বইয়ের খবর

প্রাচীন ভারতের চিত্রকলা : প্রকাশের আলোয় অহিভূষণ মালিকের দুষ্প্রাপ্য রচনা

বিবস্বান দত্ত Aug 17, 2021 at 3:30 am বইয়ের খবর

************************************

বই : ছোটোদের প্রাচীন ভারতের চিত্রকলা 

লেখক : অহিভূষণ মালিক 

প্রচ্ছদ ও ভূমিকা : শুভাপ্রসন্ন 

প্রকাশক : পেজেস 

মূল্য : ২০০ টাকা 

********************************

আমাদের যাদের শৈশব কেটেছে নব্বইয়ের নয়াচরে, আমরা যারা শূন্য দশকের কিশোর, আমাদের কাছে একটা খুব পরিচিত শব্দবন্ধ হল, “বসে আঁকো প্রতিযোগিতা”। সে ছিল রং পেনসিলের ছোটোবেলা। ক্যামেলের মোমরং থেকে সোনাইয়ের তুলি। জলরঙে হাত মানে বড়ো হয়ে যাওয়া। খড়চালের বাড়ি, একটা গাছ আর সরু হয়ে দূরে মেশা রাস্তা। আমাদের নন্দনের সীমা এতটুকুই। নন্দনের ইতিহাস নিয়ে খুব আগ্রহ সেদিন ছিল না। ছবি আঁকার প্রচল যতই আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে যাক, সেই ছবির ইতিহাস দীর্ঘদিন ব্রাত্য থেকেছে শুষ্ক তাত্ত্বিকতায়। আর ঠিক এই জায়গাতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন অহিভূষণ মালিক। এই প্রখ্যাত ব্যঙ্গচিত্রী ও কলাসমালোচক মরমী যত্নে হাতে তুলে নিয়েছিলেন এক দুরূহ দায়িত্ব। ছোটোদের মধ্যে গড়ে দিতে চেয়েছিলেন শিল্পের চেতনা - শিল্পের ইতিহাস নিয়ে মমত্ব। ‘ছোটোদের প্রাচীন ভারতের চিত্রকলা’ সেই জরুরি চেষ্টার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। দুষ্প্রাপ্য এই পাণ্ডুলিপিটি উত্তরাধিকার সূত্রে উদ্ধার করে একটি সুবিন্যস্ত বই হিসেবে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন কলকাতার নবীন প্রকাশনা সংস্থা পেজেস।   

তেরোটি ছোটো ছোটো প্রবন্ধের সমাহারে সেজে উঠেছে এই বই। শিল্পের ইতিহাস ছুঁয়ে থেকে এ যেন কার্যত এক ভারত-পরিক্রমা। প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকলা থেকে শুরু করে, সাতবাহন, কুশান, গুপ্ত, বকাটক, চালুক্য হয়ে মুঘল আমল পর্যন্ত ভারতীয় শিল্পকলার এক ছোটো কিন্তু ঋদ্ধ পরিচয় আশ্চর্য সামগ্রিকতায় ধরা দিয়েছে এই বইয়ে। এমনকি পাল চিত্রকলা, মধ্যযুগীয় পশ্চিম ভারত, রাজস্থানি-পাহাড়ি শিল্পও বাদ পড়েনি এই যাত্রায়। 

তবে তথ্য এইখানে গল্পের অনায়াস চলনকে ব্যহত করে না। ইতিহাস নিজের অর্জিত গাম্ভীর্যকে সরিয়ে রেখে যেন বসিয়ে দেয় গল্পদাদুর আসর। গল্পের ছলেই জেনে নেওয়া যায়, অজন্তার গুহায় কেমনভাবে আঁকা হয়েছিল ছবি! সেই রং-ই বা তৈরি হয়েছিল কেমন করে, কালের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যা এখনও রয়েছে! জানা যাবে মহামূল্য বাঘশিল্পের কথা। অবনীন্দ্রনাথের দুই ছাত্র না থাকলে যে শিল্পের সম্পর্কে জানতেই পারত না ভবিষ্যতের মানুষ। নন্দলাল বসু আর অসিত হালদার বাঘ-গুহার ছবি নকল করে রেখেছিলেন বলেই তো গুপ্তযুগের চিত্রকলার রীতি আর বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে পারছি আমরা। 

অহিভূষণ জানাচ্ছেন, প্রাচীন ভারতে যে কেবল আর্ট গ্যালারি ছিল তাই নয়, ছিল চলমান আর্ট গ্যালারিও। নারদ শিল্পীগ্রন্থে নাকি রয়েছে সেই আর্ট গ্যালারির স্থাপত্যবিধি। চারমাথার মোড়ে, মন্দির কিংবা রাজপ্রাসাদের বিপরীতে, অথবা কোনও চওড়া রাস্তার মাঝখানে তৈরি হত সেই আর্ট গ্যালারি। আর্ট গ্যালারি নাকি বৃত্তাকার হওয়াই ভালো। সেই গ্যালারির ভেতরে আলোর প্রখরতা বাড়াবার এবং কমাবার ব্যবস্থাও থাকত।

বকাটক চিত্রীরা নাকি থ্রি–ডাইমেনশনের ছবি আঁকতে জানতেন। কেরল আর্ট থেকে শুরু করে মুঘল শিল্প, অহিভূষণ তাঁর আলোচনায় বাদ দেননি কিছুই। এ যেন বিন্দুতে সিন্ধু দেখার এক যথাযথ উদাহরণ। গ্রিসের সেই প্রাচীন প্রবাদ মনে পড়ে যায় - “যত বড়ো বই, তত বড়ো জঞ্জাল। মেগা বিবলিয়ন মেগা কাকোন”। এই বই তার সীমিত আয়তনেই ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কে এক সামগ্রিক ধারণা এনে দেয়। 

শুভাপ্রসন্নের প্রচ্ছদ এবং ভূমিকা এই বইয়ের গুরুত্ব বাড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে মুদ্রণপ্রমাদ কমানোর দিকে আরেকটু নজর দিলে ভালো হত। আশা করা যায় পরবর্তী সংস্করণে এই ঐতিহাসিক বই আরও নিখুঁত হয়ে উঠবে। 

........................... 


#অহিভূষণ মালিক #বিবস্বান দত্ত #চিত্রকলা #শুভাপ্রসন্ন #ভারতীয় চিত্রকলা #ছবি #ইতিহাস #মুঘল শিল্প #গুপ্তযুগ #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

31

Unique Visitors

215000