নিবন্ধ

সম্পাদক সত্যজিৎ

নির্মাল্য কুমার ঘোষ Feb 7, 2021 at 5:23 am নিবন্ধ

.............................

১.

মা সুপ্রভা রায়ের ইচ্ছানুসারেই, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে, সত্যজিৎ রায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায়, পুনঃপ্রকাশ করলেন পারিবারিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’। সম্পাদকমন্ডলিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংযোজন বিয়োজন চলতে লাগলো।  সুভাষ মুখোপাধ্যায় সরে গেলেন। এলেন লীলা মজুমদার। তার সঙ্গে যুক্ত হলেন নলিনী দাশ। কিন্তু ১৯৬১ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত, সুদীর্ঘ তিরিশ বছর ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদনার নেপথ্যে রয়ে গেলেন “বড়ো সম্পাদক” (আড়ালে তাঁকে  এই নামেই ডাকতেন এমনকি লীলা-নলিনীরাও) সত্যজিৎ রায়। দুই ডজন কাহিনিচিত্র-তথ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি, সারা পৃথিবী চষে-বেড়ানো এই মানুষটি, নিরলসভাবে ‘সন্দেশ’-এর জন্য লিখে গেলেন, অন্যদের লেখা পড়ে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিলেন, অন্যদের রচনা সংশোধন করলেন, নিজের এবং অন্যদের লেখার জন্য ছবি আঁকলেন, তৈরি করলেন প্রচ্ছদ -- কার্যত সম্পাদনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাক্ষর রেখে গেলেন। ‘সন্দেশ’ সম্পাদনার ক্ষেত্রে বাবা আর ঠাকুরদার ঐতিহ্য মেনেই, সত্যজিৎ ছোটদের মনটাকে গড়ে দেওয়ার জন্য ‘খেলা-ধূলা’, ‘হাত পাকাবার আসর’ কিংবা ‘প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর’-এর মতো নতুন নতুন বিভাগ যেমন চালু করেছিলেন, পাশাপাশি নিজেও কলম ধরেছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য ছোটদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে। সুদীর্ঘ তিন দশকের সম্পাদনাকালে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত সত্যজিতের এরকমই একাধিক রচনা এখনও অগ্রন্থিত। ‘সিনেমার কথা’ (ভাদ্র-আশ্বিন-মাঘ ১৩৭৪, বৈশাখ ১৩৭৫), ‘আশ্চর্য প্রাণী’ (আশ্বিন ১৩৭৮, জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৪), ‘কমিকস শিল্পী উইনসর ম্যাক’কে (এপ্রিল ১৯৭৮), ‘ভেড্ডি সাহেবের ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ’ (মে ১৯৮৪), ‘অজ্ঞাত প্রাণীর সন্ধানে’ (জানুয়ারি ১৯৮৫), ‘তিন আঙ্গুলের স্লথ’ (জুলাই ১৯৮৫), ‘অবাক শিল্পী আদিম মানুষ’ (অক্টোবর ১৯৮৫), ‘বাবার খেরোর খাতা’ (মে ১৯৮৭), ‘উপেন্দ্রকিশোরের সন্দেশ’ (এপ্রিল ১৯৮৮), ‘অমর চার্লি’ (মে ১৯৮৯) বা ‘কাকামণি’ (নভেম্বর ১৯৯১) তেমনই কয়েকটি রচনা।  


২. 

সম্পাদক-রূপে ছোটোদের জ্ঞানের জগৎকে ভরিয়ে তোলার জন্য, সত্যজিৎ রায় যেমন কলম ধরেছিলেন প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে, তেমনি সম্পাদক সত্যজিতের আরেক কীর্তি ছড়াকার সত্যজিৎকে উপস্থাপন করা। ১৯৬১ সালের নবপর্যায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গোড়া থেকেই, সত্যজিতের অনুবাদক-ছড়াকার রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এডওয়ার্ড লিয়র, লুইস ক্যারল এঁদের আশ্চর্য সব ছড়ার চমৎকার অনুবাদ করেন সত্যজিৎ। সে-অনুবাদে লুইস ক্যারলের সঙ্গে মিশে যান সুকুমার রায় --

            “দাদা পষ্ট চোখে দেখছি গণৎকারে

             বলছে তুমি হচ্ছ মহারাজা,

             আবার চেয়ে দেখছি আরে এ যে 

             ঠোঙায় ভরা চীনেবাদাম ভাজা!”

