বইয়ের খবর

হরেক মাল দশ টাকা : স্মৃতির হোরক্রাক্স

রোহন রায় Dec 28, 2021 at 2:48 am বইয়ের খবর

বই : হরেক মাল দশ টাকা

লেখক : দেবায়ন চৌধুরী

প্রচ্ছদ : চঞ্চল গুঁই

প্রকাশক : পত্রলেখা 

প্রথম প্রকাশ : জুলাই, ২০২১

মুদ্রিত মূল্য : ১৫০ টাকা 

..................... 

অচেনা থেকে ‘লাইক’। ‘লাইক’ থেকে ‘লাভ’। তারপর আবার উল্টোপথে ‘লাভ’ থেকে ‘লাইক’ হয়ে অচেনা।

ডায়েরির পাতায় পোস্ট-লিটারেট মানুষের জীবনচক্র এঁকে দেখিয়েছিল এক বন্ধু। তলায় ক্যাপশন লিখে দিয়েছিল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত পংক্তিকে সামান্য পাল্টে - “হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাবার লোভে আমরা ক্রমশই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি”। দেবায়ন চৌধুরীর গদ্যসংকলন ‘হরেক মাল দশ টাকা’ পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল সেই বন্ধুর কথা। ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে এখন আর দেখা হয় না। আমরা দুজনে একত্রে আছি ফেসবুকের পাতায়। 

বইয়ের উৎসর্গ-তালিকা বেশ লম্বা – “ভাড়াবাড়ির বারান্দা, রান্নাঘরের ঝুল, পেনসিলের শিস, বল হারানোর দুপুর, মশারির আলো ছায়া, সাইকেলের বেল, অঙ্ক খাতার শেষ পৃষ্ঠা, অভিমানী বাবা, সর্বংসহা মা, ছেলেবেলার বন্ধুরা।” এ থেকেই মোটামুটি আন্দাজ করে নেওয়া যাবে বইয়ের বিষয়বস্তু। ‘হরেক মাল দশ টাকা’ হারিয়ে যাওয়ার গল্প, হারিয়ে ফেলার গল্প। ফেলে আসা কৈশোর, গিলে ফেলা কান্না, হরিণশিশুর মতো আঁচল টেনে ধরা অবুঝ হাবাগোবা আবেগ - এসব নিয়েই ছোট ছোট ব্যক্তিগত গদ্য। এই তীব্র গতির দুনিয়ায় যা কিছু বেমানান, সেই অলস, মন্থর, সেপিয়া টোনের জীবনবোধেরা জবুথবু হয়ে বসে আছে এই ছোট ক্রাউন সাইজের সাত ফর্মার মধ্যে। আশির শেষপাতে বা নব্বইয়ের একেবারে গোড়ার দিকে যারা জন্মেছে, বিশেষত ছোট শহর বা মফস্বলে বেড়ে উঠেছে যারা, এই গদ্যগুলো সেই প্রজন্মের আঁতের কথা। এখন যারা আঠাশ থেকে চল্লিশ, তাঁরা এ বই না ভালোবেসে পারবেন না। যে কোনও পৃষ্ঠার যে কোনও লাইন থেকে পড়তে শুরু করুন, এ বই আপনার কথাই বলবে। আপনার মনে পড়বে দুপুরের খামোখা খেয়াল, ক্লাস নাইনে পাওয়া লাল সাইকেল, একান্নবর্তী পরিবারে একসঙ্গে রোদে দেওয়া লেপ-কম্বল। মনে পড়বে মুকেশ খান্নার শক্তিমান, সরস্বতী পুজোর চাঁদা, কুমার শানুর গান, ঘুড়ির মাঞ্জা, মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেম। মনে পড়বে প্রথম সবকিছু। কখনও হুট করে কান্না পেয়ে যাবে, কখনও বা এক-একটা গদ্য শেষ করে আবিষ্কার করবেন, মুচকি মুচকি হাসছেন। লেখকের কলমে বড় মায়া। যত কর্পোরেট-হৃদয়ই হোন না কেন, এ মায়া আপনাকে পেড়ে ফেলবে। শুশ্রূষা দেবে। দেবেই। কারণ, না চাইতেও, বেড়ে ওঠার সময়টুকু সবার মধ্যেই কমবেশি বন্দী থেকে যায়।  নস্যির ডিবের মতো ছোট্ট এক কৌটোয় মনের কোনও এক গহীন কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা থাকে। ছোটবেলার কৌটো খুলে সেই কস্তুরির গন্ধ ফিরিয়ে দেবে এ বই। আমরা সকলেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে থাকি আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে। এ বই আমাদের স্মৃতির হোরক্রাক্সগুলোকে জড়ো করেছে যত্ন করে।  

আরও পড়ুন : প্রাচীন ভারতের চিত্রকলা : প্রকাশের আলোয় অহিভূষণ মালিকের দুষ্প্রাপ্য রচনা / বিবস্বান দত্ত 

