বুড়ির চুল
[রসিয়ে কষিয়ে : পঞ্চদশ পর্ব]
কখন বলা হচ্ছে সেটা জরুরি না। যখনই বলা হোক, এ গল্প কায়মনোবাক্যে নব্বইয়ের গল্প। সোভিয়েত ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলে দিলেন, ‘ইতিহাস’ শেষ। ঈশ্বরকে তো তার অনেক আগেই মেরে দিয়েছেন নিটশে। বাংলায় সব আবির তখনও লাল, কিন্তু উদার অর্থনীতি ক্রমে আসিতেছে। ফোন পকেটে ঢুকব ঢুকব করছে। চোখের সামনে রুমাল থেকে হয়ে যাচ্ছে বেড়াল। আমরা তখন একদম গেঁড়ে। নব্বইয়ের ঘেঁটেঘুঁটে যাওয়া টের পাইনি তখনও। তখনও তো জিনিসপত্রের তত বেশি বাড়াবাড়ি ছিল না। বদলে মুগ্ধ হবার অবকাশ ছিল। বিস্ময় তখনও মরে যায়নি। অল্পেই মুগ্ধ হওয়া যেত। সব রূপকথাই তখন কম-পয়সার। তার মধ্যে একটা ছিল গোলাপি রঙের। সাদাও হত, তবে গোলাপিই বেশি। মেলায়-টেলায় পাওয়া যেত। ফোলা-ফাঁপা, উমনো-ঝুমনো একটা জিনিস। কাঠিতে জড়িয়ে থাকত। একটুকরো পাহাড়িয়া মেঘ হাতের মুঠোয় বন্দি যেন। মুখে দিলেই গলে যেত। মুখটা মিঠে হয়ে থাকত অনেকক্ষণ। একটু যারা বড়লোকভাবাপন্ন, তারা বলত ‘কটন ক্যান্ডি’, বা ‘ক্যান্ডি ফ্লস’। আমরা ল্যালাক্যাবলা শহরতলি। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর বিশ্বায়িত সংস্করণের পাঠ আমরা নিইনি তখনও। অর্থাৎ স্মার্ট হতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা আমাদের তখনও চেপে ধরেনি। আমরা বলতাম ‘বুড়ির চুল’। একটা পোশাকি বাংলা নামও ছিল অবশ্য। ‘হাওয়াই মিঠাই’। তবে কম লোকেই সেই নামে ডাকত।
বাঙালি নাহয় পছন্দের জিনিসপত্র নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি রকমের রোম্যান্টিক। তবে ইউরোপ-আমেরিকাও কিন্তু একটা সময় মজেছিল মিষ্টি-জাতীয় এই মজার খাবারে। শুধু শিশুরা নয়, বড়দেরও পেড়ে ফেলেছিল ক্যান্ডি ফ্লস। অথচ উপকরণ বলতে চিনির শিরা আর ফুড কালার ছাড়া কিছুই না। উপস্থাপনাতেই বাজিমাত। একসময় হাতে পাক দিয়ে এই ধরনের খাবার তৈরির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মেশিন আসার আগে ক্যান্ডি ফ্লস স্বমহিমায় আবির্ভূত হতে পারেনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, আধুনিক ক্যান্ডি ফ্লসের জন্ম আমেরিকায়। সে অনেক কাল আগের কথা। প্রাথমিক পরিকল্পনাটি উইলিয়াম মরিসন নামে টেনেসি-নিবাসী এক দাঁতের ডাক্তারের। চিনি আর ডেন্টিস্ট, সকলেই জানেন, যাকে বলে পরস্পরের একেবারে জন্মশত্রু। অথচ এক দন্ত-চিকিৎসকের হাত ধরেই কিনা দুনিয়া কাঁপিয়ে দিল তুচ্ছ নিরীহ চিনির শিরা। মরিসন ছিলেন উদ্যোগী মানুষ। এর আগে তুলো-বীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, নিজের নামে সেটার পেটেন্টও নিয়েছিলেন। মরিসনের উর্বর মাথায় নতুন এক ধরনের মিঠাই তৈরির মেশিনের ভাবনা আসে। স্থানীয় মিঠাই-ব্যবসায়ী জন ওয়ারটনকে তিনি এই পরিকল্পনার কথা জানান। ১৮৯৭ সালে মরিসন ও ওয়ারটন পরীক্ষামূলকভাবে এই মিঠাই তৈরির মেশিন বানান। এই মেশিনের সাহায্যে তৈরি চিনির সুতোগুলো খুব সূক্ষ্ম হচ্ছিল, ফলে হাওয়ার সংস্পর্শে এসে তাড়াতাড়ি শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। তবে এই নতুন মিঠাই শুরুতেই যে দারুণ সাফল্য পেয়েছিল, তা নয়। সাফল্য এল সাত বছর পর, ১৯০৪ সালে, সেন্ট লুইস বিশ্বমেলায়। ‘ফেয়ারি ফ্লস’ নামে এই মিষ্টি খাবারটি মেলায় প্রভূত জনপ্রিয়তা পায়। বাক্স প্রতি দাম রাখা হয়েছিল ২৫ সেন্ট। মেলার কয়েকদিনে ৬৮ হাজার বাক্সেরও বেশি বিক্রি হয়। ১৮ হাজার ডলারের কাছাকাছি আয় করেন মরিসন ও ওয়ারটন। এই বিপুল সাফল্যের পর তাঁরা দুজন ‘ফেয়ারি ফ্লস’ নিয়ে বৃহত্তর পরিকল্পনায় নেমে পড়েন।
