স্বজাতিবিদ্বেষের গভীর অসুখ : নুহাশ হুমায়ুনের ‘ফরেনার্স ওনলি’
.........................
শর্ট ফিল্ম : ফরেনার্স ওনলি
পরিচালক : নুহাশ হুমায়ুন
অভিনয় : মোস্তাফা মোনোয়ার, ইরেশ জাকের, শুভাশিস ভৌমিক, জেমি প্যাটারসন প্রমুখ
মাধ্যম : হুলু
...................................
নুহাশ হুমায়ুন নিঃসন্দেহে বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে চর্চিত পরিচালকদের একজন। তাঁর ‘পেট কাটা ষ’ দুই বাংলায় রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, আসন্ন শর্ট ফিল্ম ‘মশারি’র জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সিনেপ্রেমীর দল। এর মধ্যেই নুহাশের মুকুটে জুড়েছে আরেকটি পালক, হুলু ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ‘বাইট সাইজ হ্যালোউইন’ নামের মার্কিন অ্যান্থলজি সিরিজে একমাত্র এশীয় পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন নুহাশ, ফলশ্রুতি পনেরো মিনিটেরও কম সময়ের একটি শর্ট ফিল্ম, ‘ফরেনার্স ওনলি’।
এ ছবি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, নুহাশের বুকের পাটা আছে বটে। খোদ মার্কিন প্রচারমাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মনে সুপ্ত স্বজাতিবিদ্বেষ নিয়ে, যে বিদ্বেষের বীজ ছড়িয়ে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার পরতে পরতে। ব্রিটিশ আমলের মোটা দাগের ‘ডার্টি নিগার’ বিদ্বেষের ধাপ অনেকাংশে পেরিয়ে মার্কিন অধ্যুষিত নব্যধনতন্ত্রে এখন এশীয় বা আফ্রিকানদের স্বজাতিবিদ্বেষ শেখানো হয় আরো কায়দা করে, উন্নয়নের রঙিন মোড়কে প্যাকেজিং মারফত। টিভিতে দু’মিনিট অন্তর অন্তর বাহারি বিজ্ঞাপন যেখানে গায়ের ফর্সা রঙের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসকে অথবা মার্কিন আসবাবের সঙ্গে সাংসারিক শান্তিকে অদ্ভুতভাবে এক সুতোয় বেঁধে দেওয়া হয়। যুবসমাজ ভাবতে শুরু করে জড়ানো গলায় ইংরেজি বলা, কিছু বিশেষ ধরনের জামাকাপড় অথবা নেশার দ্রব্যের সঙ্গে অপরিচিত থাকলে বোধহয় জাতে ওঠা যায় না। সাম্প্রতিক মিস মার্ভেল সিরিজের নায়িকা কমলা খান ঠিক এই কথাটাই বোঝাতে চায়, ‘আমি পর্দায় অনেক সুপারহিরোর গপ্পো দেখেছি, কিন্তু তার কোনোটাতেই আমার মত কালো চামড়ার কোনো মেয়েকে মানুষ বাঁচানোর মত দারুণ কিছু করতে দেখা যায় না।‘
এ ছবির শুরুতেই তাই দেখা যায়, কসাইখানার টেবিলে বসানো ছোট্ট টিভিতে চলছে ফর্সা হবার ক্রিমের বিজ্ঞাপন, অন্যদিকে কসাই হাসান প্রাণপণে তার হাত চুলকোচ্ছে, মাছি বসছে তার গায়ের রাশগুলোতে। পর্দার স্বপ্ন ও দৈনন্দিন বাস্তবে কী নিদারুণ ফারাক! এরপরেই আমরা দেখি হাসান একখানা ঘর ভাড়া নেবার জন্য বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে, কসাইখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাত