চালচিত্রের হালচাল
বারোয়ারি থিমপুজোর দৌলতে দেবীপ্রতিমা আর চালচিত্রের হাল আজ যেমনই হোক না কেন, পুজোর সাবেকিয়ানায় বিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই বলবেন, এ মোটেই হালকা করে নেওয়ার বস্তু নয়।অষ্টমীর অঞ্জলি বা নবমীর ধুনুচি নাচের মতোই বনেদি বাড়িগুলিতে পুজোর অপরিহার্য অঙ্গ ছিল চালচিত্র। ছিল, আছে এবং থাকবে বলেই মনে হয়। চালচিত্র ছাড়া বাড়ির পুজো যেন অকল্পনীয়! শুধু তাই-ই নয়, ধর্মীয় তাৎপর্যের জায়গাটুকু বাদ দিলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
চালচিত্র শব্দটি ব্যাকরণ মতে মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। চালির ওপর আঁকা চিত্র। উৎসগতভাবে বাংলা পটচিত্রেরই এ এক রকমফের বিশেষ, যাকে দুর্গাপট বা দেবীপট বলা হয়। আর পট মানেই ছবির মাধ্যমে বলে যাওয়া গল্প। তাই চালচিত্র আঁকার কাজটিকেও ‘পট লেখাই’ বলা হয়। এখন অবশ্য সরাসরি চালচিত্রে আঁকতে পারেন এরকম শিল্পীর সংখ্যা কমে যাওয়ায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজে আগে ছবি এঁকে চালচিত্রে তা জুড়ে দেওয়া হয়। তবে কোনও কোনও বনেদি পরিবার আজও প্রতিমার চালিতে সরাসরি ছবি আঁকার রীতিটিই বজায় রেখেছে। হরিমাটি, মেটে সিঁদুর, ভুসোকালি প্রভৃতি প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয় চালচিত্রে।
মূলত পৌরাণিক এবং দেবী দুর্গার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট – এমন ছবিই ঠাঁই পায় চালচিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে। কৈলাসী চালচিত্রে থাকেন নন্দীভৃঙ্গীসমেত পঞ্চানন শিব, মহিষাসুরবধে রত দেবী দুর্গা প্রমুখ। থাকে শুম্ভ-নিশুম্ভকে পরাজিত করার দৃশ্যও। দশাবতারী চালচিত্রের বিষয় তার নামেই স্পষ্ট। তবে কৈলাসী দশাবতারী – এই ভাগগুলো তো বিষয়বস্তু অনুসারে। চালির আকারের ওপর নির্ভর করেও বদলে যায় চালচিত্রের ধরন। আর চালির আকার নির্ভর করে স্থাপত্যশিল্পের নানা আদলের ওপর। সেদিক থেকে দুর্গাপুজোয় প্রধানত চার পাঁচ রকমের চালি দেখা যায়।
বাংলা চালি
নিচের ছবিটি বাংলা রীতির চালচিত্রের। চালচিত্রের সমস্ত ধরনের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এই বাংলা চালি। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা এই ধরনের চালি ব্যবহার করতে শুরু করেন। প্রাচীন বাংলা রীতিতে তৈরি প্রতিমার একচালার মূল কাঠামোকে প্রায় বৃত্তাকারে ঘিরে থাকে এটি। কাঠামোর চেয়ে আকারে খানিক বড় হয় বলে কাঠামো ছাড়িয়ে দুপাশে কিছুটা ঝুলেও থাকে। যেসব পুজোয় এখনও বাংলা চালির চল আছে তার মধ্যে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো অন্যতম।
মঠচৌরি চালি
