বল্লভপুর নিয়ে বলার কথা
'বল্লভপুরের রূপকথা' সিনেমার কথা বলতে গেলে শুরু করতে হয় সিনেমার টিজার থেকে। দেড় মিনিটের টিজারটি একটি ঘোষণা মাত্র। ঘোষকের (পরিচালকও বটে) কণ্ঠটি বাঙালি দর্শকের কাছে এখন সুপরিচিত। টিজারে নিজের ছবির কথা ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বারবার বাধাপ্রাপ্ত হন ও শেষে রঘুদা নামে কারোর প্রতি মৃদু অভিযোগ জানান। এখানে দর্শকের জন্য গোটা গল্পের প্লট পয়েন্টের ক্লু ছড়িয়ে দিচ্ছেন পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য। সিনেমার ক্লিপ ব্যবহার করছেন, অথচ তার আখ্যানের কোনও সুস্পষ্ট ছাপ রাখছেন না টিজারে। বরং টিজারে দেখানো হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গল্প। পরিচালক অনির্বাণের ঘোষণার গল্প। এমন টিজার বাংলায় প্রথম। এই টিজারই বুঝিয়ে দিয়েছিল, এ ছবিতে কিছু নতুন ঘটতে চলেছে।
মোদ্দায় গল্পটা নতুন নয়। শুধু ১৯৬৩-৬৪তে লেখা বলে বলছি না। লেখাটির কাঠামো তিরিশের দশকের সিনেমার ছায়া অবলম্বনে বলেও বলছি না। এই ছবির ফর্মুলাটি নতুন নয়। হাসি + বাড়ি-বেচা + ভূত + প্রেম = হিট ছবি - এই সমীকরণ নিয়মিত না হলেও কয়েক বছর অন্তর বাংলা বাজারে ফিরে আসে এবং সে ছবি চলেও। এর প্রমাণ ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। তাই বেশ কয়েকটি গল্পের মধ্যে থেকে যখন এসভিএফ বাদল সরকারের নাটকটিকে বেছে নেন তখন বোঝা যায়, উপরোক্ত ফর্মুলায় বিশ্বাস তাঁদেরও। নির্দেশক অনির্বাণ ভট্টাচার্য বড়পর্দায় নতুন। মন্দারের ভারতজোড়া খ্যাতি সত্ত্বেও তা বড় স্ক্রিনে দেখার সুযোগ মেলেনি। 'বল্লভপুরের রূপকথা' ছবিটি বড়পর্দার মায়াজালকে ব্যবহার করে বারবার। ফাঁকা মাঠের মাঝে একটা প্রাচীন রাজবাড়ি, বা খোলা মাঠে একজন বহুরূপী শিব শূন্যতা ও একাকিত্বের অভিঘাত তৈরি করে, যা এই আখ্যানের অন্তরেই আছে। একাকীত্ব রঘুদা, ভূপতি, মনোহর, তিনজনের চরিত্রে মধ্যেই রয়েছে। তাদের নিয়েই বল্লভপুরের রাজবাড়ি। তাদের জীবনের একাকীত্ব আর মাঠের মাঝে একলা বাড়ি - চরিত্রের পরিপূরক হয়ে ওঠে বড় ক্যানভাসের দৃশ্যগুলি। একই সঙ্গে রাজবাড়ির ভিতরে দুই ধরনের শেড চরিত্রগুলিকে রিলিফের কাজের মতো হাইলাইট করে। পর্দায় আনতে গিয়ে বাদল সরকারের যে কথাগুলো ছাঁটাই করা হয়েছে, চিত্রনাট্যের সুবিধার্থে তার নির্যাসই দৃশ্যকল্প হিসাবে ফুটে উঠেছে। ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলিও নাটকের দীর্ঘ সংলাপকে সহজ করে দৃশ্যে অনুবাদ করা। কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকে এতক্ষণের রঙের জাদু কোথাও ফিকে হয়। গল্প বলার স্বাভাবিক ছন্দটা কেটে যায় কৃত্রিম পর্ব-বিভাজনেও। অনির্বাণীয় নির্মাণের ছাপ বলা যেতে পারে এই পর্ব ভাগ বিষয়টিকে। মঞ্চে, ‘চৌমাথা’ ও ‘পন্তু লাহা’ নির্মাণেও এই পর্ব ভাগ ব্যাপারটি সুস্পষ্ট ভাবে ছিল। এখানেও ফিরে এসেছে।
আরও পড়ুন : ডার্লিংস : 'ভালোবাসা'-র পাশেই যেসব অসুখ শুয়ে থাকে / রোহন রায়
এই ছবি ভয়ের। তবে তার চেয়েও বেশি হাসির। পরিচালক আরও ভয় পাওয়াতে পারতেন, কিন্তু তিনি মন দিয়েছেন হাসির দিকে। কোনও অলৌকিক বাড়াবাড়ির ধার ধারেননি। তবে ভয় পাওয়ানোর টাইমিং ও কমিক টাইমিং প্রায় বিরাট কোহলি-পর্যায়ের নিখুঁত। কিছু ক্ষেত্রে পরিচালকের, কিছু ক্ষেত্রে অভিনেতাদের। শ্যামল চক্রবর্তীর বালিশ হাতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি ভূত দেখানোর বাবা! সুমন্ত রায়ের ‘হেই হপ’ অনেকের দীর্ঘদিন মনে থেকে যাবার কথা। আবার তেমনই বল্লভপুরের রাজবাড়ির অবস্থা বর্ণনাকালীন ছবি খসে পড়া যেন দৃশ্যটিকেই পাঞ্চলাইন বানিয়ে দেয়। অভিনেতারা সকলেই বেশ প্রাণবন্ত। বিশেষত দেবরাজ ভট্টাচার্য সঞ্জীব চরিত্রে মারকাটারি। ছবির নায়ক-নায়িকা বাকিদের তুলনায় পেলব। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। এই ছবিটার আসল স্বাদের সমস্তটাই দলগত সাফল্যের সঙ্গে বাঁধা।
