বিজ্ঞান, বক্ষআবরণী এবং মার্ক টোয়েনের উদ্ভাবনী ক্ষমতা
স্কুলের পড়া শেষ না করেই উপার্জনের রাস্তায় নেমে পড়তে হয়েছিল বালক ক্লিমেন্সকে। যখন মাত্র এগারো বছর বয়স, তখন পরিবারে দৈন্যদশা নেমে আসে। স্কুল ছেড়ে একটি ছাপাখানায় শিক্ষানবিশ হয়ে যোগ দেয় ক্লিমেন্স, তারপর থেকে সে বিভিন্ন শহরে ছাপাখানায় কাজ করেছে। ছাপাখানায় কাজ করলেও ক্লিমেন্সের ভেতরে ভেতরে প্রবল ইচ্ছা ছিল ‘স্টিম-বোট’-এর পাইলট হওয়া। তাই পড়াশোনা শুরু করল যাতে ‘স্টিম-বোট’-এ পাইলটের কাজ পাওয়া যায়। স্বপ্নপূরণও হল একদিন। স্টিম-বোটের চালক হতে পারল স্যামুয়েল ল্যাংহোর্ন ক্লিমেন্স।
নদীতে জলের গভীরতা মাপার একক ‘ফ্যাদোম’ (Fathom)। এক ফ্যাদোম মানে ছ-ফুট। স্টিমবোটের পাইলটরা ‘দুই’ বা ‘two’ না বলে ‘টোয়েন’ (twain) ব্যবহার করতেন। তাই ‘দুই ফ্যাদোমস্’ বোঝাতে পাইলটরা বলতেন - ‘বাই দ্য মার্ক টোয়েন’। জলের এই গভীরতা আসলে স্টিম-বোট চলাচলের পক্ষে নিরাপদ। ১৮৬১ সালে মার্কিন গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত ক্লিমেন্স স্টিম-বোটের পাইলট ছিলেন। তারপর অল্প কিছু দিনের জন্য সৈন্যদলে যোগ দিতে হয়। সেখান থেকে আবার মাইনিং শিল্পের কাজে যোগ দেন। পরের কর্মক্ষেত্র – খবরের কাগজের দপ্তর। এখানেই শুরু হল লেখালেখি। ক্রাইম, পলিটিক্স, মাইনিং এবং কালচার নিয়ে লিখেছেন একটির পর একটি প্রতিবেদন। খবরের কাগজে ক্লিমেন্স যখন কোনও কিছু লেখালেখি করতেন তখন ‘মার্ক টোয়েন’ নাম ব্যবহার করা শুরু করেন।
তখন থেকেই স্যামুয়েল ল্যাংহোম ক্লিমেন্সের পরিচয় ‘মার্ক টোয়েন’ এই ছদ্ম নামে। বলাই বাহুল্য, আসল নামের তুলনায়, ছদ্মনামের সঙ্গেই আমাদের বেশি পরিচিতি। মার্ক টোয়েন শুনলেই মনে পড়ে সাদা স্যুট পরা আর ঠোঁটে পাইপ কিংবা সিগার ধরা বিখ্যাত সেই ছবিটি। মার্ক টোয়েন (১৮৩৫ - ১৯১০) – বিশ্ববন্দিত আমেরিকান ঔপন্যাসিক। বিপুল জনপ্রিয় সাহিত্যিক এবং কৌতুকপূর্ণ কাহিনি রচয়িতা। যার ক্লাসিক উপন্যাস ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাক্লবেরি ফিন’ (১৮৮৪) এবং বহুল পরিচিত রচনা ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সোয়্যার’ (১৮৭৬)। উপন্যাস ছাড়াও তিনি লিখেছেন নানান ধরনের লেখা। জাতি, সাম্রাজ্যবাদ, শ্রমিক সমিতি, নারীবাদ নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছড়িয়ে আছে নানান লেখায়। স্পষ্ট বক্তব্য এবং সুতীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে তাঁর এই সব লেখায়। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিতর্কও কম হয়নি তাঁকে নিয়ে। অদ্ভুত মানুষ ছিলেন মার্ক টোয়েন। একটা সময় বাড়িতে উনিশটা বিড়াল পুষেছিলেন। প্রত্যেকটি বিড়ালের ছিল আলাদা আলাদা নাম। নিজের মৃত্যুর সময় আগাম বলে দিয়েছিলেন তিনি নির্ভুল ভাবে। ১৮৩৫ এর ৩০শে নভেম্বর যখন স্যামুয়েলের জন্ম হয়, তখন আকাশে হ্যালির ধূমকেতুর উদয় হয়েছিল। মার্ক টোয়েন পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন – এর পরের ধূমকেতু যখন দৃশ্যমান হবে তখন এই গ্রহ থেকে তাঁর নিজেরও চলে যাওয়ার সময় হবে। বস্তুত হয়েছিলও তাই, পঁচাত্তর বছর পরে ধূমকেতুর পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু হয়।
কিন্তু এহেন বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকের সঙ্গে বক্ষআবরণী বা ব্রেসিয়ারের কী সম্পর্ক! তাছাড়া এই ট্যুইটার-ইন্সটাগ্রামের যুগে মার্ক টোয়েনের অমর রসিক উক্তিগুলি নিয়ে যদিও বা মাতামাতি করা যায়, খামোখা বিজ্ঞানের প্রবন্ধে তাঁকে নিয়ে লিখতে হবে কেন?