শেষ নয় এখানেই। পাদ-পূরণের তাগিদে সম্পাদক সত্যজিৎ আবারও কখনও কখনও হয়ে উঠেছেন ছড়াকার।  ১৩৭০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ‘সন্দেশ’-এ অমলের একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়, যেখানে একটি মোরগ আড়মোড়া ভাঙছিল আর তার পাশে একটা ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজছিল। সত্যজিৎ তার সঙ্গে লিখে দেন --

       “ঠিক শুনেছি ঘড়ির আওয়াজ ঘুমজড়ানো চক্ষে

        নইলে ওঠা কঠিন হত ভোরে আমার পক্ষে।”

আরেকটি কার্টুনে অমল আঁকেন, ডাঙায় দাঁড়ানো বক আর জলের নিচে পেরিস্কোপ চোখে মাছ। সত্যজিৎ মাছের জবানিতে লেখেন --

       “ডাঙার কাছে ঘুরে-বেড়াই পেরিস্কোপের জোরে 

        বকের এখন সাধ্যিও নেই আমায় নেয় ধরে।” 

অমলের তৃতীয় কার্টুনে দেখা যায়, একটি শকুন চোখে দূরবীন লাগিয়ে উড়ছে। সত্যজিৎ লেখেন --

        “একে টেকো তায় বুড়ো চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি 

         দূরবীনে ধরে ফেলি আছে কোথা ফিস্টি।”

উইলিয়াম হিথ রবিনসনের আঁকা বিখ্যাত কার্টুনের বই ‘রেলওয়ে রিবলড্রি’ (১৯৩৫) থেকে সত্যজিৎ যখন ‘রেলগাড়ির আদিপর্ব’ (১৩৮৭-৮৮ বঙ্গাব্দ) নাম দিয়ে ছবিগুলি ছাপতে লাগলেন ‘সন্দেশ’-ও, তখনও তার সঙ্গে ছড়া তিনি নিজেই লিখে দিতেন --  

        “বড় মুশকিল - রেলগাড়ি যাবে বাগডোগরা,

         সিগন্যালটার দফারফা করে কাঠঠোকরা।”

সত্যজিতের অন্তর্নিহিত যে ছড়াকার সত্তা, ‘সন্দেশ’ সম্পাদনার ক্ষেত্রে, বিশেষত ছড়ার মুদ্রণে কীভাবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটত, তার একটি চমৎকার স্মৃতিচারণা করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সন্দেশ-এর দিনগুলি’ বইতে।  মুস্তাফা নাশাদের লেখা ‘বাঘবন্দী’ ছড়াটিকে, সত্যজিৎ কীভাবে অদল-বদল করেছিলেন, তার বিস্তৃত বর্ণনা পাই এখানে। নাশাদ লিখেছিলেন --

             “তাই না শুনে খোশ মেজাজে 

                   কেঁদো বাঘটি গলা

               বাড়িয়ে ভাবে ঘাড় মটকে 

                   করবে বুড়ির দলা !

               গায়ের জোরে ঢুকল ঘরে 

                   শুনল না বাঘমামা 

              কোথায় বুড়ি? খাবে কাকে? 

                   এ যে কয়েদখানা !”

সত্যজিৎ এই পঙ্‌ক্তিগুলিকে বদলে করলেন --

              “তাই না শুনে খোশ মেজাজে 

                      বাঘবাবাজি ভাবে

               ঠিক মিলেছে সুযোগ এবার

                     বুড়ির মাংস খাবে!

