজ়ার’ দিকটির কথা বারেবারে উঠে আসে। বন্ডকে নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলিতে বারবার দেখা যায় তার মহিলা-সঙ্গের প্রসঙ্গ - সেই সঙ্গিনীদের সঙ্গে নিয়ে স্পাই জেমসের একের পর এক দুর্ধর্ষ কীর্তিকলাপ। খানিকটা এমনই জীবন ছিল বিংশ শতকে‌ এক ভারতীয়েরও। তফাৎ একটাই। বন্ড যেখানে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের স্পাই, এস্টাব্লিশমেন্টের একটা অংশ, সেই‌ ভারতীয় ভদ্রলোক ঠিক তাঁর বিপরীত মেরুর বাসিন্দা - ঔপনিবেশ-বিরোধী বিপ্লবী। তিনি সরোজিনী নাইডুর ছোটো ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। এমনই রোমাঞ্চকর তাঁর জীবনকথা যে, বিখ্যাত লেখক সমারসেট মম তাঁর জীবনের একটি ঘটনাকে অবলম্বন করে গল্প লিখেছিলেন।

বীরেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৮০ সালে হায়দ্রাবাদে। সতীর্থদের মাঝে ‘চট্ট’ ডাকনামে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। বীরেন্দ্রনাথের জীবন খুব একটা সহজ ছিল না। অর্থাভাব এবং ব্রিটিশ পুলিশ ও গোয়েন্দাদের থেকে পালিয়ে বেরানো ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ১৯০২-এ বাধ্য হয়ে তিনি ব্রিটেনে পাড়ি জমান। জীবনের অধিকাংশ সময়টাই নির্বাসনে কাটালেও বীরেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিলেন। ইংল্যান্ডে তাঁর উগ্র রাজনৈতিক কাজকর্মের কারণে ভারতে‌ তাঁর পরিবারকে যথেষ্ট হেনস্থা হতে হত। তাঁর চড়াই-উতরাইপূর্ণ জীবনকে আরও জটিল করে তুলেছিল তাঁর মহিলা-সঙ্গ। তাঁর চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য, বুদ্ধিমত্তা, জীবনযাপনের কথা জানা যায় তাঁর একাধিক মহিলা সঙ্গিনী, স্ত্রী ও সহকর্মীদের লেখাপত্র থেকে। 

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বেশ কয়েকবার অকৃতকার্য হবার পর বীরেন্দ্রনাথ আইন পড়তে ইংল্যান্ড যান। তখন থেকেই তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৩ সালে নটিং হিলে বীরেন্দ্রনাথ এক ইংরেজ নারীর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন চ্যাটারটন দম্পতি ছদ্মনামে। ১৯০৯ সালে এই সম্পর্কের অবসান ঘটলে তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। উত্তর লন্ডনে শ্যামাজি কৃষ্ণবর্মার ‘ইন্ডিয়া হাউজ’-এ নিয়মিত তাঁকে দেখা যেত। এখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাভারকরের। 

ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এর ওপর ক্রমাগত নজরদারি ও বন্ধু সাভারকরের ইংল্যান্ড থেকে নির্বাসনের কারণে তিনিও বাধ্য হন ইংল্যান্ড ত্যাগ করে প্যারিসে চলে আসতে। সেখানে তিনি মাদাম কামা-র বিপ্লবী দলের  সঙ্গে যুক্ত হন। এখানেই জনৈকা মিস রেনল্ডস-র সঙ্গে বীরেন্দ্রনাথের সম্পর্ক তৈরি হয়। মিস রেনল্ডস-র লন্ডনের বাসস্থানের ঠিকানাকে বীরেন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত ‘তলোয়ার’ পত্রিকার বন্টনের কাজে ব্যবহার করতেন। বিত্তশালী এই সঙ্গিনী বীরেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কার্যকলাপের আর্থিক ভিত্তি ছিলেন। পুরুষের ছদ্মবেশে রেনল্ডস প্রায়শই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্যারিসে দেখা করতে আসতেন। ১৯১২ সালে তারা বিবাহ করলেও, সন্তানপালন প্রসঙ্গে দ্বিমতের কারণে শীঘ্রই সেই সম্পর্কেও ছেদ পড়ে যায়। পরবর্তীতে বেশ কিছু সাময়িক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, জানা যায় যে, কলকাতার জনৈকা মিস রায়ের থেকে বিবাহের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি। 




বীরেন্দ্রনাথের জীবনীকার নীরদ বড়ুয়া লিখছেন যে, ‘চট্ট’ যে শুধুমাত্র ‘প্লেবয়’ ছিলেন তাই নয়, পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় দক্ষ ছিলেন, দর্শন ও এথনোগ্রাফি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল তাঁর। প্রায়শই এবিষয়ে বীরেন্দ্রনাথের গবেষণা প্রকাশিত হতো। বীরেন্দ্রনাথ তাঁর বোন মৃণালিনী ও তার প্রেমিক বালমুকুন্দ-র সহযোগিতায় আসবাবপত্রের মধ্যে লুকিয়ে ভারতে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতেন। প্যারিস ছেড়ে কিছুদিনের মধ্যেই বীরেন্দ্রনাথ পাড়ি দেন জার্মানির হাল শহরে। ফরাসি ও ইতালিয়ান অ্যানার্কিস্টদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলার পর ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ‘বার্লিন কমিটি’ গড়ে তোলেন এবং কাবুলের বিপ্লবীদের মাধ্যমে ওটোমান তুর্কির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। উদ্দেশ্য ছিল ভারতে অস্ত্র পাঠানো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে আন্তর্জাতিক সাহায্য পেতে তিনি বলশেভিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। 

