গদ্যাবধি: বাংলা কবিতাভুবনের জরুরি ও নির্বিকল্প আলোচনা
বই: গদ্যাবধিলেখক: যশোধরা রায়চৌধুরীপ্রচ্ছদ: রাজীব দত্তপ্রকাশক: তবুও প্রয়াস দাম: ২০০.০০
বাংলা কবিতার সচেতন পাঠ এক ধরনের জরুরি আত্মসমীক্ষা| 'সচেতন' শব্দটি এখানে খানিক ধোঁয়াশাময়| কে সচেতন পাঠক? হেন প্রশ্ন অবান্তর নয়| কবিতাও কি জানে কে তার পাঠক আর কে নির্দিষ্ট করে সচেতন পাঠক! মনে হয়, কবিতা তা জানে না; তবে কবি জানেন নিশ্চিতই|
কবি তো আসলে এক সুচতুর ম্যাজিসিয়ান কিংবা নিপুণ একজন যোদ্ধা| সমস্ত কৌশল, সকল অস্ত্র গোপন করে তিনি একা হেঁটে যেতে পারেন সময়ের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে| থেকে যায় তাঁর ইন্দ্রজাল, অসামান্য মিথ্যের বিশ্ব; অথবা কিছু সচেতন নির্মিত তছনছ| কবিতার পাঠক যিনি, তিনি কবিতার হয়ে-ওঠাকে নিশ্চিতই ধারণ করছেন তাঁর সমগ্রে, চেতনায়| নইলে কবিতা আর দাঁড়াবার জায়গা পায় কোথায়! মনে পড়বে সেই স্মরণীয় পঙক্তি - 'পাঠকই কবিতা'| অর্থাৎ পাঠক মাত্রই সচেতন| তাহলে আলাদা করে সচেতন পাঠক হিসাবে কাদের কথা বলতে চাইছি? আসলে কেউ কেউ থাকেন, যিনি জাদুকরের শাগরেদ| তাঁর কাছে একে একে উন্মুক্ত হয় কলা-কৌশল; ধরা পড়ে যায় সমস্ত অস্ত্রের মন্ত্র; অবশ্য এটুকু আবিষ্কারেই বা তাঁর তৃপ্তি কীসে! তিনি তখন খুঁজতে থাকেন, কেন এই অস্ত্রের প্রয়োগ; কোন কৌশলে ম্যাজিকের নির্মাণ থেকে তিনি পৌঁছতে চান সেই বাস্তবতা তথা সত্যের কাছে, যা ইন্ধন জোগায় এই ইন্দ্রজালকে| আপাতত সচেতন শব্দ ব্যবহার করে আমরা তাই সেই পাঠকের কথাই বলতে চাইছি, যিনি কবিতার চাবি ঘুরিয়ে সময়ের সাতমহলায় ঢোকার রাস্তা চিনে নিতে চাইছেন| যে কেউ এমন পাঠক হয়ে উঠতে পারেন| তবে যিনি মূলত কবি, তাঁর পক্ষে কবিতার এই চাবিখানার যথার্থ প্রয়োগ ঘটানো বোধহয় সফল ভাবে সম্ভব| এই ভূমিকাটুকুর হেতু এই যে কবি যশোধরা রায়চৌধুরীকে এই সচেতন পাঠকের আসনে বসিয়েই তাঁর কবিতা-বিষয়ক গদ্যের বই 'গদ্যাবধি'কে আমরা পড়ার চেষ্টা করব| অর্থাৎ এখানে পাঠক মূলত দুজন| যিনি গদ্যাবধি বইটি পড়ছেন| পড়ছেন এই কারণে যে তিনি বাংলা কবিতার নিরন্তর যাত্রাপথ, তার বৈচিত্র এবং বিপদকেও পর্যবেক্ষণ করতে চাইছেন| আর সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে পাঠক যশোধরার ভাবনাপথ ছুঁয়েই|
মোট নয়টি প্রবন্ধ আছে এ বইতে| যেখানে বাংলা কবিতার নানাদিক আলোচিত হয়েছে| কবিতা নির্মাণের কলাকৌশল, একজন পাঠক এবং কবি হিসাবে তাঁর পর্যবেক্ষণ যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই বাংলা কবিতার রাজনীতি এবং সমাজসচেতনতা বিষয়ক প্রস্তাব ও প্রতি-প্রস্তাবও উঠে এসেছে| চট করে টেনে ফেলা সিদ্ধান্ত নয়| বাংলা কবিতার বিস্তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন যশোধরার আলোচনায় একধরনের তুলনামূলক বয়ান বা বলা যেতে পারে ডিসকোর্সের অবকাশ থেকে গিয়েছে| যা এই প্রবন্ধগুলিকে অনেকটা খোলামুখ করে রেখেছে| আগামীর পাঠক নিশ্চিতই এই পথ ধরে আলোচনাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন| নিজের পাঠ অভিজ্ঞতা, অনুভব এবং বিশ্লেষণী ব্যাখ্যায় সময়ের প্রবীণ-নবীন সংস্করণের মধ্যে চমৎকার একটি যোগসূত্র এই প্রবন্ধগুলোতে রচনা করেছেন যশোধরা| বাংলা কবিতার সরণিতে হেরে যাওয়া মানুষকে তিনি যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন, এবং তাতে যেভাবে খুলে গিয়েছে সময়ের পরত, তা আমাদের ভাবায়| পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় কবিতার কাছে| পড়তে শেখায় কবিতার ভিতরের কবিতাকে|