এ চালি বাংলা চালির চেয়ে অপেক্ষাকৃত পরে এসেছে। নিচের ছবির মতো এ চালার দেবীপ্রতিমার মাথায় তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালি দেখা যায়। তার মাথায় আবার থাকে ‘মঠ’ বা মন্দিরের চূড়ার মতো তিনটি চূড়া বা শিখর। এই ধরনের চালিতে দ্রাবিড় স্থাপত্যের বেশ প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে বাংলা রীতির মতো একটানা চালির বদলে তিনটি শিখরের পরিকল্পনা অনেকতা দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের গোপুরম বা প্রবেশতোরণের মতো। এই তিনটি চূড়া শাক্তমতে সত্ত্বঃ-তমঃ-রজঃ – এই ত্রিগুণের ইঙ্গিতবাহী। শাক্তদর্শন অনুযায়ী দুর্গাপূজা হল ত্রিদেবীর আরাধনা। সত্ত্বগুণের রূপ লক্ষ্মী, সরস্বতী রজগুণের রূপ আর শিববণিতা পার্বতীরূপ তাঁর তমগুণের প্রকাশ। মঠচৌরি রীতিতে তিন চূড়াবিশিষ্ট তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালি এই ত্রিদেবীর আরাধনায় গুরুত্ব আরোপ অরেছে। তবে এই রীতির চালি খুবই বিরল। কলকাতার হাটখোলার দত্তবাড়ি, দর্জিপাড়ার মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে মিত্রবাড়ি – এরকম কিছু জায়গায় মঠচৌরি চালি দেখা যায়।
টানাচৌরি চালি
মঠচৌরির মতো টানাচৌরি রীতির চালিও অতি বিরল। টানাচৌরিতে মঠচৌরির মতো তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার অংশ থাকে না। পরিবর্তে একটানা সরলরেখায় তিনটি শিখর পরপর বসানো থাকে বলে এর নাম টানাচৌরি। এখানেও তিনটি চূড়া সত্ত্ব-রজ-তমোগুণের প্রতীক। । কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আটটি পুজোর মধ্যে অধিকাংশ পুজোয় এই চালি ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র চৌধুরী উপাধিযুক্ত জমিদার বাড়িগুলি এই চালি ব্যবহার করে বলে এর আর একটি নাম 'চৌধুরী চালি'।
মার্কিনি চালি
মার্কিনি রীতির চালি সময়ের বিচারে সবচেয়ে কমবয়সী। এর গঠন অনেকটা আধুনিক স্থাপত্য ঘেঁষা। ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত পারিবারিক ও সর্বজনীন পুজোতে এই রীতির চালচিত্রের ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি। বাংলা চালি যেখানে প্রায় বৃত্তাকার, মার্কিনি চালি সেখানে অর্ধবৃত্তাকার। প্রতিমার দুপাশে দুটি থাম থাকে। থামদুটি জুড়ে প্রতিমার মাথার পিছনদিকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে থাকে মার্কিনি চালি।
সর্বসুন্দরী চালি
এই চালি অনেকটা গাড়ি বারান্দার মতো। প্রতিমার চার কোনে তিনটি করে মোট বারোটি থাম থাকে। থামগুলিকে জুড়ে প্রতিমার মাথায় চৌকো চাঁদোয়ার মতো করে শোভা পায় চাল।
আরও পড়ুন : শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিলেন মেম বাইজি : উত্তাল হয়েছিল শহর / ইলোরা মিত্র
তবে চাল আর চালচিত্রের আকার প্রকার যেমনই হোক না এর সবচেয়ে জরুরি দিকটা বোধহয় মা দুর্গাকে সপরিবারে একত্রিত অবস্থায় দেখার ভাবনা। বেঁধেবেঁধে থাকার ভাবনা। আজ প্রতিমাকে বড় থেকে আরও বড় করার দৌড়ে পুজোমণ্ডপ থেকে প্রায়শই উধাও একচালার প্রতিমা। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে যেখানে পরিবারের এক এক সদস্যকে বাসা বাঁধতে হয় পৃথিবীর এক এক প্রান্তে, সেখানে সাবেকি প্রতিমার চালচিত্র আমাদের কাছাকাছি জুড়ে থাকার ইচ্ছেকে কি আর একটু উসকে দিতে পারে না?
আরও পড়ুন : মোদের পুজো, মদের পুজো / বিবস্বান দত্ত
..............................
[ঋণ : দেবী দুর্গার চালচিত্র / দীনবন্ধু আঢ্য]
.............................
অলংকরণ ও পোস্টার : অর্পণ দাস