সুভাষিত খাদ্যাভ্যাস
.......................................................
[রসিয়ে কষিয়ে : ষোড়শ পর্ব]
.................................................
মহেন্দ্রনাথ দত্ত একবার কথা প্রসঙ্গে স্বামী সারদানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তুমি এতো চা খেতে শিখলে কোথা থেকে?” স্বামী সারদানন্দের উত্তর, “তোমার ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে। তোমাদের বাড়িতে যে চায়ের রেওয়াজ ছিল সেইটা বরাহনগর মঠে ঢুকিয়ে দিলে, আর আমাদের চা-খোর করে তুললে। তোমরা হচ্ছো একটা নার্কটিকের ফ্যামিলি।” মহেন্দ্রনাথ দত্তের ভাই অর্থাৎস্বামী বিবেকানন্দের চা প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর পাল্লায় পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন গুরুভাইরাও। স্বামীজির এক গুরুভাই চা দিয়ে তর্পণের রীতিমত এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। স্বামীজির উপস্থিতিতে বরানগরে স্বামী শিবানন্দ মন্ত্রপাঠ করেছিলেন, অনেন চায়েন।”
গুরুবন্দনার পর এবার শিষ্যের কথায় আসা যাক। প্রত্যক্ষ শিষ্য অবশ্য নয় ভাব শিষ্য। দিনে পঁচিশ থেকে ত্রিশ কাপ চা না হলে যাঁর চলত না। তিনি সুভাষ চন্দ্র বসু। চা খেতে এতটাই ভালোবাসতেন দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকাকালীন কফির প্রতি অনুরাগ জন্মালেও চায়ের মতো পেয়ালাজুড়ে কফির তুফান ওঠেনি। কলেজে পড়ার সময়ে কফি হাউসে অবাধ যাতায়াত থাকলেও কফির চেয়েও পছন্দের খাবার ছিল চিকেন কাটলেট।
বাঙালিদের কাছে সুভাষ চন্দ্র বসু এক আবেগের নাম। রহস্যময় অন্তর্ধানের এতো বছর পরেও বাঙালিদের কাছে তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। রাজনীতির আঙিনাতেও যেমন, তেমনি খাদ্যরসিকদের দুনিয়াতেও। প্রতিবছর জন্মদিবসে নেতাজী-চর্চায় যাবতীয় উল্লেখের মধ্যে অবশ্যই নেওয়া হয় দুটি খাবারের দোকানের নাম। প্রথমটি হল, লক্ষ্মী নারায়ণ শ’ অ্যান্ড সন্স। বিধান সরণিতে অবস্থিত এই দোকানটির ভাজাভুজি খুবই জনপ্রিয়। নেতাজি বহুবার এই দোকানে এসেছিলেন। আজও ২৩শে জানুয়ারি এখানে বিনামূল্যে তেলেভাজা বিলি করা হয়। আরেকটি দোকানের নাম স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। ১৯২৭ সালে ভবানী দত্ত লেনে উৎকল নিবাসী মানগোবিন্দ পন্ডা খুলেছিলেন হিন্দু হোটেল। ৪৭-এর পর জুড়ে দেন ‘স্বাধীন ভারত’ শব্দ দুটি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে অবস্থিত এই হোটেলটিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে প্রথম পা রাখেন সুভাষচন্দ্র বসু। তখন তিনি কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি। মেনুকার্ডের নানান পদের মধ্যে বিশেষ পছন্দের ছিল পুঁইশাকের চচ্চড়ি। আজও স্বাধীনতা দিবসের লাঞ্চের মেনুতে অবশ্যই থাকে এই পদ।
জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা কটকে হলেও নেতাজীর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় উৎকলীয় খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব বেশি ছিল না। সাধারণ ডাল-ভাত,মাছের ঝোল অথবা ভাতে ভাত এই ছিল তার পছন্দ। ডালের মধ্যে ভালোবাসতেন মুগ ডাল। প্রতিদিন খাবারের পাতে রাখতেই হত দই। সব বাঙালির মত সুভাষও খিচুড়ি খেতে পছন্দ করতেন। বেশী ঝালমশলা দেওয়া খাবার ছিল না পসন্দ। পরে আমিষও যথাসম্ভব বর্জন করেন। মাংস-ডিম ছেড়ে শুধুমাত্র মাছ আর সবজি খেতেন। ফলের মধ্যে পছন্দের ছিল আপেল, কলা আর আঙ্গুর। