প্রেমচন্দের লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মঘট তাঁর প্রেসেই
হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসে মুন্সি প্রেমচন্দ এক মাইলস্টোন। কেবল হিন্দি নয়, তাঁর কাজের পরিধি ভাষার সীমানা অতিক্রম করে আজ সর্বজন-আদৃত। কিন্তু প্রেমচন্দের মতো ভারতনন্দিত ঔপন্যাসিক যে অর্থাভাবে, কেবল ভাগ্যান্বেষণের খাতিরে তৎকালীন বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে পা বাড়ান, এ তথ্য খুব বেশি প্রচারিত নয়। বস্তুত, ১৯৩৫ সাল নাগাদ ‘মিল মজদুর’ নামে এক সিনেমার জন্য মুন্সি প্রেমচন্দ চিত্রনাট্য লেখেন। কিন্তু চমক এখানেই শেষ নয়। এই চলচ্চিত্রে একটি চরিত্রে তিনি নিজেই অভিনয়ও করেছিলেন।
প্রেমচন্দের গোটা জীবনই কেটেছে আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যে। কিন্তু নিজের আদর্শ থেকে কখনও সরে আসেননি তিনি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ১৯২০ সালে গান্ধিজির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় গোরখপুরে। অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে, এই সাক্ষাতের দুই-তিনদিন পর প্রেমচন্দ তাঁর কুড়ি বছরের সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন। ১৯২১ সালে গোরখপুর থেকে ফিরে আসেন বেনারস। এরপর ১৯২৩-এ বেনারসেই গড়ে তোলেন তাঁর সাধের ‘সরস্বতী প্রেস’। উদ্দেশ্য ছিল এই প্রেসের রোজগারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা, পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ। কিন্তু তাঁর এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় অচিরেই। প্রেস ক্রমাগত লোকসানের মুখ দেখায় বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই সময় সাহিত্যিক হিসেবে প্রেমচন্দ খ্যাতির মধ্যগগনে। কিন্তু আর্থিক সমস্যা তাতে মিটছিল না। তাঁর প্রেস তখন দেনার দায়ে ডুবে যাচ্ছে। এই সময় বোম্বাইয়ের এক ফিল্ম কোম্পানির প্রস্তাব আসে প্রেমচন্দের কাছে। তারা তাঁর ‘সেবাসদন’-এর কাহিনি নিয়ে সিনেমা বানাতে চায়। মাত্র ৭৫০ টাকার বিনিময়ে প্রেমচন্দ ‘সেবাসদন’-এর কপিরাইট বিক্রি করে দেন। কিন্তু সে টাকায় বিপুল দেনার কিছুই প্রায় শোধ হয় না।এর কয়েক সপ্তাহ পরে বোম্বাইয়ের অজন্তা সিনেটনের মোহন ভবানী তাঁকে সিনেমার জন্য গল্প লেখার প্রস্তাব দিয়ে বোম্বাইতে আমন্ত্রণ জানান। ১৯৩৪ সালের জুন মাসে মাসিক ৭০০ টাকা বেতনের বিনিময়ে সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লেখার কাজ নিয়ে বোম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান প্রেমচন্দ।
সিনে-দুনিয়ায় তাঁর প্রথম প্রোজেক্ট ছিল ‘মিল মজদুর’। মিল শ্রমিকদের হকের লড়াইকে মাথায় রেখে সাদামাটা চিত্রনাট্য লিখলেন প্রেমচন্দ। এক কাপড় মিল মালিকের কুলাঙ্গার ছেলে মিলের কর্মচারীদের বঞ্চিত করতে থাকলে, মালিকেরই মেয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের দাবি-দাওয়া বুঝে নেয়। এখানেই ধর্মঘটী এক নেতার চরিত্রে অভিনয় করেন প্রেমচন্দ স্বয়ং। ১৯৩৫-এর ৫ ফেব্রুয়ারি সিনেমা তৈরির কাজ শেষ করে পাঠানো হল সেন্সর বোর্ডের জিম্মায়। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র মিললেই মুক্তির দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে ফেলা হবে। কিন্তু বিপদ ঘটল ঠিক এইখানে।এই সিনেমা দেখে সেন্সর বোর্ডের কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। ১৯২৯ এর আর্থিক মন্দার ক্ষত তখনও শুকায়নি। বোম্বাইয়ের মিল শ্রমিকদের দুর্দশাও চরমে পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতিতে ‘মিল-মজদুর’ সিনেমার কাহিনি জনরোষ তৈরি করতে পারে, কারখানাগুলিতে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে অশান্তি দেখা দিতে পারে-এই অজুহাত দেখিয়ে সেন্সর বোর্ড বোম্বাইতে এই ছবির মুক্তি ব্যান করে দেয়। প্রাথমিকভাবে লাহোর,দিল্লি এবং লখনৌতে ছবিটি মুক্তি পেলেও সেখানকার কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বিশেষ উত্তেজনা দেখা যায়।ফলে এক সপ্তাহের মধ্যে সেখানেও ছবিটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। অনুমান করা হয় সেন্সর বোর্ডের মেম্বার বৈরামজি জিজিভাই-এর প্ররোচনায় ‘মিল মজদুর’-এর মুক্তি আটকে দেওয়া হয়েছিল। এই বৈরামজি জিজিভাই ছিলেন সেই সময় ‘Bombay Mill Owners’ Association'-এর প্রেসিডেন্ট। এসবের মাঝে আসল ট্র্যাজেডি ঘনিয়ে উঠল প্রেমচন্দের জীবনে। তাঁর স্বপ্নের সরস্বতী প্রেসের কর্মচারীরা তাঁরই লেখা সিনেমার কাহিনিতে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলো, যে প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দিল। ডুবতে বসা সরস্বতী প্রেসের এই কর্মীরা নিজেদের বকেয়া পাওনা বুঝে নিতে প্রেসের মালিক প্রেমচন্দের বিরুদ্ধে সেসময়ে ধর্মঘটেও সামিল হয়।
আরও পড়ুন: “জরুরি পরিস্থিতি চলছে ভারতে” : সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন নন্দ খারে
সেই বছর ১৯৩৫-এর এপ্রিল মাসে বোম্বাইয়ের চলচ্চিত্র দুনিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে প্রেমচন্দ বেনারস ফিরে আসেন। বোম্বাই ছাড়ার আগে তিনি কথা সাহিত্যিক জৈনেন্দ্র কুমারকে এক চিঠিতে জানান-‘এই মুহূর্তে আমার সবথেকে বড় ইচ্ছা হল যে আমি বম্বেকে বিদায় জানাই আর আমার পুরোনো জায়গায় ফিরে যাই। সেখানে অর্থ নেই ঠিকই, কিন্তু আরো অনেক কিছুই আছে। এখানে আমি সব সময় অনুভব করি যে আমার জীবন নষ্ট করেছি।’ চলচ্চিত্র জগতে কাটানো এই স্বল্প পরিসরকে প্রেমচন্দ জীবনের দুঃসময় বলে মনে করেছেন। আর বোম্বাইয়ের ফিল্মি দুনিয়াও তাঁকে ভুলে গেছে বেমালুম। দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে, ‘মিল মজদুর’ সিনেমার একটি কপিও সংরক্ষণ করা হয়নি ভবিষ্যতের জন্য।
#মুন্সি প্রেমচন্দ #ফিচার #ব্যক্তিত্ত্ব #মিল মজদুর #হিন্দি সাহিত্য #সরস্বতী প্রেস #বিদিশা বিশ্বাস