মোদের পুজো, মদের পুজো
আহা। গালি দেবেন না। যা ভাবছেন তাই। এই পান মানে মদ্যপানই। এমনিতে শাক্তমতে মদ্যপান নিষিদ্ধ নয়। পুজোরই অঙ্গ বিশেষ। তবে দুর্গাপুজোয় সেই পান শুধু তন্ত্রাচারী সাধককুলেই আটকে থাকে না। আপামর ভক্তকুলেও ছড়িয়ে পড়ে।
দেখুন মশাই, যতই ভান করুন, এসব আপনি জানেন। যাঁরা সারাবছর মদ ছুঁয়েও দেখেন না তাঁদেরও কেউ কেউ ও এই পুজোর সময় বন্ধুদের আড্ডায় হালকা দুপেগ মেরে দেন।
উঠতি কলেজ ছোকরাদের যেন আপনি দেখেননি! ওই দঙ্গলের হাতে যে একটি বিশেষ কোল্ড ড্রিংকসের বোতল ঘুরছে, আপনি কি নিশ্চিত ওতে কেবল নরম পানীয়ই রয়েছে? না না। খেয়ে দেখতে বলছি না আপনাকে। একটু শুঁকে দেখুন! ভদকা মেশানোর জন্য ফ্যান্টা মিরিন্ডা থেকে শুরু করে স্প্রাইট সেভেন আপ এইসবই প্রশস্ত। আর রামের জন্য কোকোকোলা, পেপসি অথবা থাম্বস আপ।
পুজোয় F.L. off কাউন্টারের সামনে লাইন দেখেছেন? কে বলবে ওই ছোট্ট গ্রিল দেওয়া দোকানে কোনও পুজো হচ্ছে না! ভেতরে বারুণী ছাড়া অন্য দেবী নেই।
২০১৮ সালে পুজোর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হিসেব অনুযায়ী মোট ১২৭৫ কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়। আবগারি দফতর তৈরি হওয়ার পর কোনও এক মাসে এত রাজস্ব নাকি আগে কখনও আসেনি।
বারুণী দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মীর এই যোগ বুঝে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৬ সালেই ড্রাই ডের সংখ্যা বারো থেকে কমিয়ে একদম সাড়ে চারদিন করে দেয়। সরকারি মতে এই রাজ্যে ২৬ জানুয়ারি, ১৫ অগাস্ট, ২ অক্টোবর ও মহরমে মদের দোকান পুরো বন্ধ থাকে । এবং দোলের দিন বেলা দুটো পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয় মদের দোকান। ২০১৯ সালে একটি সংবাদপত্র খবরের শিরোনাম করে, “ঢুক ঢুক পিও যুগ যুগ জিও, দুর্গাপুজোয় বন্ধ থাকবে না মদের দোকান”। এই শিরোনামের নিহিত উল্লাস পড়তে পাঠকদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তবে যদি ভেবে থাকেন বাঙালির এই অধঃপতন নিতান্ত হালফিলের ব্যাপার তাহলে কিন্তু ভুল ভাববেন। দুর্গাপূজার উদযাপনের সঙ্গে পান-সংস্কৃতির জড়িয়ে যাওয়া সেই উনিশ শতক থেকেই। হুতোমপ্যাঁচা তাঁর নকশায় পুজোর যেসমস্ত “রিফাইন্ড কেতা”র বর্ণনা দিয়েছেন তাতে কিন্তু মদমত্ত বাঙালির পানীয়প্রেমও ফুটে উঠেছে বিশেষ করে। হুতোম লিখছেন, “এ সহরে আজ্ কাল দু-চারজন এজুকেটেড ইয়ংবেঙ্গল ও পৌত্তলিকতার দাস হয়ে পুজো আচ্ছা করে থাকেন - ব্রাহ্মণ ভোজনের বদলে কতকগুলি দিল দোস্ত মদে ভাতে প্রসাদ পান।” মূর্তিবিরোধী ইয়ংবেঙ্গলদের মাতৃভক্ত করে তোলার পেছনে বারুণীদেবীর খানিক প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ হয়তো ছিল। ভাতের সঙ্গে মদের প্রসাদ সেসময় ঠিক কতটা সুস্বাদু হয়ে উঠত তার বর্ণনা অবশ্য হুতোম দেননি। তবে শুধু কি ইয়ংবেঙ্গল? শুধু কি সমাজের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণি? আজ্ঞে না। দুর্গাপুজোয় “বওখাটে পিল ইয়ার ছোকরারা ভরপুর নেশায় ভোঁ হয়ে ছড়া কাটচেন” - এই ছবিও পাওয়া যাবে হুতোমেই। কেবল মদ নয়। অন্য নেশাও এইসময় পুজোর আচারেই ঢুকে গেছিল। পুজোর কর্মকর্তা বাবুরা প্রতিমা নিরঞ্জন করে, নীলকণ্ঠ শঙ্খচিল উড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছে পূর্ণঘট প্রণাম করে , শান্তিজল নিতেন। কাঁচা হলুদ আর ঘটজল খেয়ে পরস্পর কোলাকুলি করে কলাপাতে দুর্গানাম লিখতেন। তারপর সিদ্ধি খেয়ে বিজয়ার উপসংহার হত। বিলিতি নেশার উল্লাস শেষ হত দেশি নেশার মনখারাপি সুরে।
আজকের ভাসানের মদ্যপায়ী উত্তাল ডিজে সংস্কৃতির সঙ্গে এতটুকুই পার্থক্য ছিল উনিশ শতকের।
****************************
অলংকরণ ও চিত্র সম্পাদনা: অর্পণ দাস
****************************
#দুর্গাপুজো #কলকাতা #হুতোম প্যাঁচার নকশা #বাবু কালচার #মদ #মৌতাত #রাম #আবগারি #হুইস্কি #উল্লাস #ভদকা #বাংলা পোর্টাল #ফিচার #বিবস্বান দত্ত #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal