কেরি সাহেবের বউ
১৭৯৩, ১১ নভেম্বর, চাঁদপাল ঘাটে ভিড়ল জাহাজ প্রিন্সেস মারিয়া। এ জাহাজ থেকেই অনতিবিলম্বে নেমে আসবেন তিনি, যাঁর হাত ধরে বাংলা গদ্য তার জন্মলগ্নের চলার পথ সুনিশ্চিত করে তুলবে অচিরেই। প্রতিষ্ঠিত হবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। বাংলা গদ্যের উন্মেষলগ্নের ইতিহাস-চর্চায় বারে বারে ঘুরে ফিরে আসবে তাঁর নাম। তিনি উইলিয়াম কেরি। উইলিয়াম কেরির কর্মজীবনের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় সুদীর্ঘ। কিন্তু কেরি সাহেবের ব্যক্তিগত জীবন জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে চমকে দেওয়ার মতো একের পর এক ঘটনা।
১৯৯২-তে ডেনভার সেমিনারির প্রফেসর ডক্টর জেমস আর বেক লিখে ফেললেন এক অদ্ভুত বই- ‘Dorothy Carey: The Tragic and Untold Story of Mrs William Carey'। এ বইতে জায়গা পেল উইলিয়াম কেরি এবং তাঁর প্রথমা স্ত্রী ডরোথি প্লাকেট কেরির জীবনের না-বলা জবানি। এতদিন ইতিহাস ডরোথিকে যেভাবে চিনে এসেছিল তা থেকে 180° সরে এসে ডক্টর বেক এ বইতে এক নতুন আঙ্গিক তুলে ধরলেন।
কেরির জীবনীকার ডক্টর জর্জ স্মিথের মতে, ডরোথি ‘a peasant woman, with a reproachful tongue...clouded the last twelve years of her life with madness'। ১৭৮১ সালে কেরির সঙ্গে ডরোথির বিয়ে হয়। কেরি তখন সামান্য জুতোর কারিগর। চরম দারিদ্র্য ক্রমশ গ্রাস করছে তাদের সাংসারিক জীবন। ইতিমধ্যেই ডরোথি জন্ম দিয়েছেন তিন পুত্রের। চতুর্থ সন্তান তাঁর গর্ভে। এসময়ই কেরি সিদ্ধান্ত নিলেন ইংল্যান্ড ছেড়ে মিশনারি সোসাইটির সঙ্গে তিনি ভারতবর্ষে চলে যাবেন। রওনাও দিলেন। ১৭৯৩-এর ৪ এপ্রিল প্রথম সন্তান ফেলিক্সকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন কেরি। ডরোথি এবং তাঁর বাকি দুই সন্তানকে এক রকম ত্যাগ করেই নিজেকে কর্মযোগে সামিল করলেন। কিন্তু নিয়তির ফেরে তাঁর এই যাত্রা সফল হল না। ফিরে যেতে হল ঘরে। ততদিনে চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়েছে। এবারের যাত্রায় পরিবারের প্রতি খানিকটা সহৃদয় হলেন কেরি। সাথে নিলেন সম্পূর্ণ পরিবারকেই। ভারতে পৌঁছানোর পর, পরবর্তী ছয় বছর চরম অস্থিরতার মধ্যে কাটে ডরোথির জীবন। ১৭৯৪-এর ১১ অক্টোবর পাঁচ বছরের সন্তান পিটারের মৃত্যু হয়। এরপরই ১৭৯৫-এর মার্চ মাস থেকে ডরোথির মধ্যে মানসিক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। ওই বছর অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ডে বোনকে এক চিঠিতে কেরি লেখেন, ‘I have never mentioned it to anyone in England before, is my poor wife, who is looked upon as insane to a great degree here by both native and Europeans’। কেরির সহকর্মী জন টমাস ১৭৯৬এর ১১জানুয়ারি এন্ড্রু ফুলারকে অন্য একটি চিঠিতে ডরোথির মানসিক বিকার এবং সন্দেহপ্রবণতার কথা জানাচ্ছেন। টমাস লিখছেন, ডরোথি প্রায়সই কেরিকে চুলের মুঠি ধরে মারধর করতেন। এমনকি বেশ কয়েকবার ছুরি দিয়ে আঘাত করারও চেষ্টা করেন। স্পষ্টত বোঝা যায় ডরোথি এই সময়ে ডিলিউশনে ভুগছিলেন।
মনোবিদ ডক্টর বেক তাঁর ‘Dorothy Carey: The Tragic and Untold Story of Mrs William Carey' বইতে ডিলিউশনের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। ডরোথি কোনোভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতি আবহাওয়া এমনকি খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি তাঁর দুই কন্যা সন্তানকে হারান। ভারতে আসার পরপরই পুত্র পিটারের মৃত্যু তাঁকে বিধ্বস্ত করে তোলে। সর্বোপরি কেরি হয়তো তাঁর পরিবারের প্রতি পালনীয় কর্তব্য থেকে ক্রমশ সরে আসতে শুরু করেন। কেরির প্রতি অবিশ্বাস থেকেই ডরোথির মনে সন্দেহ প্রবণতার সূত্রপাত হয়। স্বাভাবিকভাবেই ডরোথির ডিলিউশন আমাদের বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। উইলিয়াম কেরি কি ডরোথির মানসিক ব্যাধির যথাযথ চিকিৎসা করিয়েছিলেন? মানসিক রোগী হিসেবে ডরোথি কিভাবে তাঁর সন্তানদের প্রতিপালন করছিলেন? ডিলিউশনে আক্রান্ত হওয়ার এগারো মাসের মধ্যে ডরোথি তাঁর সপ্তম সন্তানের জন্ম দেন। এই ঘটনা কি খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়?
আরও পড়ুন : প্রেমচন্দের লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মঘট তাঁর প্রেসেই / বিদিশা বিশ্বাস
১৮০৭-এর ৮ ডিসেম্বর একান্ন বছর বয়সে ডরোথির মৃত্যু হয়। কেরি তাঁর ডায়রিতে লিখছেন, ‘Tuesday, Dec 8, 1807. This evening Mrs. Carey died of the fever under which she has languished sometime’। ডরোথি তাঁর জীবনের শেষ বারো বছর মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁকে শ্রীরামপুর মিশনের একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয় জীবনের শেষ কিছু বছর। নিয়তির পরিহাসে এক শিক্ষা সংস্কারকের নিরক্ষর স্ত্রীর গোটা জীবন এমনই করুণ তারে বাঁধা রয়ে গেছে।
..................................
#William Carey #Dorothy Carey #The Tragic and Untold Story of Mrs. William Carey #উইলিয়াম কেরি #ডরোথি কেরি #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #বিদিশা বিশ্বাস