বিদেশ বোস নামে ময়দানে এক ফুটবলার ছিলেন। উইথ-দ্য-বল গতির জন্য বেশ নামডাক ছিল। দোষের মধ্যে একটাই; বাবা-কাকাদের কাছে শুনেছি, বিদেশ বোস পায়ে বল পেলে নাকি মাথা নিচু করে এমন উর্ধশ্বাসে পাঁই পাঁই করে ছুটতেন যে প্রায়শই বেখেয়ালে লাইন পেরিয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতেন। আমাদের অবস্থা ঐ বিদেশবাবুর মতো। উপনিষদ বলেছে চরৈবেতি, আমরা তার মানে বুঝেছি খুড়োর কল সামনে ঝুলিয়ে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে স্প্রিন্ট টানা। এই বইকে সেদিক থেকে ‘উন্নয়নবিরোধী’ বললে ভুল হয় না। পকেটে এত স্মৃতির নুড়িপাথর নিয়ে মানুষের এগোতে দেরি হয়ে যায়। দেরি হবারই কথা। দেবায়ন বোধহয় সেই ধরনের মানুষ যাদের তেমন তাড়া নেই কোনওকিছুতেই। যারা এগোতে এগোতে বারবার পিছন ফিরে দ্যাখে, যেতে যেতে কুড়িয়ে নেয় টুকরো-টাকরা জীবন। তাই দেরি হয়ে যায়। তিনি তাঁর নতমুখ মফস্বলী কৈশোরের মতোই, চড়া আলোয় আসতে অকারণ অনির্দেশ্য এক লজ্জা যেন। সে কারণেই ব্যাক কভারের ব্লার্বে এখনকার রেওয়াজমাফিক নিজের ছবি দেন না। নিজের বিষয়ে তথ্য-টথ্যও দেন না তেমন। লেখেন – “পড়া ও পড়ানো বাদ দিলে মনখারাপ সম্বল”। 

অবশ্য মনখারাপ বিষয়টা যতটা জনপ্রিয়, ততটাই বিপজ্জনক। মনখারাপ নিয়ে লেখা মানে ট্রাপিজের সরু তারের ওপর দিয়ে হাঁটা। নস্টালজিয়া অপটু হাতে পড়লে ফেলে আসা জিনিসপত্রের দীর্ঘশ্বাসমাখা ফর্দের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে না। দেবায়ন কিন্তু বিপদসংকুল পথে হেঁটেও কামাল করেছেন। বছরকয়েক আগে প্রকাশিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’ মুগ্ধ করেছিল। দেবায়নও মুগ্ধ করলেন। দুজনের দেখার ধরন আলাদা। মনখারাপ করিয়ে দেবার ধরনও আলাদা। অনিন্দ্য মনখারাপ ধরিয়েও, কথার জাগলারি দিয়ে তাকে ফুরফুরে করে দেন। হৈ হৈ, স্মার্ট গদ্যে এগিয়ে যাবার কথা বলেন। সেখানে দেবায়ন, আগেই বলছিলাম, আঁকড়াতে চান বেশি। ‘দশ টাকা’। কারণ দেবায়ন জানেন, আর আমরাও কি জানি না, যে আজকের দুনিয়ায় এদের দাম নেই? প্রচারগাড়িরা অভিমান করে আসা ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের সব মাসই এখন ‘মল’মাস, তাই ফেরিওয়ালারা স্নো লেপার্ডের চেয়েও বিপন্ন প্রজাতি হয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। আমরা জানি সেসব। আমরা মেনে নিয়েছি। মানিয়েও নিয়েছি। তবু এ বই আমাদের ভিতরের ‘আরও চাই’-কে আক্রমণ করবে। আমাদের স্বচ্ছল, অভাবহীন, স্মার্ট বাস্তিল ভেঙে পড়বে বিনা প্রতিরোধে। এ বই পড়ার দীর্ঘক্ষণ পরেও, বারান্দায় হাঁটব ভাবলে নিশ্চিন্তে হাঁটা যাবে না, কারণ সেখানে বিছানো থাকবে স্মৃতির বুবিট্র্যাপ। রিওয়াইন্ড বাটন ছাড়া অন্য কোনও বাটন থাকবে না আমাদের সামনে, এবং তাতে চাপ দেওয়ামাত্র মেজো-সেজো-ছোটো নানা মাপের বিস্ফোরণে উড়ে যাবে পুরনো এক-একটা প্রদেশ। হয়তো এ বই পড়তে পড়তে অনেক মৃতদেহ আবিষ্কার হবে, যাদের মৃতদেহ বলে চেনা যায়নি, কারণ জম্বি হয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছিল তারা। হয়তো আবিষ্কার হবে, স্বাভাবিক জীবন বলতে আমরা যা বুঝি, বস্তুত অনেকের ক্ষেত্রেই তা ‘ওয়াকিং ডেড’ সিরিজের এক-একটা এপিসোড। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কান্না পাবে। লেখককে সেজন্য ভালোবাসা জানাই। 

আরও পড়ুন : অপরাজিতা : একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া / রোহন রায় 

গদ্যগুলোর মাঝে মাঝে কিছু অলংকরণ থাকলে বড্ড ভালো হত। জানি, এরকম প্রস্তাবে প্রকাশকেরা চট করে সায় দেন না। তাতে বইয়ের দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাইজও পাল্টাতে হবে। আপাতত না হলেও, আগামী কোনও সংস্করণে যদি সম্ভব হয়, লেখক ভেবে দেখবেন কি? 


******** 

#বই #বইয়ের খবর #হরেক মাল দশটাকা #দেবায়ন চৌধুরী #পত্রলেখা #রিভিউ #রোহন রায় #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #বাংলা পোর্টাল #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

31

Unique Visitors

182018