অপরাজিতা : একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া
...........................
বই : অপরাজিতা
কবি : শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
প্রকাশনা : ঋত প্রকাশন
প্রচ্ছদ : চিরঞ্জিৎ সামন্ত
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর, ২০১৯
.................................
গোটা বইটাই কারো ফেলে যাওয়া তোরঙ্গ যেন। চাবি অন্য কারো কাছে। চাবি নিয়ে চলে গেছে সে।
নাকি উল্টোটা? চাবিই রয়ে গেছে এখানে, তোরঙ্গ অন্য কোথাও?
আধুনিক বিদ্যাচর্চায় কোনও টেক্সটকে পাঠ করার সময় তাত্ত্বিকেরা এখন কেবলাত্মক রীতি অনুসরণের কথা বলেন। অর্থাৎ লেখক, পাঠক, দেশকাল থেকে বিচ্ছিন্ন করে টেক্সটকে তার নির্বিকল্প শুদ্ধ স্বরূপে দেখার প্রয়াস। কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির গুরুত্ব স্বীকার করে অশ্রুকুমার সিকদার লিখেছেন - “কবিতা সমালোচনা আমরা করতে পারি জীবনীমূলক, মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে, ঐতিহাসিক বা সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে। কিন্তু কবিতা পড়ার সময়, তার ঐকান্তিক উপভোগের মুহূর্তে, তাকে একটি 'artifact' হিসেবে বিবেচনা করাই ভালো। সেই তদ্গত উপভোগের মুহূর্তে কবিতাকে সাহিত্যের ও সমাজের ইতিহাস থেকে, লেখকের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি নির্মিতি হিসেবে বিবেচনা করাই সঙ্গত।” (কবিতা পড়া/ গদ্যসংগ্রহ ৪ / অশ্রুকুমার সিকদার)
কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটির পাঠ এই উত্তরগঠনবাদী পদ্ধতিতে সম্ভব না। কারণ নিছক একটা সময়পর্বে লিখে ফ্যালা কিছু কবিতার সংকলন নয় এই বই। স্মৃতিভারাতুর, অন্তঃক্ষরণশীল এই কবিতাদের প্রচণ্ড ব্যক্তিগত কোনও চালচিত্র রয়েছে। এরা তীব্রভাবে একমুখী। বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কোনও কবিতায় ড্রামাটিক মনোলগের চারিত্র্য খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এই বইয়ের কবিতারা সকলে মিলে আসলে একটি ডায়ালগ। বা একটি বড়সড় ডায়ালগের অংশ। কবি নিজেই ভূমিকায় সেই ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছেন। প্রাগাধুনিক যুগ হলে শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরীর ‘অপরাজিতা’ নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘ কাব্য হত।
‘ঘুম’ ও ‘জাগরণ’ - এই দুই ভাগে বিভক্ত বইটি। প্রথম ভাগে সাতাশটি এবং দ্বিতীয় ভাগে পঁচিশটি কবিতা। প্রথম ভাগের কবিতারা এক-একটি উদ্ধৃতিচিহ্নিত, আর দ্বিতীয় ভাগের কবিতারা, শেষটি বাদে, তারিখচিহ্নিত। ওই শেষটিই এ বইয়ের নামকবিতা। অর্থাৎ প্রবেশক নেই, প্রস্থানক রয়েছে। বইয়ের থিমের দিক থেকে এর একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। যথাসময়ে আসছি সে কথায়।
আরও পড়ুন : লাল পিঁপড়ের বাসা : রাণা রায়চৌধুরী / আহ্নিক বসু
প্রায় সমস্ত কবিতা অনির্দেশ্য এক 'তুমি'-কে ঠিকানা করে ধাবিত হলেও, এই কথোপকথন প্রিয় মানুষের সঙ্গে নয় বোধহয় - কারণ সেই মানুষটি যেখানে ছিলেন, সেখানে আজ আজ নেই অন্তত। প্রিয় মানুষের স্মৃতিকে শিখণ্ডী করে রেখে বোধ করি নিজের সঙ্গেই নিজে সংলাপে লিপ্ত হয়েছেন কবি।
ধরে নাও,
তোমার সঙ্গে বহুদূর যাওয়া গেল
আশা-নিরাশায়।
ট্রেনগামী মফসসল, মুছে দিয়ে কুয়াশার ঢল
বুঝে নেওয়া গেল -
দূরের কথারা শেষে যার যার কাছে থেকে যায়। (‘ফেরার কথা বোলো না কখনও’)
'অপরাজিতা' লিরিকপ্রধান একটা বই। গদ্যকবিতার ক্ষেত্রেও শ্রাব্যগুণ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কবিতাগুলো মুখ্যত স্মৃতিভারাতুর বলেই বোধহয় তাদের অডিও এফেক্ট আরও বেশি মূর্ত লাগে। অন্তত আমার লেগেছে। আর এই অডিও এফেক্টের পরেই এসে দাঁড়ায় হিরণ্ময় এক নীরবতা। যে কোনও সৎ কবিতার নিজস্ব একটা নীরবতার জায়গা থাকে। ব্যাপারটায় একটা বিরোধাভাস আছে। কারণ সেই নীরবতা আসলে একটা সংলাপের সূত্রপাত। কবিতা শেষ হয়ে গেলে সেই নীরবতা বিনবিন করতে শুরু করে। পাঠকের সঙ্গে কবিতার ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সেই নিভৃত মুহূর্তটুকুতে পোশাক ছাড়ে অনেক ‘বিটুইন দ্য লাইনস’। এই কবিতারা ভালোবাসায়, স্মৃতিভারে নত। অবশ্য নত মানে নুয়ে পড়া নয়। এদের কাঁধ ঝুঁকে যায়নি অপ্রাপণীয়তা বা হারানোয়। দীর্ঘশ্বাস কি নেই? আছে -
রাত্রির দ্যোতনা তুমি রেখে গেছ
দীর্ঘ কবিতায়।
সে কবিতা লেখা হয় না আর। (‘সত্যি বলো, চাওনি লেখা ছাড়তে?’)
