নিবন্ধ

দাদাদের খাওয়াদাওয়া

রণিতা চট্টোপাধ্যায় ও বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Nov 15, 2020 at 6:38 am নিবন্ধ

বাংলা কিশোর সাহিত্যে যত দাপিয়ে বেড়িয়েছে নানারকম দাদারা, তাদের সঙ্গে সমানে তাল মিলিয়েছে খাদ্যাখাদ্যের দাদাগিরিও। সুখাদ্যের প্রতি বাঙালির দুর্বলতার কথা কে না জানে! সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করেই বাক্যস্ফূর্তি আর উদরপূর্তি– এ-ই দুই হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের দাদাদের অনিবার্য চরিত্রবৈশিষ্ট্য। ‘চারমূর্তি’ ছবিতে ক্যাবলার বাড়িতে টেনিদারূপী চিন্ময় রায়ের গোগ্রাসে খাবার দৃশ্য মনে আছে? ভোজনরসিক দাদাদের তালিকায় সবার আগে অবশ্যই আসবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার নাম। পুরি-কচুরি থেকে মাংস-পোলাও, বাদামভাজা থেকে তেলেভাজা-চানাচুর, টেনিদার কিচ্ছুতে না-টি নেই। ‘কুট্টিমামার দন্ত-কাহিনী’ গল্পে প্যালারাম জানাচ্ছে, টেনিদা কিছুতেই মুখ বন্ধ রাখতে পারে না। একবার ট্রেনে যাবার সময় আর কিছু না পেয়ে পাশের ভদ্রলোকের লম্বা দাড়ির খানিকটা চিবিয়ে ফেলেছিল, ভদ্রলোক রেগে টেনিদাকে ছাগল-টাগল কীসব বলেছিলেন। আবার ঝন্টিপাহাড়ে যাওয়ার ট্রেনে স্বামী ঘুটঘুটানন্দের আবির্ভাব দেখে ঘাবড়ে গেলেও তাঁর যোগসর্পের হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা-লেডিকেনি সাফ করতে দ্বিরুক্তি করেনি টেনিদা। টেনিদার গুলপট্টির ফাঁকে ফাঁকে সমানতালে চলতে থাকে আলুর চপ-বেগুনি-পাঁঠার ঘুগনির অনুপান, উত্তর কলকাতার স্ট্রিট ফুডের অবিস্মরণীয় দলিল হয়ে থেকে যায় গল্পগুলি। দ্বারিক, কে সি দাশ, চাচার হোটেলের মতো ঐতিহ্যবাহী উত্তর কলকাতার খাদ্যালয়গুলির নাম মফস্বলের বাঙালি কিশোর কিশোরীরা জেনেছিল টেনিদার হাত ধরেই। শুধু তাই নয়, টেনিদা যেভাবে অনায়াসে তাদের পয়সায় ভালোমন্দ খেয়ে হজম করে নেবার পরেও তার প্রতি প্যালা হাবুল ক্যাবলার ভালোবাসায় এতটুকু ভাটা পড়ে না, তাতে উত্তর কলকাতার তৎকালীন পাড়া কালচারজাত হৃদ্যতার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, টেনিদা শুধুই কেড়ে খেয়ে নেয় না, তার স্যাঙাতদের ভালোমন্দ খাবার সুযোগও করে দিতে জানে। ‘ব্রহ্মবিকাশের দন্তবিকাশ’, ‘হালখাতার খাওয়াদাওয়া’, ‘ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন’, ‘ভজগৌরাঙ্গ কথা’ প্রভৃতি একাধিক গল্পে প্যালারামকে ভালোমন্দ খাবার সুযোগ করে দিয়েছে টেনিদা, তবে অবশ্যই সেটা ‘পরস্মৈপদী’। কেবল একবারই, টেনিদার খাট কেনার কার্যকারণসূত্রে প্যালার সৌভাগ্য হয়েছিল পলান্ন ভোজনের, তবে আমাদের হিংসের ভয়ে প্যালা তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়নি।

টেনিদা কাহিনির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল মানুষের মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তির সঙ্গে খাদ্যদ্রব্যের উপমা, টেনিদা ‘ডিমের ডালনা’ বা ‘বেগুনভাজার মত বিচ্ছিরি’ মুখ করে, ক্যাবলা ‘আলুভাজা আলুভাজা’ মার্কা করুণ মুখ করে তেলেভাজা আনতে যায়। টেনিদার বিশ্বময় মামাদের কথা ছেড়েই দিই, পড়ে পাওয়া দাদা ‘হনোলুলুর মাকুদা’ অব্দি অনায়াসে উড়িয়ে দিতে পারেন চারটে কাটলেট, দু প্লেট মাংস, এক প্লেট পোলাও আর এক প্লেট পুডিং। কুট্টিমামার গল্পের সেই বাঘটাকেও ভুলে গেলে চলবে না, কালীসিঙ্গির মহাভারতের ঘায়ে দাঁত খোয়ানোর পর কুট্টিমামার বাঁধানো দাঁত নিয়ে যে বেচারি আলুর দম খেয়ে পিত্তিরক্ষা করত।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পিনডিদারও ছিল পরের ঘাড় ভেঙে নিজের উদরপূর্তির বদভ্যেস। খাওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ এমনই বেশি যে, ‘লিডার বটে পিনডিদা’ কাহিনিতে সে অনুরোধই করে বসে– “চপ কাটলেট কালিয়া কোর্মা আছে এমন একটা গান কর না তোরা”! বিনোদের দোকানের ফাউল কাটলেট, মোগলাই পরোটা, মাছের ফ্রাই বা মাংসের চপের দাক্ষিণ্যে পিনডিদার গল্পের গাড়িও ছুটেছে তরতরিয়ে।

