পরজীবী: মন-মেজাজের ক্যালাইডোস্কোপ
বই - পরজীবী (উপন্যাস) গোত্র - ক্রাইম-ড্রামা, লেখক - অভিষেক ঘোষপ্রকাশক - বার্তা প্রকাশনপৃষ্ঠা সংখ্যা – ১১৭মূল্য – ১৮০ প্রকাশ - কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা, ২০২২ ।
হালফিলে প্লট নিয়ে অনেক রকম নিরীক্ষা চলছে, সেই জায়গায় স্বাদু গদ্যের সাথে নির্ভেজাল ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট আর অপরাধ-মনস্তত্ত্ব, অভিষেক ঘোষের নতুন উপন্যাস 'পরজীবী'-র মূল আকর্ষণ। বাংলা উপন্যাসে থাকবে নিখাদ বাঙালিয়ানা এমন প্রত্যাশা নিয়ে আজকাল বাঙালিরাও বোধহয় বাংলা উপন্যাস পড়তে বসেন না। সেখানে এই উপন্যাসের পাঠকের অবশ্যই প্রাপ্তিযোগ ঘটবে বলা যায়। কারণ 'পরজীবী'-র কাহিনি গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে অতীত আর বর্তমানের মাঝে অদৃশ্য সাঁকোটা ধরে রাখে। গ্রাম-জীবন এখানে বিরাট গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে।
গল্পের কাহিনি ঘুরপাক খায় মূলত একটি অপরাধকে কেন্দ্র করে। কিন্তু পড়তে পড়তে মনে হয়, কয়েকটি মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ যেন আরও বহু অপরাধকে সযত্নে লুকিয়ে রাখে। যেন একটা রুবিকস্ কিউব, যার সব রঙগুলো মেলানো দুঃসাধ্য। বহু ঘটনা কেবল কয়েকজনের স্মৃতিতেই রয়ে গেছে, এখনও কখনও কখনও সেই স্মৃতিগুলো তাদের তাড়া করে ফেরে। কথায় আছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না! কিন্তু মুশকিল হল, এই অপরাধ আর পাপের এত অসংখ্য মাত্রা আর শিকড়-বাকড় যে চরিত্রগুলো যেন তাদের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সম্পূর্ণ আখ্যানে ধাপে ধাপে স্তরে স্তরে মানব মনের জটিল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। শেষে এক দুর্গা পুজোর ভাসানের সময় সুন্দরপুর গ্রামে এই উদ্ঘাটনের ক্লাইম্যাক্স ঘনিয়ে আসে। যার সাক্ষী হয় গ্রামে ‘আউটসাইডার’ পার্থ। সে দিনই মুখোমুখি হয় অসংখ্য পরজীবীরা, যাদের কেউ শর্ত রেখেছিল, কেউ শর্ত মেনেছিল, আর কেউবা শর্ত ভুলেছিল! পরজীবী – শব্দের নানা মাত্রাও এ কারণেই চোখে পড়ে । সূর্যকান্ত, সদানন্দ, রাধাকান্ত, রাজীব, মাধুরী, কৃষ্ণকান্ত, মাধবী - প্রতিটি চরিত্রই এই মন্তাজে এতটাই আকর্ষণীয় যে, এরা কীভাবে কখন কাটাকুটি খেলায় কাকে মাত করে, সেই কৌতূহলে পাঠক ডুবে যেতে বাধ্য হবেন। সেই সঙ্গে মানব চরিত্রের বিচিত্র রহস্য পাঠক-মনে তৈরি করবে অনুভূতির আশ্চর্য কোলাজ।
আরও পড়ুন : গদ্যাবধি: বাংলা কবিতাভুবনের জরুরি ও নির্বিকল্প আলোচনা / সরোজ দরবার
সূর্যকান্ত নিঃসন্দেহে উপন্যাসের সবচেয়ে জমকালো চরিত্র। সে-ই বীজ বুনেছিল, লোভ-লালসা আর ক্রোধ-হিংসা এগুলি যে কীভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে, সূর্যকান্তকে দেখলে বোঝা যায়। আবার প্রবল ঘূর্ণি-ঝড়ে ভিটে-হারানো একরোখা মেয়ের বুনো জেদ কীভাবে কোনও বিপত্তি ঘটাতে পারে, সেটাও এই উপন্যাসের এক বর্ণময় দিক। তাই মনে হয়, প্রচ্ছদ এই উপন্যাসের বিচিত্র গতি ও রঙের মিশেলের প্রতি সুবিচার করতে পারে নি। এটি পড়ার অভিজ্ঞতা ভারি অদ্ভুত । কোনও কিছুই এখানে প্রেডিক্টেবল নয়। অনেক কিছু ঘটা মাত্রই কাকতালীয় মনে হবে, কিন্তু যতই কাহিনি এগোবে পাঠক বুঝবেন, সুতোয় সুতোয় জড়িয়ে আছে গল্পের প্লট। নানান সুতো রয়েছে নানা চরিত্রের হাতে, কে-কখন-কেন সেই সুতোয় টান দেয় আর কাহিনি কীভাবে ঘুরে যায়, নতুন বাঁক নেয়, সেটা বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আর এই স্বাদটাই এই উপন্যাসের বিশেষত্ব। মানুষের মন, স্মৃতি, বিশ্বাস আর বাসনা এরাই যেন এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। পরতে পরতে চমক আর চাপা একটা টেনশন - 'পরজীবী'র আঁতের কথা। বার্তা প্রকাশনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
#পরজীবী #উপন্যাস #বইয়ের খবর #সিলি পয়েন্ট #আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা ২০২২