না কাটিয়ে সে এবার মাথার ওপর একখানা ছাদ চায়। কিন্তু বাড়িওয়ালা নারাজ, হাসানের অপরিচ্ছন্ন চেহারা আর বাচনভঙ্গি তার একেবারেই পছন্দ হয় না। সে বারবার হাসানের জীবিকা জানতে চাইলেও হাসান ঝেড়ে কাশে না, কারণ ইতিমধ্যেই তার ট্যানারির ব্যবসা শুনে ঘেন্নায় একটি মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। দু’মাসের ভাড়া আর নতুন ওয়ালেটের লোভেও বাড়িওয়ালা লাইনে আসে না, হাসানকে ভাগানোর আগে সে স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়, ভাড়া দেবার ঘরের পাশে নোটিশ টাঙানো আছে, ‘ফরেনার্স ওনলি’। বাড়িওয়ালার যুক্তি খুব সহজ, বিদেশি আমেরিকানরা পরিচ্ছন্ন, ধোপদুরস্ত, ভদ্র। দিশিরা নোংরা, অসভ্য, গায়ে গন্ধ, ওদের কোনো ‘ক্লাস’ নেই। এমন যুক্তি আমরা ট্রেনে বাসে কলেজে অফিসে হরবখত শুনে থাকি, তৃতীয় বিশ্বের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের চোখে ভাসে একটাই মোক্ষলাভের স্বপ্ন, যেমন করে হোক বিদেশ যাওয়া। হাসানের ক্ষেত্রে চাপটা বেশি, কারণ সে এমন একটা পেশার সঙ্গে যুক্ত যাকে বছরের পর বছর ধরে নোংরা হিসেবে দেখা হয়েছে, মুসলিম কসাইকে ঠিক কতদিন ধরে কতগুলো বই বা ছবিতে ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। এর পিছনে প্রাচীন সভ্যতার অবদান কতটা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, উঁচু জাতের ব্রাহ্মণ প্রভৃতিরা পরবর্তী বৈদিক যুগে ক্রমশ নিরামিষাশী হতে শুরু করতেই কি ক্রমশ নিচুজাতের প্রোটিনের উৎস মাংসভোজনকে আস্তে আস্তে অপরিচ্ছন্ন বলে দেগে দেওয়া হতে থাকে? হামেশাই ধরে নেওয়া হয়, জীবিকার জন্য পশু কাটতে হয় বলে এই মানুষগুলোও যেন স্বাভাবিকভাবেই পাশবিক প্রবৃত্তির। নুহাশ এই ধারণাকেই খোঁচা মারেন, যখন আমরা দেখি গা চুলকোতে চুলকোতে হাসান হাতের সামনে পড়ে থাকা এক জানোয়ারের চোয়ালের হাড় তুলে নিয়ে তাই দিয়েই চুলকোতে শুরু করে। এর ফলে গা চিরে যায় হাসানেরই, যেমন প্রতি মুহূর্তে টিপ্পনিতে ক্ষতবিক্ষত করা হয় এই শ্রেণির লোকেদের। কিন্তু এই পাশবিক জীবনযাপনের দায় কি তাদের নিজের, নাকি যে সমাজ তাদের অপাংক্তেয় করে রেখেছে তার? মানুষের মত বাঁচবে বলেই হাসান ঘরভাড়া নিতে চায়, তাকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া সেই বাড়িওয়ালাও কিন্তু সমাজেরই অংশ।
আরও পড়ুন : ডার্লিংস : 'ভালোবাসা'-র পাশেই যেসব অসুখ শুয়ে থাকে / রোহন রায়