               গান গেয়ে যেই ঢুকল ঘরে 

                      তাইরে নানা নানা

              অবাক দেখে - কোথায় বুড়ি ?

                     এ যে কয়েদখানা!”

উজ্জ্বল চক্রবর্তী তাঁর ‘সত্যজিৎ-ভাবনা’ বইতে লিখেছেন -- “উপন্যাসের মধ্যে যদি কোনও গুপ্তধনের সংকেত থাকত, সেটাও কোনও-কোনও সময় নতুন করে লিখে দিতেন সত্যজিৎ রায়। যেমন, শিশির মজুমদারের ‘রসিক খুড়োর যকের ধন’ উপন্যাসের গুপ্তধনের সংকেতটা সত্যজিৎ রায়েরই লেখা। “অবশ্য সম্পাদক-রূপে পত্রিকা প্রকাশের সময় লেখার উপরে কলম চালালেও, গ্রন্থ-প্রকাশের সময় শিশিরকুমার যে তাঁর নিজের লেখা ছড়াটিই রাখতে পারেন, এমন কথাও স্নেহভাজন লেখককে বলতে ভোলেননি “বড়ো সম্পাদক”।  


৩. 

পত্রিকা প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট মান সত্যজিতের তৈরি ছিল। ছিল কিছু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। ফলে আমরা লক্ষ করব, সত্যজিৎ যেমন ‘সন্দেশ’ সম্পাদনার সূত্রে একাধিক নতুন লেখকদের তৈরি করেছেন, তেমনি এইসব নতুন লেখকদের একাধিক রচনাকে যথেষ্ট কাটা-ছেঁড়াও করেছেন তিনি। সত্যজিতের হাত ধরেই ‘সন্দেশ’-এ একের-পর-এক উঠে এসেছেন শিশিরকুমার মজুমদার, মঞ্জিল সেন, রেবন্ত গোস্বামী, গৌরী ধর্মপাল, অজেয় রায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা। প্রথমে লেখা যেত নলিনী দাশের কাছে, তারপর লীলা মজুমদারের হাতে। তাঁদের পছন্দ হলে, সেই নির্বাচিত লেখার বান্ডিল যেত “বড়ো সম্পাদক” সত্যজিৎ রায়ের হাতে। “বড়ো সম্পাদক” তার থেকে ফাইনাল নির্বাচন সারলে, তবেই সেই লেখা ছাপা হত ‘সন্দেশ’-এ। এমনটাই ছিল ‘সন্দেশ’-এর নির্বাচনী প্রক্রিয়া। একবার শিশিরকুমার মজুমদারের উপন্যাস ‘আকাশে আগুন পাতালে আগুন’ নলিনী দাশ এবং লীলা মজুমদারের থেকে পাসমার্ক পেলেও, সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটি নাকচ করে দেন। তিন সম্পাদকের অনেক তর্ক-বিতর্কের পর শেষপর্যন্ত সত্যজিৎ তাঁর মত বদলে উপন্যাসটি ‘সন্দেশ’-এ ধারাবাহিকভাবে ছেপেছিলেন এবং স্বয়ং তার অলংকরণও করেছিলেন । 

