ব্যক্তিত্ব

লড়েছিলেন নেতাজির পাশে দাঁড়িয়ে, অঞ্জন দত্তের গানের বাইরে রয়ে গেলেন যে বেলা বোস

তোড়ি সেন Sep 25, 2021 at 6:46 am ব্যক্তিত্ব

বেলা বোসের কাছে মিস্টার দত্তের ফোন আদৌ কোনও দিন পৌঁছেছিল কি না, তা আমরা জানি না। তবে যে রহস্যময়ী মেয়েটি বরাবর টেলিফোনের আড়ালেই রয়ে গেলেন, তাঁকে ভাবতে ভাবতে যৌবন কেটে গেছে অনেক বাঙালির। কিন্তু অনেক বাঙালিই হয়তো জানে না, বেলা বোস ছিলেন বাস্তবেও!

বাবা সুরেন্দ্রচন্দ্র বোস। সুভাষচন্দ্র বোসের বড়ো দাদা। সেই সূত্রে নেতাজির ভাইঝি মেয়েটি। ১৯৪১ সালে নেতাজি যখন অন্তরিন দশা থেকে পালিয়ে এলেন, সেই বিখ্যাত গৃহত্যাগে রীতিমতো সাহায্য করেছিল এই মেয়েটির ছোট বোন, ইলা। বোঝাই যাচ্ছে, দুই বোনের বেড়ে ওঠার সময়ে কাকার আদর্শ একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪০ সালে নেতাজি রামগড় কংগ্রেস ছাড়ার পরই বেলা ঠিক করে ফেলেন, এবার কাকার পাশে দাঁড়ানোর সময় এসে গেছে। আইএনএ তৈরি হল, ঝাঁসির রানি ব্রিগেডে যোগ দিলেন বেলা। তাঁর স্বামী হরিদাস মিত্রও আইএনএ-তে গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেন, পরে বিভাগের প্রধান পর্যন্ত হয়েছিলেন। আর বেলাকে পাঠানো হল কলকাতায়, আইএনএ-র স্পেশাল অপারেশনগুলোর তদারকি করার ভার দিয়ে। অন্যান্য জাতীয়তাবাদী শক্তি বা সমর্থক ব্যক্তিদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ গড়ে তোলা দরকার, সেই দায়িত্বও তাঁরই ওপর। এরকমই এক অপারেশনে, পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতে ফেরার সময় ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়ে যান হরিদাস মিত্র। তখন অভিযানের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন বেলা। দলের সকলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলা, তাঁদের নির্দিষ্ট স্থানে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করা, সমস্ত কিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন তিনি। অভিযান সফল হওয়ার পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল তাঁর। বহু গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবীকে তিনি নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর তার ব্যয়ভার সামলাতে অনায়াসে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের বিয়ের গয়না। 

দেখতে দেখতে ১৯৪৪ সাল। মিত্রশক্তি মরণকামড় দিচ্ছে। পালটা আক্রমণ জারি রেখেছে অক্ষশক্তি, যাদের মধ্যে রয়েছে বন্ধু দেশ জাপান। জিতে নেওয়া আন্দামান নিকোবরের ভূমিখণ্ডে আগের বছরের ৩০ ডিসেম্বর স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছেন নেতাজি। এই সময় আরও বেশি করে দরকার সাহায্যকারী শক্তিগুলির সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ রেখে চলা। কয়েকজন দক্ষ রেডিও অপারেটর এবং গুপ্তচর নিয়ে নিজস্ব ট্রান্সমিটার এবং রিসিভার বসিয়ে ফেললেন বেলা, যাতে ভারত ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে অবাধে যোগাযোগ রাখা যায়। পরবর্তী এক বছর ধরে এই পথে সমস্ত জরুরি খবরাখবর দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। আর কলকাতা থেকে একা হাতে এই পরিষেবা সামলেছিলেন বেলা। 

আরও পড়ুন : নেতাজিকে বাঁচাতে নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও পিছপা হননি নীরা আর্য / টিম সিলি পয়েন্ট 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাঁর স্বামী এবং আরও তিনজন যুদ্ধবন্দিকে তোলা হল আসামির কাঠগড়ায়। অভিযোগ, দেশদ্রোহ। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বেলা ছুটলেন পুনেতে, মহাত্মা গান্ধির কাছে। ভারতের তৎকালীন গভর্নর লর্ড ওয়াভেলকে মহাত্মা গান্ধির চিঠি পাঠিয়ে মৃত্যুদণ্ড রদ করালেন। যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা হল। দুবছর পর স্বাধীন ভারতে মুক্তি পেলেন হরিদাস মিত্র। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে বিধানসভার ডেপুটি স্পিকারও হন তিনি। বেলা কিন্তু সরে গেলেন রাজনীতির ময়দান থেকে। দেশভাগের কাঁটাতার তখন চিরে দিয়েছে ভারতকে। ভিটেমাটি হারিয়ে প্রাণ হাতে করে ওপার বাংলা থেকে কলকাতায় এসে পা রাখছে দলে দলে মানুষ। তাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করলেন তিনি। গড়ে তুললেন ঝাঁসির রানি রিলিফ টিম। বালি-ডানকুনি এলাকায় অভয়নগর অঞ্চলে তৈরি করলেন একাধিক রিফিউজি ক্যাম্প। নিজে সেখানে থেকে এই মানুষগুলির পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতেন। ১৯৫২ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই কাজই করে গিয়েছেন তিনি। 

আরও পড়ুন : ইতিহাসে উপেক্ষিত এক বীরাঙ্গনা : ঝলকারিবাই / কুনাল দাস 

এই মানুষদের নাম হারিয়ে গেছে ইতিহাসের কোনও ধূলিধূসর পাতার এক কোণে। নামের মোহ ছিলও না বেলা বোসের। না হলে, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর স্বামীর মতো তিনিও যোগ দিতে পারতেন কোনও রাজনৈতিক দলে, সম্মানজনক পদও পেতেন হয়তো। তার বদলে উদ্বাস্তুদের সাহায্য করার জন্য একা একা পথে পথে জীবন কাটিয়ে দিলেন বেলা বোস। তবে মৃত্যুর পর, ১৯৫৮ সালে তাঁকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে হাওড়া জেলার একটি স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে বেলানগর। মনীষীদের নামে রেলস্টেশনের নামকরণ করার পরম্পরা তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বটে, তবে তাঁরা সবাই ছিলেন পুরুষ। বেলা বোস-ই প্রথম ভারতীয় নারী, যাঁর সম্মানে পিতৃতান্ত্রিকতার সেই ঐতিহ্য ভেঙে ফেলেছিল ভারতীয় রেল।

........................... 


#Subhas Chandra Bose #Bela Mitra #Jhansi Rani Regiment #Indian National Army #বেলা মিত্র #নেতাজি #হরিদাস মিত্র #বেলা বোস #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

124

Unique Visitors

184214