আরও পড়ুন : দাদাদের খাওয়াদাওয়া / রণিতা চট্টোপাধ্যায় ও বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
মার্কিন মুলুক তখন ফোর্ডের গাড়ি আর মার্ক টোয়াইনের কলমে বুঁদ। তারই মধ্যে ‘ফেয়ারি ফ্লস’ এসে জিভের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে রাতারাতি আমজনতার মনপ্রাণ আকুল করে তুলল। এই সস্তার মিঠাইয়ের এত সাফল্য স্বভাবতই প্রচুর ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করেছিল। ওই ধরনেই কিছুটা অন্যরকম প্যাকেজিং-এ খাবারটিকে উপস্থাপিত করার চিন্তাভাবনা নিয়ে ময়দানে নেমে পড়লেন অনেকেই। তবে ক্যান্ডি ফ্লসের সঙ্গে ডেন্টিস্টদের বোধহয় কিছু একটা নাড়ির যোগ ছিল। ১৯২০ সাল নাগাদ আর-এক দন্ত-চিকিৎসক জোসেফ লাসকক্স চেষ্টা করলেন মরিসন আর ওয়ারটনের তৈরি খাবারটিকে একটু অন্যরকম চেহারা দিতে। নাম দিলেন ‘কটন ক্যান্ডি’। লাসকক্সের মেশিন বা প্রোডাক্ট কোনোটাই মরিসন-ওয়ারটনের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। তবে ‘কটন ক্যান্ডি’ নামটা দারুণ হিট করে গেল। এই নামেই বছরের পর বছর বাজার মাত করেছে। ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য দেশেও। কিন্তু তখনও পর্যন্ত এই মিঠাই তৈরির মেশিনগুলো তেমন টেকসই ছিল না। ভয়ানক শব্দ করে ঘুরত আর সহজেই ভেঙে পড়ত। ১৯৪৯ সালে ওহিও শহরের 'গোল্ড মেডাল প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারারস' নামে এক কোম্পানি স্প্রিং-বসানো মেশিন বের করে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলে। এদিকে বিশ্বজুড়ে কটন ক্যান্ডির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গোল্ড মেডাল কোম্পানিকে লাখ লাখ ডলারের ব্যবসা দিচ্ছে এই মেশিন। তাই তারা ক্রমাগত চেষ্টা করছিল মেশিনটিকে আরও উন্নত করার। আরও কয়েক দশক পর ১৯৭০ সাল নাগাদ তারা কটন ক্যান্ডির জন্য পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় মেশিন তৈরি করে ফেলে। পরবর্তীকালে বিশ্বের সর্বত্র কটন ক্যান্ডি তৈরির জন্য এই মডেলের মেশিনই ব্যবহৃত হয়েছে এবং হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন : আড্ডার খোরাক / রণিতা চট্টোপাধ্যায়
শহরের লোকজন কমদামের জিনিসকে এখন আর বিশ্বাস করতে চান না তেমন। ‘বুড়ির চুল’ নামে ডাকার লোক এখন শহরে পাওয়া কঠিন। গ্রাম-মফসসলের মেলাগুলোই বুড়ির চুলকে যত্নে আগলে রেখেছে এখনও। তবে শহরেও বোধহয় এ জিনিসের খুব শিগগিরি ডোডোপাখি হবার সম্ভাবনা নেই। এই সেদিনই, রবীন্দ্র সদনের কাছে গাড়ি থামিয়ে স্যুট-বুট পরা হোমরাচোমরা অফিসবাবুকে একগাল শিশুর হাসি নিয়ে এ জিনিস কিনতে দেখেছি। বড়রা অমন হাসি হাসতে জানে না। সম্ভবই না। একেই বলে দ্রব্যগুণ। সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার দুনিয়ায় একটুকরো গোলাপি রঙের ‘সব পেয়েছি’। হাতে নিলেই বয়েসের ঘড়ি টগবগিয়ে দৌড় মারবে উলটোদিকে। কারণ কে না জানে, ঘুমিয়ে আছে পিতার শিশু সব পিতারই অন্তরে।
.............................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]