সশস্ত্র বিপ্লবের ছক কষছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ, অভিযোগ উঠেছিল মার্কিনি মামলায়
১৯১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। আমেরিকার সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনে বড় বড় করে ছাপা হল একটি শিরোনাম। শিরোনামটি ছিল, ‘টেগোর নেমড উইথ জাপানিজ অ্যাট প্লট ট্রায়াল’। জাপানিদের সঙ্গে মিলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের ছক কষছেন নাকি এই নোবেলজয়ী ভারতীয় কবি। ঋষিপ্রতিম মানুষটির নামে এমন কথা ছাপার অক্ষরে দেখে তো সে দেশের মানুষদেরও চক্ষু চড়কগাছ। কারও কারও মনে আবার সন্দেহের কাঁটাও খচখচ করে উঠল। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে যে কী, এই প্রশ্নটা ঘুরছিল সকলের মনেই। যে-সে মামলা নয়, এ যে একেবারে রাজদ্রোহের অভিযোগ! তাও নাকি আবার সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী গদর পার্টির সঙ্গে জড়িয়েছে বিশ্বকবির নাম!
আসলে এর পিছনে ছিল একটা বড় গল্প। যাকে বলা যায়, খ্যাতির বিড়ম্বনা। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, গদর পার্টি আদতে কী। আসলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন বেজে উঠেছে, সেই সময় ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবীরা। সেই দলে যোগ দিয়েছিলেন একাধিক প্রবাসী ভারতীয়। আর সেরকম কিছু মানুষের হাত ধরেই আমেরিকায় গড়ে ওঠে 'প্যাসিফিক কোস্ট হিন্দুস্তান অ্যাসোসিয়েশন'। পরে তাদের প্রকাশিত পত্রিকাটির নাম অনুসরণ করে দলটি 'গদর পার্টি' নামেই পরিচিত হয়ে যায়। এই গদর দলেরই এক বিপ্লবী, সুকুমার চট্টোপাধ্যায়, ১৯১৭ সালে ব্যাংককে গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশবিরোধী জার্মানি যে গদর দলকে সমর্থন এবং সাহায্য করছিল, তাঁর জবানবন্দি থেকে সে কথা প্রমাণিত হয়। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’, এই নীতিতেই এঁরা অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মেলাবার কথা ভেবেছিলেন। এমনকিজার্মানির আর্থিক সহযোগিতায় চিন থেকে জাহাজভর্তি অস্ত্র কিনে ভারতে বিপ্লবীদের তা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিল গদর দল। এদিকে মহাযুদ্ধে সরাসরি যোগ না দিলেও আমেরিকা ইংল্যান্ডের মিত্র দেশ। ফলে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আমেরিকায় বিচার শুরু হয় ধৃত বিপ্লবীদের।
এর কিছু আগেই গদর দলের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ সংঘাত বেধেছিল। কবি তখন দ্বিতীয়বার আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন। নোবেল জয়ের পর প্রথমবার আমেরিকায় এসে তিনি বিপুল সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারের আমেরিকা ভ্রমণে উগ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি অনেকেরই বিরক্তির কারণ হন। প্রবাসী বিপ্লবীরাও তাঁকে একরকম বিপ্লবের শত্রু বলেই মনে করছিলেন। সুতরাং 'খালসা দিওয়ান সোসাইটি' থেকে রবীন্দ্রনাথকে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে গেলে তাঁরা সরাসরি বাধা দেন, এমনকি আয়োজকদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন পর্যন্ত। এই ঘটনার পর এমন শিরোনাম দেখা গিয়েছিল, যে, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র থেকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিপ্লবীদের তাঁকে শত্রু বলে ভাবার কারণেই হোক বা যে কোনও কারণেই হোক, গদর মামলায় নাম জড়ানো হল তাঁর। দেখা গেল, মামলায় অভিযুক্ত এক বিপ্লবী চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী ১৯১৬ সালের একটি চিঠিতে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁদের। সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন একাধিক উচ্চপদস্থ জাপানি। আবার ১৯১৭ সালে গদর পার্টির বার্লিন কমিটিকে লেখা এক চিঠিতে সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে ১২০০০ ডলার দিয়েছেন বলে ঘোষণা করলেন চন্দ্রকান্ত।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটে মিডিয়াম হতেন উমা গুপ্ত / মৃণালিনী ঘোষাল
১৯১৭ সালের ২০ নভেম্বর থেকে পরের বছরের ২৪ এপ্রিল, মোট ১৫৫ দিন ধরে চলেছিল গদর মামলার বিচার। কিন্তু সেখানে না ডাকা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে, না তাঁর কাছে এই মামলার কোনও খবর এসে পৌঁছেছিল। তিনি যতদিনে এই মামলার খবর পান, ততদিনে রায় ঘোষণার পালাও শেষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে চিঠি লিখে এই বিষয়টি তাঁর নজরে আনেন রবীন্দ্রনাথ। অবশেষে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের তরফ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয় কবির কাছে। শেষমেশ মামলা-মোকদ্দমার ‘আঠেরো ঘা’ থেকে রেহাই পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আরও পড়ুন : শান্তিনিকেতনের পড়ুয়াদের জন্য ইংরেজি নাটক লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ / আহ্নিক বসু
..................