সম্পাদকীয় কর্তব্যপালনে স্নেহের অনুজ লেখকদের কিভাবে গড়েপিটে নিচ্ছিলেন সত্যজিৎ, তার সবচেয়ে বেশি প্রমাণ মেলে এঁদের লেখা চিঠিপত্রে। ১২.৬.১৯৭৩-এর চিঠিতে “স্নেহের অজেয়”-কে সত্যজিৎ লেখেন -- “শেষ ম্যাজিকে তুমি সোজা ম্যাজিকের পটভূমি তৈরি করে দাশ কি করে পাকড়াশীকে টেক্কা দেয় সেই সম্বন্ধে পাঠকের মনে কৌতূহল জাগিয়ে শেষটায় ভূতের গল্পে চলে গেলে কেন? ভূত আর ম্যাজিকে মিশ খাওয়ানো বড় শক্ত। কারণ দুটো আলাদা।” আবার ১৯৭৩-এর ১৯ জুনের চিঠিতে সত্যজিৎ অজেয় রায়কে লেখেন -- “সেদিন তোমার ম্যাজিকের গল্প নিয়ে একটা খুঁৎখুঁতে চিঠি লিখেছি। আজকে বলছি চেঞ্জ খাসা গল্প হয়েছে। ভাষা থিম সংলাপ চরিত্র সব ভালো।” উদীয়মান প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন লেখককে গড়ে-পিটে ‘সন্দেশী’ করে নেওয়ার জন্য, প্রয়োজনে তার গল্প বা উপন্যাসের চার পৃষ্ঠাব্যাপী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সমন্বিত, কার্যত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনা করতেন সত্যজিৎ, তাঁর লেখা চিঠিগুলিতে! ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য মঞ্জিল সেন ‘ডাকাবুকো’ নামের একটি উপন্যাস পাঠান। লীলা মজুমদারের দ্বারা সংশোধিত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি, সত্যজিৎ রায়ের কাছে যায়। দেবাশিস সেন জানাচ্ছেন --“কিছুদিন পরে মঞ্জিল সেন সত্যজিতের লেখা চার পাতার একটি দীর্ঘ চিঠি পেলেন। সম্পাদক লিখেছিলেন যে লেখাটির মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। পুরো উপন্যাসটি গোড়া থেকে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন কেন লেখাটি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। শুধু তাই নয়, কীভাবে লিখলে লেখাটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে তার একটি নির্দেশিকাও তিনি দিয়েছিলেন।” ১৯.০৪.১৯৭৪-এর সেই চিঠিতে সত্যজিৎ মঞ্জিল সেনকে লেখেন -- “আপনি যদি চারটির মধ্যে একটি চরিত্রকে যেমন বলেছি তেমনভাবে তৈরি করেন, তাহলে আপনার themeও বজায় থাকবে এবং সেইসঙ্গে অন্য তিনজন গুন্ডা হওয়াতে thrill, suspense ইত্যাদি সবই আসবে। আর চার চারটে embittered চরিত্রের একসঙ্গে reformed হয়ে যাওয়ার অবাস্তবতাও কেটে যাবে। মৌলিকত্বের কথাই যদি বলেন, তাহলে বলব বাচ্চা মেয়েকে kidnap করে, তার সরলতার প্রভাবে kidnapper চরিত্রে পরিবর্তন হওয়ার গল্প কিন্তু বাংলাতেই আগে লেখা হয়ে গেছে। অচিন্ত্য সেনগুপ্তের ‘ডাকাতের হাতে’ পড়েছেন নিশ্চয়ই। আসলে গল্প ষোলো আনা মৌলিক হওয়াটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার এবং ওদিকটা নিয়ে খুব মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।” 