তবে এই বইয়ের কেন্দ্রীয় অংশ যে বিষয়টি নিয়ে গঠিত, তা গুরুত্বপূর্ণ এক সমকালীন চর্চার বিষয়| মানবী বিদ্যাচর্চা কিংবা লিঙ্গ-রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন স্তরে এখন আলোচনা, লেখালিখি শুরু হয়েছে বটে, তবে বাংলা কবিতাকে আশ্রয় করে এখানে যশোধরা যে কাজ করেছেন তা সন্দেহাতীত ভাবে স্মরণযোগ্য| দুটি প্রবন্ধে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে| প্রথম প্রবন্ধ 'অনবদমনের অসম্পূর্ণ আকাশ' খুঁটিয়ে দেখেছে বাংলা কবিতার পুরুষ ও নারী কলমকে| 'অ্যাঞ্জেল হোর ডিকটমি' বা শিল্পের 'মেল গেজ' পেরিয়ে নারীর 'বিষয়' থেকে 'বিষয়ী' হয়ে ওঠার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন যশোধরা| তা শুধু তত্ত্বগত ভাবে নয়, কবিতা ধরে ধরেই এগিয়েছে আলোচনা| পুরুষ কবিরা যখন অচলায়তন ভাঙছেন, কবিতায় শরীরবোধের প্রকাশ যখন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, তখন নারীরা কীভাবে নিজের অঞ্চল তথা বিশ্ব নির্মাণ করে নিচ্ছেন তা দেখিয়েছেন তিনি| প্রত্যাশিত ভাবেই এসে যাচ্ছেন রাজলক্ষ্মী দেবী, কবিতা সিংহ থেকে রমা ঘোষ| কবিতার নির্মাণ তুলে ধরে, শব্দের বিন্যাসে এবং শব্দের ভিতরকার ভাঙচুর তুলে ধরে তিনি দেখান কেন এবং কীভাবে সুতপা সেনগুপ্ত, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়দের কবিতা প্রচলিত ধারণার খেলাটিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে| আবার এই প্রবাহের বিপদটিকেও সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি| যেখানে নিন্দা করতে গিয়েও আসলে পুরুষের অধীকৃত বিষয় হয়ে উঠছে নারীরা| সেখান থেকে অবশ্য উত্তরণের পথটিও খুঁজে পেয়েছে বাংলা কবিতা| বিষয়ের নিরিখেই এই সংক্রান্ত তত্ত্বগত যে আলোচনা, তা ছুঁয়েই আলোচনা এগিয়েছেন যশোধরা| কিন্তু কবি বলেই কবিতার অন্দরমহলে তত্ত্বের প্রতিফলনকে তিনি এমন যথার্থ ভাবে চিহ্নিত করেছেন| অথবা এখানেও এসে যায় সেই সচেতন পাঠকের কথা| যিনি সময়ের বিবর্তনকেই চিনে নিচ্ছেন কবিতার ছদ্মবেশ সরিয়ে|
এই সংক্রান্ত দ্বিতীয় প্রবন্ধ 'নারীর মুখ: ভাঙচুর আর উদবৃত্তায়নগুলি'র আলোচনার প্রেক্ষাপট আরও প্রসারিত| দশক ধরে ধরে সময়ের মেজাজ-মর্জি পর্যবেক্ষণ করা যেমন হয়েছে, তেমনই এ লেখা পৌঁছেছে সেই সময়ে যেখানে পণ্যায়নের বিশ্ব এসে ঘুলিয়ে দিয়েছে নারী-পুরুষের দ্বৈততাই; ফলত পুরুষের পথ হারানোর প্রশ্নটিও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক| কবিতার সূত্রে সময়কে এভাবে দেখা বা সময়কে চিনতেই কবিতাকে ব্যবহার করা - যেদিক থেকেই ভাবা যাক না কেন, বাংলা কবিতাপাঠের ধারাবাহিক সচেতন প্রয়াসে এই দুটি প্রবন্ধ নির্বিকিল্প সংযোজন| বলা যায়, এই বিষয়টি এতটাই আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে যে, বহু বিষয়ের ভিড়ে না মিলে তারা একাকী থাকলেই বুঝি বা ভালো হত!
'গদ্যাবধি' তাই শেষ পর্যন্ত আত্মসমীক্ষার এক জরুরি ডকুমেন্টেশন| সময় ও সমাজকে একজন কবি কিংবা সচেতন কবিতার পাঠক যেভাবে পাঠ করতে পারেন, তারই মননশীল নমুনা এই বই| ভাবনার রসদ তো জোগাবে বটেই| সেই সঙ্গে এই বই পড়তে শেখাবে কবিতাকে, কবিতার ভিতর সময়ের অঙ্গার এবং আগুনকে|
শেষে এসে শুধু চিলতে আপশোস, 24-25 এবং 56-57 পাতায় কিছু পুনরাবৃত্তি থেকে গিয়েছে, হয়তো অনিচ্ছাকৃত, তবু না থাকলেই ভালো হত|
আরও পড়ুন: লকডাউনের দিনলিপি : আহত সময়ের মরমী দলিল/রোহন রায়