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোও আছে। আর সেজন্যই দুই ভাগে বিন্যস্ত হয়েছে এই বইয়ের কবিতারা। ‘ঘুম’ অংশের চোরা সংক্ষোভ ‘জাগরণ’-এ নির্লিপ্তিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছে। সেই কারণেই এই বইয়ের বিদায়ী কবিতাই নামকবিতা। কবি তাঁর অবস্থানের একটা স্টেটমেন্ট দিতে চেয়েছেন যেন। নিজেকে খুঁড়ে যে আলো পাওয়া যায়, সেটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি আলো। নিজের অন্তর্গত গহিন রাত্রির বৃন্ত থেকে ছিনিয়ে আনা যে আলো, তার সহজে মৃত্যু নেই। এই কাব্যগ্রন্থে সেই আলোর আভাস আছে। এই আলোটুকু পাঠক হিসেবেও পরম পাওয়া। মানুষ চলে যায়। কিন্তু সে নিয়ে যেতে পারে না তার যৌথযাপনের মুহূর্তদের। মানুষ চলে গেলেও তাই মুহূর্তগুলো মিথ্যে হয় না। সেই মুহূর্তদের কাছে ঋণী কবি। ভূমিকাতে স্পষ্ট করেই লিখেছেন - “এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, সহজ, তা হারায় না, ফুরোয় না। আমাদের মনে তার নিশ্চিন্ত বসত। কোনও মানুষের ঔদ্ধত্য, কোনও অঘটন, কোনও দূরত্ব, বিভেদ তার মাথা নোয়াতে পারে না। সে বেঁচে থাকে অন্তরে, ফিরে আসবে বলে। অপরাজিতা হয়ে।” আর কবিতায় লিখেছেন -
মাঠসারি। ক্ষেত। শীত। মানুষের শুকনো শিকড়
ভালোবাসে, আর বলে, ভালোবেসে
নিঃস্ব হয়ে থাকো।
কিছু ছেড়ে যাওয়া রোজ তোমাকে সঞ্চয় শেখায়। (২৭ শে মে, ২০১৮)
অভিনব শব্দপ্রয়োগে এখানে কবি উদগ্র নন। শব্দের প্রয়োগ ও সংস্থাপনের ব্যাপারে মোটের ওপর ধ্রুপদীই বলা চলে তাঁকে। কোনও কোনও কবিতার ছন্দনির্মাণ ও শব্দযোজনা আমাকে শঙ্খ ঘোষের কথা মনে করিয়েছে। যদিও সামগ্রিকভাবে শুভংকরবাবু সম্ভবত শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে বেশি পছন্দ করেন। শক্তির কিছু চেনা অনুষঙ্গ দু-একটি কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেন সুন্দরভাবে। আছে অন্যান্য কবিদের অনুষঙ্গও। গঠনগতভাবে অন্যান্য কবিতাদের চেয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম ‘ঘুম’ অংশের ‘দেখা হবে’ কবিতাটি। অধিগঠনের দিক থেকে সম্ভবত এ বইয়ের সবচেয়ে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ কবিতা -
নীললোহিতের বরুণাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগত,
যখন সে হেঁটে যেত প্রবল বাতাসের বিরুদ্ধে।
কিন্তু এতটা বললে এ-ও বলতে হয়,
বাতাস এখন সহজলভ্য নয়,
বিরুদ্ধতার কথা তো বাদই দিলাম। (‘দেখা হবে’)
আর আছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি খুব প্রকটভাবে, একেবারে ইজিচেয়ার নিয়ে জাঁকিয়ে বসে আছেন 'অপরাজিতা'-র বারান্দায়। শুভংকরবাবুর অনুভবের জগতে রবীন্দ্রনাথের গভীর ছায়াপাত পাঠকের চোখে না পড়া অসম্ভব। হয়তো কঠিন সময়ের আশ্রয় হিসেবেই তাঁর অবলম্বন হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা।
একটি কবিতার বইয়ের ভূমিকা হিসেবে একটু অতিকথন বলেই মনে হয়েছে মুখবন্ধের কথাবার্তাকে। অনুমান করি, ঘটনার অভিঘাত কবিকে দিয়ে সেটা করিয়ে নিয়েছে। বইয়ের শেষতম কবিতায় তিনি যে বোঝাপড়ায় এসেছেন, তা-ও তো সম্পূর্ণত নিবাত নিষ্কম্প হওয়া সম্ভব নয়। কষ্টার্জিত এ প্রত্যয়ে ভূমিকম্প থাকবে। এক প্লেট উঠে যাবে আরেক প্লেটের ঘাড়ে। নামবেও। এবং আবারও উঠবে। 'মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক'। কবি জানেন। সে কারণেই হয়তো স্টেটমেন্ট দিতে গিয়েও বাচনে অনুজ্ঞার সুর লেগে গ্যাছে -
এই যে তুমি এককভাবে
ঘরের মতো বাঁধছো আমায় -
ভাবতে পারো, তোমার আড়াল
তোমায় আমার ঘর করেছে?
আর যা কিছু শিকল-তালা,
মিথ্যে করো, মিথ্যে করো। (অপরাজিতা)
.............................................
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #বই রিভিউ #অপরাজিতা # শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী #রোহন রায়