১৯.৪.৮০-র এক চিঠিতে অজেয় রায়কে সম্পাদক সত্যজিৎ নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন -- “আমি একটু বেশি খুঁৎখুঁতে”। সত্যজিতের লেখা একমাত্র নাটক ‘হাউই’-এর সম্পাদকের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সত্যজিৎ নিজে ঠিক কেমন সম্পাদক ছিলেন। যেহেতু ছোটদের জন্য সমস্ত লেখাপত্র, তাই তাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি, তাদের কাছে যেন কোনো ভুল তথ্য না-পৌঁছে-দেওয়া-হয় সে-বিষয়ে সদাসতর্ক ছিলেন সম্পাদক সত্যজিৎ ।  ২৬.৬.৭১-এ অজেয় রায়কে এক চিঠিতে সত্যজিৎ লিখছেন - “আপনার লেখা সাগর-গৌরব গল্পটা সবেমাত্র আমার হাতে এসেছে।  ... গল্পটি ছাপার আগে একটা জিনিসের authenticity সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। Shells সম্পর্কে যা পড়েছি, তাতে Conus Gloria Maris এর উল্লেখ অবশ্যই পেয়েছি। কিন্তু তার বিষাক্ততা সম্বন্ধে কোনো উল্লেখ দেখিনি ।  এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আর চিন্তার কোন কারণ থাকে না। কারণ এজাতীয় গল্পের documentary দিকটা নির্ভুল হওয়া দরকার।” ৬.৭.৭১-এ লেখা পরবর্তী চিঠিতে অজেয়কে সত্যজিৎ জানাচ্ছেন -- “Gloria Maris সম্পর্কে আপনার তথ্যে কোনো ভুল নেই জেনে নিশ্চিন্ত হলাম।” “উটের পাকস্থলী” নিয়ে জটায়ুকে নাস্তানাবুদ করে-দেওয়া ফেলুদাকে আশা করি চেনা যাচ্ছে! ১৯৮০-র জুনের স্মৃতি বিজয়া রায় লেখেন -- “ফেলুদার গল্প যখনই কিছু লেখেন, সন্দেহ থাকলে তথ্য সংগ্রহ করেন এক্সপার্ট লোকেদের কাছ থেকে। এবার ডাক পড়ল আয়ান রশিদ খানের। জানতে চান ভেজাল ওষুধের কারবার সম্বন্ধে। পুলিশরা এ সম্বন্ধে বেশি জানে বলেই, রশিদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং ওর কাছে এ বিষয়ে খুঁটিনাটি সবকিছু জেনেছিলেন।… ফেলুদার গল্পটা এ বার কাঠমান্ডুতে ফেলেছেন।” প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সন্দেশ-এর দিনগুলি’ বইতে এ’প্রসঙ্গে একটি চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছেন-“লীলাদির কাছে A মার্কা পেয়ে আমার জীবজন্তু সিরিজের ‘সাপ’ কবিতাটি গেল সত্যজিৎ রায়ের কাছে। আমি আরম্ভ করেছিলাম এইভাবে --

          ‘চলনটা তোর আঁকাবাঁকা ফণাটা নিসপিস

           বিদ্বেষে তুই দোলাস মাথা কন্ঠে ভরে বিষ । ‘

উনি ‘কন্ঠে’র তলায় দাগ দিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘সাপের বিষ কন্ঠে থাকে না -- থাকে দাঁতের নীচে। ‘তাছাড়াও তলায় আরো লিখলেন ‘কেউটে ছাড়া খুব কম সাপই তেড়ে এসে আক্রমণ করে -- কাজেই সাপ সম্বন্ধে ‘বুকভরা ক্রোধ’, ‘লকলকিয়ে দুলল জিভে মৃত্যুর মরসুম’ -- ইত্যাদি বলা ঠিক নয়।’…সাপের বিষ সে কন্ঠে থাকে না সেটা জানতাম, শুধু poetic justice-এর সুযোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝলাম তাতে ছোটোদের ভুল শিক্ষা হত।”