লিখতে হল, কারণ মার্ক টোয়েনের জিনিয়াসের এই বিশেষ দিকটি আমাদের প্রায় অজানা। তাঁর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আধারিত লেখাগুলির সঙ্গে অনেকের পরিচয় নেই। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উদ্ভাবন ভাবনা তিনি তাঁর ফিকশনাল ও নন-ফিকশনাল রচনায় অসাধারণ মুনশিয়ানায় বুনে রেখেছেন। এই ব্যাপারে শুধু নিজেরই আগ্রহ নয়, সমসাময়িক আধুনিক লেখকদেরও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহ ও চর্চা করার জন্য উৎসাহিত করতেন মার্ক। মনে রাখতে হবে, তাঁর সময়কালে প্রযুক্তির অভিযাত্রার বিপুল পরিবর্তন হচ্ছে। সেই যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহের সঙ্গে মার্ক টোয়েন সেই পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন। বিবর্তন নিয়ে বিতর্ক শুনছেন, ডারউইন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের লেখা বই পড়ছেন; ভূতত্ববিদ্যা, প্রত্নবিদ্যা, ইতিহাস, পতঙ্গ নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানপিপাসা মেটাচ্ছেন। আর এই অভিজ্ঞান তাঁর লেখালেখিতে প্রতিফলিত হয়েছে। যেরকম আমরা দেখেছি, ফরেনসিক টেকনিকসের ‘ফিঙ্গারপ্রিন্টিং’-এর ব্যবহার তাঁর রচনাতে জায়গা করে নিচ্ছে। পরীক্ষানিরীক্ষায় অংশ নেওয়া এবং সমসাময়িক প্রযুক্তিতে লগ্নি করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন দারুণ উৎসাহী। টাইপ রাইটারের সূচনাপর্বে এবং টেলিফোন প্রযুক্তিতে তিনি আগ্রহী হন এবং লগ্নি করেন; যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসফল হয়েছেন এবং অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় দারুণ ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। মার্ক টোয়েনের নিজের বাড়িতে যে টেলিফোনটি ছিল তা তাঁর কথানুযায়ী ছিল প্রথম টেলিফোন। তিনি একদিকে যেমন নিকোলা টেসলার সঙ্গে সখ্য বজায় রেখেছিলেন, তেমনি এক বিপরীত মেরুর মানুষ টমাস এডিসনের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন। এডিসনকে নিজের ভয়েস রেকর্ড করা এবং তাঁকে নিয়ে ফিল্ম করার অনুমতি দিয়েছিলেন মার্ক টোয়েন। টোয়েনের বন্ধু খুব বেশি ছিল না। নিকোলা টেসলা ছাড়াও তাঁর সঙ্গে হেলেন কেলারের খুব ভালো সখ্য গড়ে উঠেছিল। চৌত্রিশ বছর বয়সী নিকোলা টেসলার সঙ্গে পঞ্চান্ন বছরের মার্ক টোয়েনের বন্ধুত্বের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার। বিংশ শতাব্দীর একজন জিনিয়াস এবং বিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ও উদ্ভাবক ছিলেন টেসলা। বস্তুত তাঁর আবিষ্কার পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পৃথিবীর মানুষ আজও টেসলাকে মনে রেখেছে ‘অলটারনেটিং-কারেন্ট’ (এ.সি-কারেন্ট) সিস্টেমের রূপকার হিসেবে। তিনিই ‘ইলেকট্রিক মোটোর’-এর আবিষ্কর্তা। টোয়েন প্রায়-ই নিকোলা টেসলার কর্মক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে উঠতেন, এমনকি টেসলার পরীক্ষানিরীক্ষাতেও অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকবার। মার্ক টোয়েন যখন শয্যাশায়ী, তখন তাঁর তীব্র হতাশার সময় পাশে থেকেছেন টেসলা। মার্ক টোয়েনের সঙ্গে পরিচয়ের এক দশক আগে থেকেই তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন নিকলা টেসলা। একটা সময় কঠিন অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করছিলেন টেসলা। সে সময় মার্ক টোয়েনের প্রথম দিকের লেখাগুলির সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। পরবর্তী সময়ে সে কথা যখন বলেছেন, চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি মার্ক টোয়েন। ১৮৯০ এর দশকে দুজনের মধ্যে যে সখ্য গড়ে ওঠে তা মার্ক টোয়েনের মৃত্যু (১৯১০) অবধি অটুট ছিল। টোয়েনের মেয়ের বিয়েতে নিকোলা টেসলা উপস্থিত ছিলেন। কবি শিল্পী আর সাহিত্যিকদের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের সহযোগের দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। তাই টেসলার সঙ্গে মার্ক টোয়েনের এই সখ্য বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মেলবন্ধনের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