ইয়েতি দেখার প্রসঙ্গে পূর্বসূরি ঘনাদার উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকিয়ে টেনিদার উক্তি, “ঘনাদা! তিনি তো মহাপুরুষ। ইয়েতি কেন– তার দাদামশাইয়ের সঙ্গেও তিনি চা-বিস্কুট খেতে পারেন।” বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা ঘনাদা অবশ্য কেবল চা-বিস্কুটে সন্তুষ্ট, এমন অপবাদ তাঁর শত্রুতেও দিতে পারবে না।  তাঁর মুখ থেকে প্রত্যেকটি গল্প আদায় করবার জন্য কী না ভেট দিতে হয়েছে মেসের অন্য চার বাসিন্দা– গৌর, শিশির, শিবু ও সুধীরকে! ফুলকপির শিঙাড়া, কবিরাজি কাটলেট, গঙ্গার ইলিশ থেকে সদ্য ভাজা গরম ক্রোকেট, ক্যানিং-এর কুলীন পার্শে, ম্যাগলিটি থেকে আনা কুলপি বরফ, এবং অবশ্যই শিশিরের টিনের সিগারেট। ফিস্ট ইত্যাদি উদ্যোগেও উৎসাহে কমতি নেই ঘনাদার, নুরুদ্দিনের খাসির গুণগান জাতীয় প্রস্তাব দিতেও তিনি একপায়ে খাড়া, আপত্তি শুধুমাত্র নিজের পকেট থেকে পয়সা বের করার বেলায়। ঙগারুসেরচঙ হাঁসের গল্প শুনিয়ে বাপি দত্তের পয়সায় মেসের বাকি সভ্যদের দীর্ঘদিন ধরে কেমন হাঁসের মাংস ভক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি, তা ঘনাদাপ্রেমী মাত্রেই স্মরণ করতে পারবেন। সস্তা হোটেলের ভাজাভুজি উদরস্থ করতে করতে তৃতীয় বিশ্বের সদ্যস্বাধীন এক দেশের নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর পরিবেশে এক বাঙালি যুবকের শুধুমাত্র কল্পনার পাখায় ভর করে নিয়মিত বিশ্বভ্রমণ যেন বুঝিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যতই পিছিয়ে থাকুক, কল্পনার জগতে বাঙালি যে বিশ্বচেতনা অর্জন করেছে, সেখানে তার পায়ে শিকল পরায় এমন সাধ্য কার!

ঘনাদার মতো মনে মনে নয়, সত্যি সত্যিই বিশ্ব জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা। আফ্রিকার রুয়াহা থেকে সেশ‍্যেলস দ্বীপপুঞ্জ, কাঙ্গপোকপি থেকে আন্দামান, আবার হাজারিবাগ বা ডুয়ার্স, শিকারি ঋজুদার রসনাও স্বাদ পেয়েছে দেশবিদেশের রকমারি কুইজিনের। ‘ঋজুদার সঙ্গে বক্সার জঙ্গলে’  শিলবিলাতি আলুভাজা দেখে ঋজুদার মনে পড়ে গাড়োয়াল অঞ্চলে খাওয়া যোশীমারী আলুর কথা। ভোজনরসিক ঋজুদার গল্পে বটি কাবাব দেওয়া বিরিয়ানি, চিকেন চাঁব, গুলহার কাবাব, সম্বরের মাংসের আচার, পাঁঠার তেলের চৌরী, লাব্বা, পায়া আর কবুরার চচ্চড়ির পাশাপাশি জায়গা করে নেয় পাকা পণ্ডিত রুইয়ের রেজালা,  বেগুন বাসন্তী, চন্দ্রপুলি, আবার কোল্ড চিকেন, ভেটকি স্যালাড, পর্কের গুলাশ আর ক্যারামেল কাস্টার্ড পুডিং-ও। শুঁটকি মাছ ভালোবাসে ঋজুদা, চা খায় মকাইবাড়ি কিংবা দার্জিলিংয়ের লপচুর, স্প্রাইটের ভক্ত, আর প্রায় সর্বক্ষণ ঠোঁটে ঝোলে পাইপ। টেবল ম্যানার্স বা খাদ্য সম্পর্কিত খাতিরদারিতেও ঋজুদার জুড়ি মেলা ভার। রুপোর রেকাবিতে আতরজল ছিটিয়ে ভিজে মলমলের ঢাকনি দিয়ে পান রাখার হুকুম দিয়ে খানদানি বাবুর্চিরও তারিফ কুড়িয়ে নিতেও পারে সে। আর এসবের সঙ্গে সঙ্গেই ঋজুদা কাহিনিতে রয়ে যায় এক অন্যতর জগৎ, যেখানে আদিম আরণ্যক মানুষকে ঋজুদা আদর করে খাওয়ায় নিমন্ত্রিত অতিথির মতো, কিংবা ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ গল্পে বনচারী মানুষেরা তাকে সাদরে নিমন্ত্রণ জানায়– “ভাত, মসুরের ডাল, বিড়ি বড়া আর রম্ভাভাজা, এই খাওয়াব। তবে পয়সা-টয়সা নেব না। কোনোদিনই নিইনি, আজও নেব না।”     