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনিয়মিত আহারে হজমের সমস্যা এড়াতেই সম্ভবত সেদ্ধ খাবার খেতে পছন্দ করতেন। চা ছাড়া ঈষদুষ্ণ গরম জলে বিটনুন দেওয়া লেবুর জল ছিল আরও এক প্রিয় পানীয়। রাজনীতির জগতে পা রেখে আশ্চর্য সংযম রপ্ত করেছিলেন সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীও। হাজারিবাগ জেলের সহবন্দীদের ‘মোতঞ্জন পোলাও’ রেঁধে খাইয়েছেন অথচ নিজের খাদ্যতালিকায় বিলাসিতা বলতে ছিল সামান্য মাখন। স্বামী বিবেকানন্দের কথাই বা ভুলি কি করে। শিকাগো যাত্রার আগে গুরুভাইদের জন্যে নানা পদ রাঁধলেন অথচ নিজে মুখে তুললেন না কিছুই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘এখন সর্ববাদিসম্মত মত হচ্ছে যে, পুষ্টিকর অথচ শীঘ্র হজম হয়, এমন খাওয়া দাওয়া। অল্প আয়তনে অনেকটা পুষ্টি অথচ শীঘ্র পাক হয়, এমন খাওয়া চাই। যে খাওয়ায় পুষ্টি কম, তা কাজেই এক বস্তা খেতে হয়, কাজেই সারাদিন লাগে তাকে হজম করতে; যদি হজমেই সমস্ত শক্তিটুকু গেল, বাকী আর কি কাজ করবার শক্তি রইল?’ পেটের অসুখে দীর্ঘদিন ভুগে ওঠার পর সুভাষও এই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। সহজে যদিও সে অসুখ সারেনি। পেটের অসুখে ভোগার সময় লেবুর জল এবং চা ছাড়া কিছু মুখে তুলতেন না। শেষে হাওয়া বদল করতে পাড়ি দিতে হয়েছিল উত্তরে। হিমাচল প্রদেশের ডালহৌসিতে কাটিয়ে ছিলেন অনেকদিন। শোনা যায় সেখানে পরে এক বাউলি বা জলাধারের জল খেয়ে তার অসুখ সারে। সুভাষ বাউলি নামে সেই জলাধার এখনও তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে।
আরও পড়ুন : বুড়ির চুল / রোহন রায়
ছিলেন অমিত ধূমপায়ী। ঘনিষ্ঠরা বার বার সতর্ক করলেও খুব একটা মাত্রার হেরফের হয়নি। এছাড়া অগুন্তি লবঙ্গ,সুপারি খেতেন। অবসরে তো বটেই ব্যস্ত সময়ে এমনকি ব্যাডমিন্টন খেলার সময়েও সুপারি খাওয়ার কথা জানা যায় তাঁর ভাইপোর লেখা একটি চিঠির সুবাদে। পরে সুপারির পরিবর্তে হরিতকী খেতেন। কলেজ জীবনে কফিহাউস ছাড়া ফেবারিট কেবিন ছিল প্রিয় গন্তব্য। চট্টগ্রাম ফেরত দুই ভাই নূতনচন্দ্র বড়ুয়া আর গৌরচন্দ্র বড়ুয়া প্রতিষ্ঠিত ফেবারিট কেবিন ছিল সেই সময়ের বিপ্লবীদের প্রিয় গন্তব্য। কেবিনের চারনম্বর টেবিল ছিল সুভাষের জন্যে বরাদ্দ। প্যারামাউন্টেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
উৎকল-বঙ্গের অধিবাসী আর মিষ্টি ভালোবাসেন না , এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। নেতাজীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ ছাড়াও ভালবাসতেন ঘরোয়া মিষ্টি। চিনির পুলি, মনোহরা, নারকেল নাড়ু, রসবড়া, ছাতুর বরফি, মুড়ির নাড়ু, খইচূড়, তিলের নাড়ু, তিলের চাকতি তাঁর পছন্দের তালিকাটা অনেক লম্বা। বাদ পড়েনি পিঠেপুলিও।
এভাবেই আন্তর্জাতিক ব্যপ্তির আড়ালে বাসা বেঁধেছিল বাঙালিয়ানা। ‘সুভাষিত খাদ্যাভ্যাস’ তারই এক উপলক্ষণ মাত্র। চারিত্রবৈশিষ্ট্যে , জীবনচর্যায় সযত্নে তিনি আশৈশব বাংলা নামের দেশের মানুষ। ভাঙা বাংলা নয়, অখণ্ড বাংলা। তাই রহস্যজনক অন্তর্ধানের এত বছর পরেও তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে বাংলা, বিশ্বাস বন্ধক রাখে ঘরের ছেলের কাছে। তাদের প্রিয় সুভাষের কাছে।
তথ্য সহায়তাঃ
nayathahor.com
murukkuplus.com
......................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]
#series #essay #খাওয়াদাওয়া #স্বামী বিবেকানন্দ #খাদ্যরসিক #স্বামী শিবানন্দ #স্বামী সারদানন্দ #চা #ধূমপান #অচেনা অজানা বিবেকানন্দ #শংকর #ফেবারিট কেবিন #প্যারামাউন্ট #অমল গোমস #সিলি পয়েন্ট #নেতাজী #সুভাষচন্দ্র বসু