আরও পড়ুন : একটি নীল রঙের খাতা আর সত্যজিতের লেখা বড়দের গল্প / বিবস্বান দত্ত

ছোটদের লেখায় তথ্যের অযথার্থতা যেমন সম্পাদক সত্যজিতের অপছন্দের ছিল, তেমনি সম্পাদক সত্যজিৎ চেয়েছিলেন কমিকস পড়ানোর মধ্যে দিয়ে বাচ্চাদের কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটাতে। কমিকসের প্রতি সত্যজিৎ রায়ের বিপুল আগ্রহ ছিল। ‘কমিকস যখন গল্প বলে’ (আজকাল, ২রা জুন ১৯৯৬) নামের এক রচনায় ময়ূখ চৌধুরী লেখেন- “কমিকস সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের উৎসাহ ছিল দারুণ। তাঁরই সম্পাদনায় পরিচালিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম কমিকস -- ‘ঋণশোধ’ (সম্ভবত বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক কমিকস)।…মানিকদার তত্ত্বাবধানে আরও কয়েকটি কমিকস আমি রচনা করেছিলাম এবং সেগুলো যথাসময়ে সন্দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তাঁর সক্রিয় সাহচর্য ও উপদেশ আমাকে যে কমিকস রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল, সে কথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ ঘটবে।” ‘ঋণশোধ’ বাদ দিলে, ১৩৭০-এর আশ্বিনে ‘পেক্কা’, ১৩৭৬-এর কার্তিকে ‘সাক্ষী ছিল চাঁদ’, ১৩৭৭-এর ভাদ্র-আশ্বিনে ‘সিংহের শত্রু’ আর ১৩৭৯-এর কার্তিক-চৈত্রে প্রকাশিত ‘মহাকালের মন্দির’, ‘সন্দেশ’-এর সত্যজিৎ-যুগে ময়ূখের করা অবিস্মরণীয় চারটি চিত্রকাহিনি। ১৯৭০-এর মে-জুন সংখ্যায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয় সত্যজিতের অন্যতম প্রিয় চিত্রশিল্পী শৈল চক্রবর্তীর ছেলে দীপকের করা কমিকস ‘খুড়ো ভাইপো আর দুদাড়ি’। ১৯৭০-এর জুলাই-আগস্ট, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, নভেম্বর-ডিসেম্বর আর ১৯৭১-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, এই চারটি সংখ্যা জুড়ে সত্যজিৎ ‘সন্দেশ’-এর প্রচ্ছদ করেন স্বরচিত কমিকস দিয়ে। এক বাঙালিবাবুকে কেন্দ্র করে চারটে সংলাপহীন কমিকস স্ট্রিপ। ঋতুর সঙ্গে মিলিয়ে কীভাবে কমিকস এঁকেছেন সত্যজিৎ, তা ‘রং তুলির সত্যজিৎ’ বইতে দেবাশীষ দেব আমাদের ধরিয়ে দেন-- “প্রথমটা ছাপা হয় বর্ষা সংখ্যা অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসের সন্দেশ-এ -- এখানে আসল মজাটাই ছিল তুমুল বৃষ্টি হয়ে এক কোমর জলের মধ্যে বাবুর আটকে পড়া। এর পরেই প্রকাশিত হয় শারদীয় সংখ্যা আর সত্যজিৎ এঁকেছিলেন চারদিকে বাজি ফাটানোর আওয়াজে বাবুর একেবারে কাহিল অবস্থা। তৃতীয়টি ছিল হেমন্ত সংখ্যা অর্থাৎ নভেম্বর আর ডিসেম্বর মাস -- ছোটদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার সময় -- তাই এখানে ছিল চিড়িয়াখানা যাবার ঘটনা। শেষ স্ট্রিপ-কার্টুনটা ছিল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদে। কলকাতায় এই সময় নিয়ম করে সার্কাসের দল আসে -- কার্টুনের বাবুটিকেও দেখা গেল ভারত সার্কাসের একজন ট্রাপিজ-খেলোয়াড় হিসেবে।” সত্যজিৎ-সম্পাদিত ‘সন্দেশ’-এ বিভিন্ন সময়ে নতুন শিল্পীরা যেসব কমিকস আঁকেন তাতেও রয়ে যায় সত্যজিতের ছোঁয়া ।  ১৩৮২-র ফাল্গুন থেকে ১৩৮৩-র কার্তিক এবং ১৩৮৩-র অগ্রহায়ণ থেকে ১৩৮৪-র আষাঢ় পর্যন্ত ‘সন্দেশ’-এ ইন্সপেকটর বিক্রমের দুটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির কমিকস বের হয়। ছবি এঁকেছিলেন প্রতাপ মল্লিক আর কাহিনিকার ছিলেন আবিদ সুর্তি। মূল কাহিনি থেকে বাংলায় গল্পদুটির অনুবাদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ১৩৮৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত হয় উইনসর ম্যাককের ‘ড্রিম অফ রেয়ারবিট ফিল্ড’-এর বঙ্গানুবাদ ‘দুঃস্বপ্ন’। এই অনুবাদ এবং লেটারিং দুই-ই সত্যজিতের। একটু লক্ষ করে দেখলেই, ১৯৭৮-এ ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত উইনসর ম্যাককের কমিকস স্ট্রিপের ছবির প্রভাব, ১৯৭৯-এ ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমায় সত্যজিতের আঁকা ‘করাল কুম্ভীর’-এর প্রচ্ছদেও খুঁজে পাবেন! ১৩৮৫ বঙ্গাব্দেই ছাপা সুবীর রায়ের দুর্দান্ত কমিকস ‘কিসসা সাজাহান কা’-র নাম বদলে সত্যজিৎ করেন ‘শাহজাহানের আজব কথা’। ১৩৯১ বঙ্গাব্দের ‘সন্দেশ’-এ ছয় সংখ্যায় বেরিয়েছিল একটি বিদেশি কমিকস। বব দ্য মুর-এর সৃষ্ট ওই চরিত্রটিকে সত্যজিৎ রায় বানিয়েছেন “নন্দখুড়ো”। প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় নলিনী দাশের গল্প অবলম্বনে ওই ১৩৯১ বঙ্গাব্দেই ‘সন্দেশ’-এ ‘টোটোর অ্যাডভেঞ্চার’ নামের কমিকস আঁকেন। ‘সন্দেশ কমিকস সমগ্র’-এর সম্পাদকদের মতে –“এই চিত্রকাহিনিতেও রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের হাতের অদৃশ্য ছোঁয়া।”