ঋজুদার মতোই পাইপ টানার অভ্যেস ছিল বিশপ লেফ্রয় রোডের আরেক বাসিন্দারও। হ্যাঁ, রায়মশাইয়ের কথাই বলছি। আর নিজের এই ধূমপানের অভ্যাস তিনি চারিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ফেলুদার মধ্যেও। ফেলুদা চারমিনার খেলেও লেখকের মতোই মদ ছোঁয় না, এবং ড্রাগ প্রভৃতি বিপজ্জনক নেশার প্রতি তার প্রবল ঘৃণার পরিচয় পাওয়া যায় ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ গল্পে। সিগারেট এবং মিঠে পান ছাড়াও আরেকটা নেশা ছিল ফেলুদার, সেটা ভালো চায়ের, যা আসত মকাইবাড়ি থেকে। তবে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পূর্বে বাঙালি ভদ্রবিত্তের যে বাহুল্যবর্জিত জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায় ফেলুকাহিনির পাতায় পাতায়, ফেলু-তোপসে-লালমোহনের খাদ্যাভ্যাস তার ব্যতিক্রম নয়। বিকেলে চায়ের সঙ্গে কলিমুদ্দির দোকানের ডালমুট বা চানাচুর, ‘ডাঃ মুনসীর ডায়রি’ গল্পে তার জায়গা নিয়েছে শিঙাড়া। সবরকমের খাবারেই ফেলুদা স্বচ্ছন্দ, খাওয়ার ব্যাপারে সে সংযমীও, তবে তোপসে জানিয়েছে নতুন গুড়ের সন্দেশ বা ভালো মিহিদানার ক্ষেত্রে সে সংযম খাটে না। ‘কৈলাস চৌধুরীর পাথর’ গল্পে তোপসের প্লেট থেকে জিলিপি তুলে নিয়ে ফেলুদা বলেছিল, ‘তোকে সম্মানিত করছি’, আর ‘বাদশাহী আংটি’-তে মাছি তাড়াবার কায়দায় তোপসের প্লেট থেকে তুলে নিয়েছিল একটা লাড্ডু। বেনারসের কচৌরি গলির হনুমান হালুইকরের রাবড়ির আকর্ষণই ফেলুদার কাছে কাশী যাওয়ার যথেষ্ট কারণ। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ গল্পে জটায়ুর বই থেকে প্রথম সিনেমা হওয়ার খবরের সঙ্গে এসেছিল ‘ফাইভ মিক্স সুইটমিটস’, যার মধ্যমণি হিরের মতো পলকাটা রুপোর তবক দেওয়া রসভরা কড়াপাকের সন্দেশ ‘ডায়মণ্ডা’। নতুন কোনো জায়গায় গেলে সেখানকার স্থানীয় ইতিহাস, স্থাপত্য ও পরিধানের পাশাপাশি স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের বর্ণনাও দেন সত্যজিৎ, ‘সোনার কেল্লা’তে উটের দুধের চা বা ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ গল্পে বড়াপাওয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন তারই পরিচায়ক। লখনউতে গিয়েই ওরা জেনেছিল, সান্ডিলা লাড্ডু, গুলাবি রেউড়ি আর ভুনা পেঁড়া, এই তিন মিষ্টি হল লখনউয়ের স্পেশালিটি। লখনউ থেকেই ট্রেনে হরিদ্বার যাওয়ার সময় ফেলুদা বলেছিল, “ব্রেনের কাজটা যখন বেশি চলে, তখন মুরগি জিনিসটা খুব হেল্প করে।” নিজামের মাটন রোল, রয়্যালের বিরিয়ানি, পার্ক স্ট্রিটের ব্লু ফক্সে স্যান্ডউইচ বা ওয়লডর্ফে চিনে খাবার যেমন চেটেপুটে খেতে দেখা গেছে ফেলুদাকে, তেমনই হংকং-এ ফ্রায়েড স্নেক খাওয়ার প্রস্তাবেও তাকে দ্বিধা করতে দেখা যায়নি।


#সিরিজ #series #টেনিদা #পিনডিদা #ঘনাদা #ঋজুদা #ফেলুদা #নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় #আশুতোষ মুখোপাধ্য্যায় #বুদ্ধদেব গুহ #সত্যজিৎ রায় #প্রেমেন্দ্র মিত্র #খাওয়াদাওয়া #রণিতা চট্টোপাধ্যায় #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

13

Unique Visitors

177671