ফিচার

শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিলেন মেম বাইজি : উত্তাল হয়েছিল শহর

ইলোরা মিত্র Oct 10, 2021 at 3:12 am ফিচার

কলকাতার বাবু কালচারের নানা চমকদার গল্প তাক লাগিয়ে দেয় ইতিহাসপ্রেমীদের। বাবুদের আয়োজিত দুর্গাপুজোয় বাঈ-নাচের প্রচলন ছিল। ধনী বাঙালিদের প্রধানতম আমোদ ছিল নাচ। এই ব্যাপারে খরচে তাঁরা ছিলেন যাকে বলে একেবারে কাছাখোলা। নিকি, মুনিয়া, হিঙ্গল, আশরুন, সুপনজান, নূরবক্সের মতো বাঈজিদের ঠাট-ঠমকে জমজমাট হয়ে থাকত রাজবাড়ির পুজোগুলি। ঐশ্বর্যে, চমকে, আভিজাত্যে কীভাবে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়া যায়, সেটাই ছিল এই কলকাত্তাইয়া বাবুদের অন্যতম লক্ষ্য।

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, “যে ধনী পূজার সময় প্রতিমা সাজাইতে যত অধিক ব্যয় করিতেন এবং যত অধিক পরিমাণে ইংরাজের খানা দিতে পারিতেন, সমাজ মধ্যে তাঁহার তত প্রশংসা হইত। ধনী গৃহস্থগণ প্রকাশ্যভাবে বারবিলাসিনীগণের সহিত আমোদ প্রমোদ করিতে লজ্জাবোধ করিতেন না।…নিজ ভবনে বাঈজীদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া আনা ও তাহাদের নাচ দেওয়া ধনীদের একটা প্রধান গৌরবের বিষয় ছিল। কোন্ ধনী কোন্ প্রসিদ্ধ বাঈজীর জন্য কত সহস্র টাকা ব্যয় করিয়াছেন সেই সংবাদ শহরের ভদ্রলোকদিগের বৈঠকে বৈঠকে ঘুরিত এবং কেহই তাহাকে তত দোষাবহ জ্ঞান করিত না। এমনকি বিদেশিনী ও যবনী কুলটাদিগের সহিত সংসৃষ্ট হওয়া দেশীয় সমাজে প্রাধান্য লাভের একটা উপায় স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল।”

একদিকে বাইজিদের অসামান্য ধ্রুপদি নাচ ও উচ্চাঙ্গ গানের কদর, অন্যদিকে তাঁদের চরিত্র নিয়ে বাঁকা কথা - এই দ্বিচারিতার আবহেই বড় হয়ে উঠছিল নগর কলকাতা। পতিতা আর বাইজিকে সমার্থক করে ফেলতে সময় নেয়নি এই ঔপনিবেশিক দো-আঁশলা শহর। অথচ ফেলতেও পারেনি তাঁদের। একথা সত্যি যে, বাবুদের দরকষাকষির ফলে বহু বাঈজি তাঁদের রক্ষিতা হয়ে থাকতে বাধ্য হতা। বাবুরা সারারাত বাঈজি নিয়ে পড়ে থাকতেন বাগানবাড়িতে। বসতবাড়ির চাইতে বাগানবাড়ি আর পত্নীর চাইতে উপপত্নী ছিল বাবুদের কাছে বেশি প্রিয়। অবশ্য বাইজিদের সত্যিকারের গুণগ্রাহীও ছিলেন মহৎ-হৃদয় কেউ কেউ। ১৮২৩ সালে ফ্যানি পার্কস রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নিকি বাইজির নাচ দেখেছিলেন। আরও বেশ কয়েক দশক পরে সরস্বতী বাইজির গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন অবন ঠাকুর। লিখেও গেছেন সেই স্মৃতি। অনেকের মতে, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর সভায় বাইজি গান ও নাচের আয়োজন হত সাহেবসুবো ও অভিজাত শ্রেণির জন্য, আর কবিগান হত সাধারণ জনতার জন্য। ১৭৫৭ সালে তিনি নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। শুরু থেকেই পুজোর একটি অঙ্গ ছিল বাইজি নাচ। সেই ঐতিহ্য দীর্ঘকাল বেঁচে ছিল। নাগরিক বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের তা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। তবে দুর্গাপুজোয় সবচেয়ে অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন নবকৃষ্ণের নাতি রাধাকান্ত দেব। ১৮৫৫ সালের কথা। শোভাবাজারে নিজের বাড়ির পুজোয় তিনি মেম বাইজি আনার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর এক রাতের দক্ষিণা ছিল ২০০ টাকা। কালো মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য আসবেন শ্বেতাঙ্গিনী। খবর ছড়িয়ে পড়তেই উত্তাল হয়ে উঠল নগরী। ১৩ অক্টোবর মর্নিং ক্রনিকল পত্রিকার একটি রিপোর্ট বলছে, শোভাবাজার রাজবাড়িতে মেম বাইজির নাচ দেখার টিকিটের জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছে। এই মর্মে নাকি প্রচুর লিখিত আবেদনও জমা পড়েছিল। রাধাকান্ত নিজে অবশ্য হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলদের নেতা ছিলেন। তবে তাঁর বিলেত-প্রীতি ছিল যথেষ্ট। পুজোর সময় অতিথিদের জন্য আসত উইলসনের দোকানের বিলিতি খাবার। প্রতিমা বিসর্জনের সময়ও বিলিতি বাদ্য বাজত।


*************************************** 

ঋণ: ফিরিঙ্গিদের চোখে দুর্গাপুজো / শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী

*************************************** 

মূল অলংকরণ: প্রিন্স অ্যালেক্সিস সল্টিকফ 

চিত্র সম্পাদনা: অর্পণ দাস 


#দুর্গাপুজো #কলকাতা #উনিশ শতক #শোভাবাজার রাজবাড়ি #ব্রিটিশ কলকাতা #মেম বাইজি #বাইনাচ #শিবনাথ শাস্ত্রী #রাধাকান্ত দেব #বাংলা # ফিচার #বাংলা পোর্টাল #ইলোরা মিত্র #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

22

Unique Visitors

219137