আরও পড়ুন : কিশোর ক্লাসিকসের অনুবাদে সত্যজিৎ / সায়নদীপ গুপ্ত  

সাময়িক পত্রিকার জগতে, সম্পাদক এবং সম্পাদনার উৎকর্ষের সঙ্গে, পত্রিকার সর্বোচ্চ মানের একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক চিরকালই রক্ষিত হয়ে এসেছে। কতটা উৎকৃষ্ট ছিল সত্যজিতের সম্পাদিত ‘সন্দেশ’? সত্যজিতের ‘সন্দেশ’ প্রথম যেদিন বের হয়, সেই দিনই কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তীর হাত থেকে সে ‘সন্দেশ’ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। শৈলজানন্দের হাতফেরতা হয়ে টালা পার্কে তারাশঙ্করের হাতে সে ‘সন্দেশ’ পৌঁছাতে বেশি দেরি হয়নি।  শেষমেষ কত কসরত করে তারাশঙ্করের কাছ থেকে ‘সন্দেশ’-এর প্রথম সংখ্যা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। আর সঙ্গে একটা ছোট্ট স্বীকৃতি। ‘আনন্দমেলা’ সম্পাদনায় নীরেন্দ্রনাথের কাছে আজীবন আদর্শ ছিল সত্যজিতের সম্পাদিত ‘সন্দেশ’। 

...................................................

[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

#সত্যজিৎ রায় #নিবন্ধ সিরিজ #Satyajit Ray #Series #সম্পাদক #Editor #সন্দেশ #সুভাষ মুখোপাধ্যায় #হাত পাকাবার আসর #প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর #লুইস ক্যারল #সুকুমার রায় #উইলিয়াম হিথ রবিনসন #সন্দেশ-এর দিনগুলি #উজ্জ্বল চক্রবর্তী #সত্যজিৎ-ভাবনা #লীলা মজুমদার #মঞ্জিল সেন #রেবন্ত গোস্বামী #গৌরী ধর্মপাল #প্রণব মুখোপাধ্যায় #ময়ূখ চৌধুরী #নির্মাল্য কুমার ঘোষ #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

36

Unique Visitors

215004