ফিচার

লিঙ্গবৈষম্যের যুদ্ধে পরাজিত এক মেধা : গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রথম প্রবক্তা বিজ্ঞানী ইউনিস নিউটন ফুটের গল্প

অহনা বড়াল Dec 15, 2020 at 11:19 am ফিচার

ইতিহাসের শুকনো পাতায় সাফল্যের কাহিনিই লেখা থাকে শুধু। ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডকে ‘গাধা’ বলেছিলেন সাংবাদিক নেভিল কার্ডাস, কারণ সমস্ত গল্প তার জানা থাকে না। তেমনই ইতিহাস সব গল্প জানে না, বা মনে রাখে না। কত অন্যায়-অবিচার মেধা বা পরিশ্রমের পা টেনে ধরে নিশ্চিত সাফল্য থেকে দূরে সরিয়ে আনে, সে খবর ইতিহাস আমাদের দেয় না। আজকের গল্প এমনই একজন নারীর, লিঙ্গবৈষম্য যাঁকে প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে।

দিনটা ১৭ জুলাই, ১৮১৯। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট রাজ্যের লিচফিল্ড কাউন্টির এক ছোট্ট শহর গশেন্‌, জন্ম নিল এক ফুটফুটে মেয়ে – ইউনিস নিউটন ফুট্। ছয় বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা নিউইয়র্কের ব্লুমফিল্ডে। ১৮৩৬ সালে প্রথম স্কুলের পথে পাড়ি দেন ইউনিস। ‘ট্রয় ফিমেল সেমিনারি স্কুল’- নিউইয়র্কের ট্রয়ে অবস্থিত এই স্কুলই মেয়েদের জন্য নির্মিত প্রথম স্কুল (বর্তমানে এটি ‘এমা উইলার্ড স্কুল’ নামে পরিচিত)। এই প্রথম পুথিগত শিক্ষার আলো পেলেন ইউনিস, সাহচর্য পেলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী অ্যামস ইটনের। পাশেই ছিল এক সায়েন্স কলেজ। সৌভাগ্যবশত, ট্রয় সেমিনারির মেয়েরা সেখানে গিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সুযোগও পেয়ে গেলেন। এখানেই ইউনিসের সঙ্গে মৌলিক রসায়ন, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের প্রথম পরিচয় ঘটে। একইসঙ্গে বিজ্ঞানী আলমিরা হার্ট লিঙ্কন ফেল্পসের লেখা একটি পাঠ্যবই তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। ইউনিসের অপটু হাতে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, বিচার-বিশ্লেষণ। তিনি তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবনের নানান সময়ে বহুবার বিভিন্ন গ্যাসের ওপর সূর্যরশ্মির প্রভাব পরীক্ষা করেছেন। নতুন কিছু উদ্ভাবনের আশা নিয়েই ইউনিস একদিন পরীক্ষাগারে  হাতে নিলেন একটি বায়ু পাম্প, চারটি পারদ থার্মোমিটার এবং দুটি গ্যাস সিলিন্ডার। প্রথমে তিনি দুটো সিলিন্ডারে রাখলেন দুটো থার্মোমিটার। বায়ু পাম্প দ্বারা একটিকে তিনি বায়ুশূন্য করলেন এবং অন্যটি রইল বায়ুপূর্ণ। দুটি সিলিন্ডারকেই এরপর সম-পরিমাণ তাপ প্রদান করা হল এবং যোগ করা হল সামান্য পরিমাণ তরল (এক্ষেত্রে তিনি সাধারণ বায়ু, কার্বনিক অ্যাসিড [‘কার্বন-ডাই-অক্সাইড’ তখন কার্বনিক অ্যাসিড নামেই পরিচিত ছিল], হাইড্রোজেন ব্যবহার করেছিলেন) এবং সিলিন্ডার দুটিকে রেখে দেওয়া হল সূর্যের আলোয়। এরপর তিনি বিভিন্ন অবস্থায় তাপমাত্রার সুক্ষ্ম পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কার্বনিক অ্যাসিডই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ (১২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত) তাপ ধরে রাখতে সক্ষম। কার্বনিক অ্যাসিডের উপস্থিতিই যে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ায়, তার ধারণা প্রথম এই পরীক্ষা থেকেই পাওয়া যায়। 

