রাসায়নিক সন্ত্রাস: যুদ্ধকামী লোলুপতার আরেক পরিচয়
........................
অফিসটাইমের ভিড়ঠাসা মেট্রো প্রবলবেগে ছুটে চলেছে সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎই এক যাত্রীর হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল হলদে-সাদা তরলে ভর্তি একটি কাঁচের বোতল; মেট্রো যখন পরের স্টেশনে পৌঁছল, দেখা গেল, অধিকাংশ যাত্রীই তখন মৃত। কেউ বা অচেতন, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। হিন্দি ছায়াছবি ‘কাহানি’-র এই দৃশ্য দেখে এক মুহূর্তের জন্য হলেও দর্শকদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল, গুলিয়ে গিয়েছিল reel ও real-এর তফাত। আসলে যা আমাদের অগোচর, সতর্ক হওয়ার আগেই যা অতর্কিতে আমাদের প্রাণসংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তারই প্রভাবে আমরা সবচেয়ে বেশী ভীত হই, অসহায় বোধ করি। রাসায়নিক অস্ত্র ঠিক এইরকমই।
পারমাণবিক এবং জৈব অস্ত্রের মতো Weapons of Mass Destruction (WMD) শ্রেণীভুক্ত আরও একটি মারাত্মক অস্ত্র হল রাসায়নিক অস্ত্র। এতটাই মারাত্মক যে, এই অস্ত্রের ব্যবহারের ওপর রাশ টানতে ১৯৯৩ সালে Chemical Weapon Convention (CWC)-এর মাধ্যমে রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ, উৎপাদন, গবেষণা এবং মজুত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷ কিন্তু CWC-র নিয়মের ছিদ্রগুলির সুযোগ নিয়ে অনেক দেশই রাসায়নিক অস্ত্রের গবেষণা এবং উৎপাদন চালিয়ে যেতে থাকে৷ যে কোনও বিষাক্ত এবং প্রাণঘাতী রাসায়নিক তরল বা গ্যাসই রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। লক্ষ্যবস্তুতে যাতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারে সেইজন্য এই রাসায়নিকগুলিকে ব্যবহার করা হয় আর্টিলারি শেল, ল্যান্ডমাইন, গ্রেনেড, মিসাইল, মর্টার, স্প্রে-ট্যাঙ্ক প্রভৃতির সঙ্গে৷ মজার কথা হল, কার্যোপযোগী রাসায়নিক অস্ত্র হতে গেলে কোনও রাসায়নিক শুধুমাত্র মানবদেহে বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হলেই হয়না, অস্ত্র হিসেবে তার প্রয়োগের প্রক্রিয়াও সহজ হতে হয়। বিস্ফোরণের মাধ্যমে ছড়ানো হলে বিস্ফোরণে উদ্ভূত তাপ সহ্য করার জন্য রাসায়নিকটির তাপসহনশীলতাও উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি, রাসায়নিকটি ছড়িয়ে পড়ার পর যাতে উপযুক্তভাবে নিজের কার্যকারিতা দেখাতে পারে সেইজন্য জল এবং অক্সিজেনের প্রতিরোধীও হওয়া প্রয়োজন।
আধুনিক সমরাস্ত্র হিসেবে রাসায়নিক অস্ত্রের সর্বপ্রথম ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯১৫ সালের ২২শে এপ্রিল, বেলজিয়ামের ওয়াইপ্রেসের সেনাছাউনির কাছে হঠাৎই সবুজাভ-হলুদ রঙের এক অদ্ভুত কুয়াশা দেখে ফরাসী সেনারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই শুরু, এরপর ধীরে ধীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরপর্তী পর্যায়ে ঠান্ডা যুদ্ধ, ভিয়েতনাম-যুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ে রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এ যাবৎ ব্যবহৃত রাসায়নিক অস্ত্রগুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন – Choking agent (শ্বাসরোধী), blistering agent (ক্ষতসৃষ্টিকারী), nerve agent (স্নায়ু-অবশকারী), Incapacitant (পক্ষাঘাতসৃষ্টিকারী), riot controlling agent (দাঙ্গা-নিয়ন্ত্রক) এবং Herbicide (আগাছানাশক)৷ Choking agent-এর ব্যবহার প্রথম করে জার্মান সেনারা৷ এরপর অক্ষশক্তি এবং মিত্রশক্তি উভয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে ক্লোরিন, ফসজিন, ডাই-ফসজিন, ক্লোরোপিক্রিন ইত্যাদি choking agent-এর ব্যবহার করতে থাকে। ফলত, যুদ্ধক্ষেত্রে দুইপক্ষের সেনাদের মধ্যেই আত্মরক্ষার্থে গ্যাসমুখোশ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ শতাংশই মূলত ফসজিন (choking agent) ব্যবহারের ফলে ঘটে৷ নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করেই এরা প্রতিরোধী ক্ষমতাকে উত্তেজিত করে ফুসফুসে ফ্লুইড জমায়। এর ফলে