বীরেন্দ্রনাথের এক লন্ডননিবাসী পরিচিতা মার্গারেট হাওসিনকে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গ্রেপ্তার করেন এবং ডোনাল্ড গুলিক নামের এক গুপ্তচরকে তাঁর কাছে পাঠান সাহায্যের অছিলায় গ্রেপ্তার কিংবা হত্যা করতে। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তাদের লক্ষ্যে ব্যর্থ হন। লেখক সমারসেট মম এসময় ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের কর্মী ছিলেন এবং তিনি তাঁর গল্প “Giulia Lazzari” গল্পে এই ব্যর্থ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে প্রেক্ষাপট করেছেন। এই গল্পের চন্দ্র লাল চরিত্রটি বীরেন্দ্রনাথকে ভিত্তি করেই নির্মিত। 

১৯২০ সালের শুরুর দিকে বীরেন্দ্রনাথের পরিচয় হয় একজন বামপন্থী নারীবাদী অ্যাগনেস স্মেডলি-র সঙ্গে, যিনি নিউ ইয়র্কে লালা লাজপত রাইয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। স্মেডলি বীরেন্দ্রনাথকে “the epitome of the secret revolutionary movement, and perhaps its most brilliant protagonist abroad” বলে মনে করতেন। স্মেডলির সহায়তায় বীরেন্দ্রনাথ ১৯২১-এ মস্কোতে কমিনটার্নের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলেন। দুজনের আট বছরের সম্পর্ক প্রচুর ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। অর্থাভাবে এই সম্পর্ক স্মেডলির জীবনকে দিশেহারা করে তুলেছিল, তিনি লিখছেন, “Viren thrived on company, but I began to wilt and sink under the complexity and poverty of our lives. Everybody understood and loved Viren; few understood me. To them I was a queer creature who grew ever more strange—as indeed I did.” ১৯২৮-এ তাদের সম্পর্কের অবসান ঘটে। 

১৯২০-র দশক জুড়ে বীরেন্দ্রনাথ ভারতে খবর প্রচারের লক্ষ্যে ‘The Indian News Service and Information Bureau’ গড়ে তোলেন। ১৯২৬-এ ব্রাসেলসে League Against Imperialism সংগঠন গড়ে তোলেন যার ১৯২৭ সালের বৈঠকে জওহরলাল নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করেন। কিন্তু কমিনটার্নের সঙ্গে সংযোগের কারণে নেহরু ও বীরেন্দ্রনাথের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ইতিমধ্যে জার্মানিতে নাৎসি পার্টি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠলে বীরেন্দ্রনাথ ১৯৩১ এর আগস্ট মাসে মস্কো চলে আসেন এবং পরবর্তীতে লেনিনগ্রাদে Institute of Anthropology and Ethnography (IAE)-তে গবেষণার কাজে নিযুক্ত হন। বীরেন্দ্রনাথ এখানে জার্মান স্ত্রী শার্লট ও তাঁর সন্তানের আগমনের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলেন। ১৯৩৩ এর শেষ দিকে বীরেন্দ্রনাথ তাঁর সহ-গবেষক লিডিয়া কারুনোভস্কায়াকে বিয়ে করেন। লিডিয়ার চোখে তিনি ছিলেন, “a profoundly social, caring, generous and hardworking person”. এরপর গবেষণা ও পার্টির কাজেই তিনি মনোনিবেশ করেন। 

আরও পড়ুন : সশস্ত্র বিপ্লবের ছক কষছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ, অভিযোগ উঠেছিল মার্কিনি মামলায় / তোড়ি সেন

১৯৩৭ এর ১৬ জুলাই রাতে স্তালিনের সিক্রেট পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। লিডিয়া বহু প্রচেষ্টা করেও বীরেন্দ্রনাথের কোনো খোঁজ পাননি। ১৯৫৮-এ লিডিয়াকে একটি ডেথ সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় যেখানে লিখিত ছিল যে ৬ এপ্রিল ১৯৪৩-এ বীরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে। রুশ ঐতিহাসিক মিথ্রোকিনের গবেষণায় KGB আর্কাইভ থেকে পাওয়া দলিল থেকে জানা যায় যে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ১৯৩৭-এর ২রা সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয়েছিল। 

বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের পাতায়-পাতায় বিদ্রোহের পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলেছে রোমান্টিকতাও। এই দুয়ের মিশেলে অসাধারণ বর্ণময় হয়ে উঠেছে তাঁর চরিত্রটি।  


........................... 

তথ্যসূত্র :

Barooah, Nirode Kumar. Chatto: The Life And Times Of An Anti-imperialist In Europe. Oxford University Press, Delhi: 2004.

Smedley, Agnes. Battle Hymn of China. Victor Gollancz Ltd., London: 1944.

চিত্রঋণ : 

Swiss Federal Archives 

The Modern Review. August 1928.


#Virendranath Chattopadhyaya #Indian revolutionary #Indian independence movement #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

44

Unique Visitors

219187