শুধুমাত্র বিজ্ঞানের আঙিনাতেই নয়, ইউনিস নিজেকে মেলে ধরেছিলেন জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তাঁর প্রখ্যাত বন্ধু এলিজাবেথ ক্যাডির হাত ধরে, তৎকালীন সমাজের নানান উপেক্ষাকে দূরে সরিয়ে তিনি নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ‌ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং নিজেকে উপস্থাপিত করেছিলেন একজন Suffragist হিসাবে। এমনকি নারীদের ভোটাধিকারসহ রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে ১৮৪৮ সালে আয়োজিত ‘সেনেকা কনভেনশন ফলস’ নামক জন-সম্মেলনেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই আন্দোলনই ছিল নারীবাদের (Feminism) প্রথম ধাপ।  

এর পাশাপাশি তিনি ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন পরিবেশের ওপর গ্রিন হাউস গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব। হয়ে উঠেছেন ‘American Association for the Advancement of Science’র একজন নারী সদস্য। কিন্তু তৎসত্ত্বেও নিউইয়র্কের আলবেনিতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিজের গবেষণা পত্র প্রকাশ করতে চাইলেও অনুমোদন দিতে নারাজ ছিল কর্তৃপক্ষ। এর বহু বছর পর ১৮৫৬ সালের আগস্ট মাসে AAAS কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশ করার সুযোগ দিলেও তা উপস্থাপনার সুযোগ দেননি। ইউনিসের ‘Circumstances affecting the Heat of the Sun’s Rays’ শীর্ষক পত্রটি স্মিথসোনিয়ান প্রতিষ্ঠানের জোসেফ হেনরি সম্পাদনা করেন এবং লেখেন, “বিজ্ঞান কোন দেশ কিংবা নির্দিষ্ট লিঙ্গের জন্য নয়। নারীদের ক্ষেত্রেও এটি কেবল সুন্দর এবং দরকার ছাড়াও সত্যেকেই আলিঙ্গন করে।” এরপর তৎকালীন AAAS-এর বার্ষিক সাময়িকী প্রসিডিংসে তাঁর এই কৃতিত্বের কথা প্রকাশের জন্য নির্বাচিত হলেও পরে তা বাদ দেওয়া হয়। লিঙ্গবৈষম্যের কাছে হেরে যায় মেধা।

এর ঠিক ৩ বছর পর, ১৮৫৯ সালে আইরিশ বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল প্রায় এই একই গবেষণা পত্র প্রকাশ করে পান ‘আধুনিক আবহাওয়া বিজ্ঞানের জনক’ শিরোপা। যা তৎকালীন লিঙ্গবৈষম্যকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে তোলে। কিন্তু সত্য চাপা থাকে না। তাই তো প্রায় ১৫৫ বছর পর যখন পৃথিবীর থেকে ইউনিসের প্রায় সব চিহ্নই মুছে গেছে, তখন হঠাৎ করেই ‘Scientific Ladies’ শিরোনামের একটি বিশেষ কলামে সোরেনসন খুঁজে পান ইউনিসের কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানান - “কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো কিছু বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাস যে সৌরবিকিরণ করে তাপ উৎপন্ন করে- এ আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনিই প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী”। অর্থাৎ গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রথম প্রবক্তা তিনিই। এরই ফলে পরবর্তীতে ইউনিস ‘Mother of Climate Change’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। 

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা পেরিয়ে এসেছি নারীবাদের অনেকগুলো পর্যায়। আজও সমাজের বিভিন্ন স্তরে সমানাধিকার সোনার পাথরবাটির মতোই অলীক। ইউনিস তাই এক অবিনাশী যুদ্ধের নাম। 

তথ্যসূত্র : 

1. https://www.chemistryworld.com/culture/eunice-foote-the-mother-of-climate-change/4011315.article

2. https://www.nytimes.com/2020/04/21/obituaries/eunice-foote-overlooked.html

3. https://royalsocietypublishing.org/doi/10.1098/rsnr.2018.0066

4. https://en.wikpedia.org/wiki/Eunice_Newton_Foote


#বাংলা #ফিচার #ইউনিস নিউটন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219122