লিঙ্গবৈষম্যের মোকাবিলায় পুরুষদের সংগঠন : দশ বছরে পা দিল উত্তরপ্রদেশের MASVAW
লিঙ্গবৈষম্য ও লিঙ্গহিংসার সমস্যা যখন ক্যান্সারের চেয়েও দ্রুত ছেয়ে ফেলেছে আমাদের সমাজকে। ভারতীয় উপমহাদেশের আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে উর্বর আবাদভূমি। তাই এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পৌঁছেও উঠে আসে ‘Me Too’-র মতো আন্দোলন। তবে কোনও অন্ধকারই বোধহয় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নয়। একটু না একটু আলোর আভাস সব অন্ধকারের পেটেই থাকে। তাই আমরা ‘Me Too’-র বিপরীতে ‘Not All Men’ মতবাদকেও মান্যতা পেতে দেখি। আসলে আমরা সকলেই জানি যে সব পুরুষ নির্যাতক নন। সংখ্যায় খুব কম হলেও, এমন পুরুষও আছেন যারা পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত, বা অন্তত মুক্ত হবার ইচ্ছা রাখেন। লখনউ শহরের এমনই কিছু প্রগতিশীল যুবক মিলে ২০১১ সালে তৈরি করেছিলেন নারী নির্যাতন-বিরোধী সংগঠন ‘Men’s Action for Stopping Viloence Against Women’ (সংক্ষেপে MASVAW)। পুরুষ হল পুরুষতন্ত্রের প্রাথমিক ধারক ও বাহক। ফলে পরিবর্তনের প্রাথমিক কাণ্ডারিও হতে হবে পুরুষকেই। এই ভাবনা থেকেই এমন একটি সংগঠন। ব্যতিক্রমী এই সংগঠন এ বছর দশে পা রাখল। এক দশক ধরে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পঞ্চায়েত ইত্যাদি জায়গায় MASVAW ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন লিঙ্গসাম্যমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করে আসছে।
MASVAW কোনও এনজিও নয়, তাঁদের নিজেদের ভাষায় এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন। তবে এটি তৈরি হয়েছিল ‘সহযোগ’ নামে লখনউয়ের একটি এনজিও-র হাত ধরে। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘সহযোগ’ বিভিন্ন নারীকল্যাণমূলক কাজ করে। এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তত্ত্বাবধানে ২০০১ সালে সারা বছরব্যাপী এক লিঙ্গহিংসা-বিরোধী কর্মসূচী নেওয়া হয়। শুধু লখনউ না, গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে পরিকল্পিত এই কর্মসূচীর নাম দেওয়া হয় ‘Hinsa Sehna Bandh’ (সংক্ষেপে ‘HISAAB’)। এই কর্মসূচীতে পুরুষ সদস্যরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিয়ে সমাজের নানা স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছতে গিয়ে HISAAB-এর সদস্যরা বুঝেছিলেন, লিঙ্গসাম্যের লক্ষ্যে এগোতে হলে একেবারে সামনের সারিতে পুরুষদের প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই কিছু পুরুষ সদস্য মিলে তৈরি করেন ‘MASVAW’। পুরুষদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকামী মনোভাব থাকে, তাকে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে আক্রমণ ও উৎপাটন করাকেই প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছে এই সংগঠন। আজ দশ বছর পেরিয়ে উত্তরপ্রদেশের ২০ টি জেলা জুড়ে বিস্তারিত হয়েছে তাদের কাজ। বহু সমাজকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক, সংবাদমাধ্যম-কর্মী ও ছাত্রছাত্রী এই সংগঠনের সদস্য। মুখ্য আহ্বায়ক সতীশ কুমার সিংহের কথায়, “MASVAW যদিও প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করার জন্যই, তবে ধীরে ধীরে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরুষদের অনুভূতি, আচরণ ইত্যাদিকে নারীদের অনুকূল করে তোলা। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি পুরুষ যাতে আরও দায়িত্ববান, আরও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন, বিষাক্ত পৌরুষের ধারণা যাতে তাদের আচ্ছন্ন না করে, সেটাই আমাদের আসল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে MASVAW-এর কাজ আসলে এক অর্থে মানুষ গঠনের কাজ।”
................................