আরও পড়ুন : রাসায়নিক সন্ত্রাস: যুদ্ধকামী লোলুপতার আরেক পরিচয় / রাহুল দত্ত
মার্ক টোয়েন যে একজন উদ্ভাবকও ছিলেন সে কথা আমরা অনেকেই জানি না। বস্তুত মার্ক টোয়েনের নামে মোট তিনটি পেটেন্ট ছিল। তবে এই পেটেন্টগুলি মার্ক টোয়েন নামে নয়, করা হয় তাঁর আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহোর্ন ক্লিমেন্স নামে। আজ থেকে একশ পঞ্চাশ বছর আগে ১৮৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি আমেরিকান পেটেন্ট গ্রান্টেড হয়। যার টাইটেল ছিল – ‘ইমপ্রুভমেন্ট ইন অ্যাডজাস্টেবেল অ্যান্ড ডিটাচেবল স্ট্রাপস ফর গারমেন্টস’। ইনভেন্টার হিসেবে দু জনের নাম ছিল তাতে। যাদের একজন হলেন স্যামুয়েল ল্যাংহোম ক্লেম্যান বা মার্ক টোয়েন, পেটেন্ট নাম্বার (ইউ এস-এ -১২১৯৯২)। যদিও পেটেন্টে কোথাও মহিলাদের পরিধানের উপযোগী পোশাকের কথা বলা ছিল না। তবে ছবিতে বক্ষআবরণীর ব্যবহার দেখানো হয়েছিল। পেটেন্ট দরখাস্তে উল্লেখ করা ছিল – এই স্ট্র্যাপ ভেতরে পরার গেঞ্জি, পাৎলুনের কোমরে লাগানোর জন্যে অথবা অন্যান্য জামাকাপড় শরীরে ঠিকঠাক টাইট ফিটিং করার উপযোগী। প্যান্টে গ্যালিস লাগানোর প্রয়োজন পড়বে না। যদিও এই জিনিস পরবর্তী সময়ে গেঞ্জি বা প্যান্টের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে দেখা যায়নি। কারণ তখন টাইট করার জন্যে বেল্টের ব্যবহার-ই বেশি হত। কিন্তু মার্ক টোয়েন উদ্ভাবিত এই স্ট্র্যাপ আধুনিক ব্রেসিয়ারের ক্ষেত্রে আজও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী উদ্ভাবকের সঙ্গে আইনগত জটিলতার জন্যে মার্ক টোয়েন ‘গারমেন্ট স্ট্র্যাপ’-এর উৎপাদন কখনই করতে পারেননি। বক্ষ আবরণীর সূচনা বহু প্রাচীন কাল থেকেই। ইজিপ্ট, গ্রীস বা ভারত প্রভৃতি দেশে একটু সম্ভ্রান্ত মহিলারা বস্ত্র টুকরো দিয়ে নানান ভাবে বক্ষ আবরণী তৈরি করে নিতেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞান সম্মত বক্ষ আবরণী উদ্ভাবিত হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে এক-দু দশক পরে পরেই অধিক উন্নত ধরনের বক্ষ আবরণী উদ্ভাবন হয়েছে। টোয়েনের আরও দুটি পেটেন্ট স্বীকৃত হয়েছিল। একটি ‘সেলফ-পেস্টিং স্ক্র্যাপ বুক’ তথা ‘আ স্ক্র্যাপবুক উইথ প্রি-গামড পেজেস’ (১৮৭৩), যা কিনা আমাদের স্টিক-প্যাডের পূর্বপুরুষ! আর অন্য পেটেন্টটি ‘হিস্ট্রি ট্রিভিয়া গেম’ (১৮৮৫) - ‘বোর্ড গেম টু টিচ হিস্ট্রিক্যাল ডেটস অ্যান্ড অ্যাক্টস’ তথা ইতিহাসের ঘটনার সাল তারিখ মনে রাখার একধরণের ‘মেমোরি-গেম’। তবে একমাত্র ‘সেলফ-পেস্টিং স্ক্র্যাপ বুক’ পেটেন্টটিই সাফল্যের মুখ দেখেছিল কয়েক দশক ধরে। এছাড়াও আরও একাধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থ ঢেলেছিলেন, কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই অসফল হন। এতে তাঁর লগ্নির বিপুল পরিমাণ টাকা নষ্ট হয়েছিল।
সম্ভবত মার্ক টোয়েন সেই সময়কার কতিপয় উল্লেখযোগ্য মানুষের একজন, যাঁদের পেটেন্ট সিস্টেমের উপর গভীর আস্থা ছিল। তাই তিনি তাঁর অফিস প্রশাসনে শুরু থেকেই পেটেন্ট অফিস শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কোনও দেশের যদি উপযুক্ত পেটেন্ট অফিস এবং ভালো পেটেন্ট আইন না থাকে সে দেশ পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। সাহিত্য, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে ইতিহাসে মার্ক টোয়েনের মতন চরিত্র শুধু বিরলই নয়। আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
..................................