শ্বাসরোধের দরুণ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অন্যদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বহুল ব্যবহৃত একটি blistering agent হল মাস্টার্ড গ্যাস। এই গ্যাস আক্রান্তের দেহের চামড়া, চোখ, শ্বাসনালী, এমনকি ফুসফুস অবধি পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। Blistering agent-গুলির মধ্যে মূলত ফসজিন এবং মাস্টার্ড গ্যাস থেকে বাঁচতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্যাস-মুখোশের ব্যবহার বাড়তে থাকে। এছাড়াও ছিল হাইড্রোজেন সায়ানাইড এবং সায়ানোজেন ক্লোরাইডের মতো blood agent-গুলি। এদের বিষবাষ্প দেহের সবাত-শ্বসনে অংশগ্রহণকারী উৎসেচকগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে৷ ফলে রক্তে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়, যা ক্রমশ মস্তিষ্ক এবং হৃদযন্ত্রকে বিকল করে দিতে পারে।
আরও পড়ুন : জিন নিয়ে কারিকুরি, খোদার উপর খোদকারি? / সায়নদীপ গুপ্ত
তবে এসবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাণঘাতী হল nerve agents। আমাদের শরীরের প্রতিটি ক্রিয়া, অঙ্গ-সঞ্চালন, অনুভূতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয় স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা। Nerve agent-গুলি ত্বক বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে মস্তিষ্কের যেসকল স্নায়বিক কেন্দ্র এই ক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেইগুলিকে বিকল করে দেয়। বিষক্রিয়ার ফলে মিউকাস দ্বারা শ্বাসপথ রুদ্ধ হওয়া, দৃষ্টিশক্তির অবনতি, এমনকি পক্ষাঘাত হওয়ার মতো পরিণতিও হতে পারে।
১৯৩০-এর মাঝামাঝি জার্মান রাসায়নিক গবেষণাকেন্দ্র IG Farben-এ গবেষণাকালীন রসায়নবিদরা প্রথম একপ্রকার অর্গানোফসফোরিক যৌগ খুঁজে পান যা মারাত্মক বিষক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম। এটি পরিচিত ছিল Tabun নামে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাদের প্রায় ১২০০০ টন Tabun মজুত করার কথা জানা যায়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের সময় নাৎসি জার্মানির হিটলার-ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী অ্যালবার্ট স্পিয়ার স্বীকার করেন, বার্লিনের ফুয়েরারবাঙ্কার ভেন্টিলেশন শ্যাফ্টে টাবুন প্রয়োগ করে হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনার কথা। এরপর ১৯৩৮ সালে সারিন এবং ১৯৪৪ সালে সোমান নামক দুটি ভয়াবহ nerve agent জার্মানিতে তৈরি হওয়ার কথা জানা যায়। এই তিনটিকে একত্রে বলা হত “G Series Nerve Agents”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে মিত্রশক্তি প্রচুর পরিমাণে এই “G Series Nerve Agents” বাজেয়াপ্ত করে। এছাড়াও ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদরা “V Series Nerve Agents” তৈরি করেন। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন সরকারিভাবে রাসায়নিক অস্ত্রের গবেষণায় ইতি টানলেও সেই কৌশলই আয়ত্ত করে পরবর্তীকালে বিভিন্ন পর্যায়ে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের “V Series Nerve Agents” উৎপাদন এবং ব্যবহারের কথা জানা যায়। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম ভয়ঙ্কর নিদর্শন হয়ে আছে টোকিও-র সাবওয়েতে শোকো আসাহারা নামের এক ব্যক্তি কর্তৃক সারিন প্রয়োগের ঘটনাটি।
আসাহারা ছিলেন ওউম শিনরিকিও নামের একটি সংগঠনের নেতা এবং তার প্রবর্তকও বটে৷ নিজের ভবিষ্যৎবাণীকে বাস্তবায়িত করতে তিনি নাশকতার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার, এমনকি পারমাণবিক বিস্ফোরণেরও পরিকল্পনা করেন৷ আর সেই সম্পর্কিত পুলিশি তদন্তকে আটকাতেই ১৯৯৫ সালে টোকিও-র সাবওয়েতে তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা সারিন প্রয়োগ করলে প্রায় ১৩ জন প্রাণ হারান, অসুস্থ হয়ে পড়েন বহু৷ সব মিলিয়ে এই ঘটনার ভয়াবহতা হার মানিয়ে দিতে পারে অতিপরিচিত ভারতীয় ওয়েব-সিরিজ Sacred Games-এর চিত্রনাট্যকেও।