আরও
পড়ুন : স্বজাতিবিদ্বেষের
গভীর অসুখ : নুহাশ হুমায়ুনের ‘ফরেনার্স ওনলি’ / বিপ্রনারায়ণ
ভট্টাচার্য্য
সুশ্রাব্যও বটে এই সিনেমা। শুধু সংলাপ নয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর গানও বেশ শাণিত। সংলাপের ক্ষেত্রে বাদল সরকারের মূল লেখাকেই অধিকাংশ জায়গায় অনুসরণ করা হয়েছে। কিছু প্রয়োজনীয় বদল ঘটিয়েছেন প্রতীক দত্ত ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আর শুভদীপ গুহ ও তাঁর দলবল বাংলা মঞ্চের পর পর্দায় মিউজিক করতে এসেও নতুন-নতুন কীর্তি গড়ছেন। জায়গায়-জায়গায় খমকের আওয়াজ পিলে চমকে দেয়। একই শব্দ আবার হাসির খোরাকও তৈরি করে দেয় নিমেষের মধ্যে। নানা ধরনের যন্ত্র ও কণ্ঠ ব্যবহারে বল্লভপুরের রূপকথায় একটা মিউজিকাল জার্নি তৈরি হয়। যে-তিনটি গান এই ছবিতে আছে, তিনটিই নাটক-বহির্ভূত। তিনটি গানের মাঝেরটিকে নিয়ে আগে কথা বলে নিই কারণ ওই গানটিই বেশ কিছুক্ষণ মূল ছবির মধ্যে আছে। গানের রচয়িতা অনির্বাণ দক্ষ কবি। সুন্দর কথায় আর সুরে, বাড়ি গোছানোর দৃশ্যে এই গানটি বাড়ি থেকে নারী সবকিছুকে একসূত্রে বেঁধে ফেলতে সাহায্য করেছে। নাটকে নায়িকার আগমন ঘটে সরাসরি বাড়ির মধ্যে। সেখানেই দর্শক প্রথম তাকে দেখে, কিন্তু এখানে তার সঙ্গে দর্শকের আলাপ বাড়ির বাইরে, এই গানের মাধ্যমে। নায়িকাকে স্ক্রিনে প্রথম দেখা যাচ্ছে, একটু গান না হলে চলে!
প্রথম গানটি 'বাদল সরকারের গান', যে গানে কার্টুনে গোটা ছবি তৈরির ইতিহাস বর্ণিত হয়। সঙ্গে বাদল-বন্দনা। আর শেষ গানটিকে বলা যায় বল্লভপুর থিম সং। গানদুটির কথা ও সুরের মজবুত গাঁথনি দর্শকের দরবারে গল্পটির যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করে। গল্পের শেষে একটা যুতসই উপসংহারও জুড়ে দেয়। শেষ গানে এন্ড-ক্রেডিট দেখানোর সময়, থিয়েটারের শোয়ের শেষে কার্টেন কলের মতো সবাই আসেন। ডিরেক্টরও আসেন। বসেন তাঁর চেয়ারে। চেয়ারটি ভেঙে পড়ে যায়। এই দুটি গানের কন্টেন্টই একটা টিমকে স্পটলাইটের তলায় আনে। একক ব্যক্তিকে নয়, তিমকে ফোকাস করা হয়। এটা আসলে থিয়েটারের স্পিরিট। যা মঞ্চ হয়ে বড়পর্দায় নির্দেশনা দিতে এসে লেশমাত্র কমতে দেননি অনির্বাণ। এইটাই 'বল্লভপুরের রূপকথা'-র বিষয়ে বলার মতো সবচেয়ে জরুরি কথা। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফর্মুলা পাল্টানোর কথা বলেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ব্যক্তিসর্বস্বতা থেকে দলগত ভাবনা। একা অনির্বাণ নন, প্রতীক দত্ত, শুভদীপ গুহ, সৌমিক হালদার আরও অনেকে মিলে একসঙ্গে এই কথাটাই বলার চেষ্টা করেছেন। এই একটা নতুন ফর্মুলা তো চোখে পড়ছে। অনির্বাণ ভট্টাচার্য একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'ধরুন শ্রীকান্ত মোহতাজি যে চোদ্দটা ডিরেক্টরকে বলছে, তু ফিল্ম বনা, তু ইয়ে বনা, তু ও বনা, তার কাছে তো টাকা আছে। আর সে কেন টাকা ঢালবে, কেননা সে রিটার্ন পাবে।' (আত্মসন্ধানে মগ্ন এক অভিনেতা : মুখোমুখি অনির্বাণ ভট্টাচার্য, কথোপকথনে মলয় রক্ষিত, রঞ্জন কুমার ভৌমিক, পরম্পরা, ২০১৭)।
টলি বাজারে নতুন ফর্মুলা পরীক্ষার ফল মিলবে, হলে কতদিন এ ছবি হলে চলে তার উপর। বক্স অফিস রিটার্নের উপর। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টই তো সব নয়। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, ১৯৯২ সালে এরকমই একটা প্রায়-রূপকথার গল্প নিয়ে 'হীরের আংটি' বাজারে এসেছিল। বিশেষ হিট হয়নি, কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ নামক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।
...........................