ওষুধ কিনতে গিয়েও সেই একই ছবি, দেশের লোককে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে মার্কিন খদ্দেরকে গদগদ ভাবে আপ্যায়ন করে দোকানদার। রাগে ক্ষোভে অবশেষে এক ভয়ানক কাজ করে বসে হাসান। ক্রাইম এখানে ঘটেছে কোনো ব্যক্তিগত মানসিক বিকৃতির জন্য নয়, বরং জটিল সামাজিক বৈষম্যের কারণে। ঘ্যাস ঘ্যাস করে গা চুলকোতে চুলকোতে মার্কিন খদ্দেরের দিকে হাসানের এগিয়ে আসা খুব সচেতনভাবেই মনে করিয়ে দেয় বাঁদরের হাবভাব, আর সেইসঙ্গে আমাদের মাথায় হাজিরা দিয়ে যায় মনুষ্যতর নেটিভদের নিয়ে সাহেবদের প্রায় আড়াইশো বছর ধরে লিখে চলা অজস্র গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র, সন্দর্ভ। ফ্রেনোলজি, ইউজেনিকস, সোশ্যাল ডারউইনিজম প্রভৃতি গালভারা তত্ত্বের কচকচি, যা দিয়ে বারংবার প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে ইউরোপীয় সাদা মানুষ ছাড়া কেউই আসলে ঠিকঠাক মানুষ হিসেবে পরিণত হয়নি। সাদা চামড়া জড়ানো হাসানের বীভৎস মুখ অনিবার্যভাবে মনে করিয়ে দেয় ফ্রানৎজ ফ্যাননের ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’ গ্রন্থের শিরোনাম, আমরা সবাই কি হাসানের মতোই ক্রমশ সাদা মুখোশ জড়ানো বিকৃত এক প্রাণী হয়ে উঠবার চেষ্টা চালাচ্ছি না? তার মুখোশ দেখে তাই বাড়িওয়ালাও বিনা বাক্যব্যয়ে হাতে তুলে দেয় ঘরের চাবি, ক্লাবে তার ‘য়্যাম ভিগান’ সংলাপ শুনে মার্কিন উচ্চারণ ও পোশাকের বাংলাদেশি মেয়েটির মুখে দেখা দেয় হাসি। বাস্তব সমাজের মতোই বিকৃতিটা এখানেও কারো চোখেই পড়ে না। তৃতীয় বিশ্বের উচ্চবিত্তদের শখের ভিগানিজম ভেবেও দেখে না যে সংখ্যাগুরু দরিদ্র জনসাধারণের যথেষ্ট পুষ্টির জন্য আমিষের থেকে সস্তা আর কিছু নেই, তাদের তথাকথিত আন্দোলনের প্রতি তাই ব্যঙ্গই পরিচালকের একমাত্র প্রতিক্রিয়া।
ছবির শেষে দেখানো হয় বিভিন্ন সত্যিকারের বিজ্ঞাপন, যেখানে বাংলাদেশিরা বড় বড় করে ঘরভাড়ার শর্ত হিসেবে বলে দিয়েছেন, ‘ফরেনার্স ওনলি’। এ ছবিতে ভয় কোনো অশরীরী থেকে আসেনি, বরং সমাজে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলা নির্মমতা উপলব্ধি করে আমরা শিউরে উঠি। এ ছবির হিংসা আদতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অজস্র খেটে খাওয়া মানুষজনের উপর প্রত্যেক মুহূর্তে ঘটে চলা অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার। এবং এ সবকিছুই দেখানো হয়েছে এত প্রাঞ্জলভাবে, যা বুঝতে কোনোরকম সিনেবোদ্ধা হবার দরকার পড়ে না। ছবির চিত্রনাট্য টানটান, অভিনয় দারুণ, আবহ সুন্দর, সংলাপ পরিচ্ছন্ন। নুহাশকে কুর্নিশ, স্বজাতিবিদ্বেষের বীজ যে চামড়ার নীচে অনেক, অনেক গভীরে অবস্থান করে সেটা এত সুন্দরভাবে বোঝানোর জন্য। বাংলাদেশের ওটিটি মাধ্যমের শিল্পীরা একের পর এক দুর্দান্ত কাজ উপহার দিয়ে চলেছেন, ট্যালটেলে ভদ্রবিত্ত নস্টালজিয়া আর অপ্রয়োজনীয় যৌনতার উদয্পনে মজে থাকা এপার বাংলার ওটিটিগুলো কবে নড়েচড়ে বসবে?
...............................
#Foreigners Only #Nuhash Humayun #Short Film #Bangladeshi Film #silly পয়েন্ট