এছাড়া সাম্প্রতিক-কালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও আসাদ-সরকারের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ ওঠে সারিন, ক্লোরিন এবং সালফার মাস্টার্ড জাতীয় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের। এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে Dioxin বা Agent Orange-এর কথাও৷ Agent Orange বা Dioxin হল প্রকৃতপক্ষে একইসঙ্গে একধরনের আগাছানাশক (herbicide) এবং পত্রমোচনকারী (defoliant) রাসায়নিক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভিয়েত কং এবং উত্তর ভিয়েতনামের সেনারা জঙ্গলে লুকিয়ে গেরিলাযুদ্ধের পন্থা নেয়। এই রণকৌশলের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে আমেরিকান সৈন্যরা আকাশপথে সেই জঙ্গলগুলির ওপর Agent Orange বা Dioxin স্প্রে করতে থাকে। ফলত, বনভূমির এক বিশাল অংশ তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই, উপরন্তু এর ভয়ঙ্কর এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে মানবজীবনের ওপর। Centers for Disease Control and Prevention-এর একটি গবেষণা থেকে এই Agent Orange ব্যবহারের ফলে বহু মানুষের জন্মগত শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি, পঙ্গুত্ব, এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়।
খুব বেশি দিন নয়, একেবারে হালের ২০২০-তেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিপক্ষ অ্যালেক্সেই নাভালনি’র ওপর “নভিচক” নামক এক ভয়ঙ্কর নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করার কথা জানা যায়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেমিস্ট-রা এই “নভিচক” উদ্ভাবন করেন। ভয়ঙ্কর এই নার্ভ এজেন্টটি অ্যাসিটাইলকোলিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্নায়ু-উদ্দীপনা পরিবহনকে ব্যাহত করে। ২০১৮ সালে স্ক্রিপাল-কাণ্ডের সময় “নভিচক”-এর ব্যবহার সর্বসমক্ষে আসে। ব্রিটেনে থাকাকালীন রাশিয়ান গুপ্তচর সের্জেই স্ক্রিপাল-এর ওপর “নভিচক” দিয়ে আক্রমণ করা হলে স্ক্রিপাল এবং তাঁর কন্যা ইউলিয়া-সহ আরও চার জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েকদিন পর স্ক্রিপাল এবং ইউলিয়া সুস্থ হয়ে উঠলেও মারা যান বাকিদের একজন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভারত ১৯৯৩ সালে Chemical Weapon Convention (CWC)-এর চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে তার রাসায়নিক অস্ত্রের ভাণ্ডার একটু একটু করে নষ্ট করতে থাকে। ২০০৯ সালের মধ্যেই ভারত তার মজুত করা সালফার মাস্টার্ডের পুরোটাই বিনষ্ট করে দক্ষিণ কোরিয়া এবং আলবেনিয়ার সঙ্গে তৃতীয় দেশ হিসাবে নিজেদের মজুত করা রাসায়নিক অস্ত্রের ভাণ্ডার শূন্য করার স্বীকৃতি পায়। জৈব অস্ত্রের মতো রাসায়নিক অস্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রয়োগকারী নিজে সম্পূর্ণ অগোচরে থেকে যেতে পারে, তাই যে কোনও অত্যাচারী সরকারের কাছে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ দমনের এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বা গুপ্তসমিতিগুলির নিজেদের কার্যসিদ্ধির অন্যতম প্রধান উপায় হল রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ। রাসায়নিক অস্ত্র এবং রাসায়নিক-সন্ত্রাস একসঙ্গে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটানোর ক্ষমতা রাখে, মানুষকে করে তোলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য। সুতরাং শুধুমাত্র রাষ্ট্রনেতাদের বৈঠক কিংবা চুক্তিপত্র স্বাক্ষর নয়, একমাত্র মানুষের সদিচ্ছা এবং শুভবুদ্ধিই পারে এই মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে।
...........................
#Chemical Weapon # toxic chemicals #sarin #chlorine #hydrogen cyanide #রাসায়নিক অস্ত্র #মারণাস্ত্র #Chemical Weapon Convention #Weapons of Mass Destruction #Choking agent #blistering agent #nerve agent #soko asahara # sarin-gas attack on the Tokyo subway #রাহুল দত্ত #সিলি পয়েন্ট