কবিতা আর জীবনকে মেলাতে পেরেছিলেন বিপ্লবী কবি চেরাবান্দা রাজু
স্কুলের খাতায় চেরাবান্দা রাজু নামে কেউ ছিলেন না কোনওদিন। স্কুলের খাতায় তাঁর নাম ছিল বদ্দাম ভাস্কর রেড্ডি। তিনি সে নাম পরিত্যাগ করে নাম নিয়েছিলেন চেরাবান্দা রাজু। যে নামের অর্থ ‘জেলখানায় পায়ের বেড়ির সঙ্গে পাথর বাঁধা নেতা’।
তিনি মনে করতেন “আদর্শ মুখের প্রসাধন নয়, সারা জীবন তাকে লালন করতে হয় / রক্তের মধ্যে…।” তিনি কবি। তিনি বিপ্লবীও। দিনবদলের ভাবনা তাঁর কবিতার শৌখিন উপকরণ মাত্র নয়, তাঁর কবিতার নিউক্লিয়াস। তিনি সেই বিরল জাতের কবি যিনি যাপিত জীবনের সঙ্গে কবিতার বিন্দুমাত্র ব্যবধান রাখেননি।
১৯৪৪ সালে হায়দ্রাবাদ থেকে তিরিশ মাইল দূরে অঙ্কুশপুরম গ্রামের এক দরিদ্র চাষী পরিবারে জন্মেছিলেন। হায়দ্রাবাদে একটি স্কুলে তেলুগু ভাষার শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। তারপর আলাপ হল বিখ্যাত কবি নিখিলেশ্বরের সঙ্গে। নিখিলেশ্বরের সূত্রে যোগাযোগ হয় ‘দিগম্বর’ গোষ্ঠীর সঙ্গে। ভাবনা চিন্তায় তাঁরা মার্কিন ‘বিট’-দের সগোত্র। সমাজের ভণ্ডামি আর ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বর্ষণ করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। তাঁদের কবিতায় নৈরাজ্যবাদ ও অবচেতনের উদ্দামতা ভাষা পেত। ফলে অকপট নির্লজ্জ ছিল তাঁদের ভাষাভঙ্গি। এই গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে ভাস্কর রেড্ডি নিজের নাম বদল করে হলেন চেরাবান্দা রাজু। কিন্তু এই পর্যায়ে আটকে থাকলেন না তিনি। নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং শ্রীকাকুলমের ঘটনার পটভূমিকায় নবজাগরণ ঘটল অন্ধ্রের লেখক শিল্পীদের, যার ফলশ্রুতি অন্ধ্রের বিপ্লবী লেখক সংঘ বা ‘বিপ্লব রচয়িতাল সংঘম্’(সংক্ষিপ্ত নাম ‘বিরসম্’)। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে ‘বিরসম্’ প্রতিষ্ঠিত হল। অন্ধ্রের অধিকাংশ শক্তিশালী লেখক এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। চেরাবান্দাও তাদের একজন। ‘বিরসম্’-এর দায় বহন করতে গিয়ে তিনি নিজে আমূল পরিবর্তিত হয়েছেন ভাবনা চিন্তায় এবং লেখনীতে। ফলে চেরাবান্দা যেখান থেকে শুরু করেছিলেন তার কবিজীবন, সেই দিগম্বর গোষ্ঠীর কবি হিসেবে তার পরিচয় অচিরেই মুছে গেছে, বিপ্লবের সমার্থক হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতাবলী। কিন্তু বিপ্লবের কথা সোচ্চারে ঘোষণা করলেও কবিতার নিজস্ব ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়নি তারা। বিপ্লবী কবি হিসেবে চেরাবান্দা রাজু শুধু তেলুগু ভাষার নন, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সাহিত্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম। তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু কবি ভারভারা রাও ছাড়া জনপ্রিয়তায় কেউই তাঁর ধারেকাছে ছিলেন না। কবিতা, গান ছাড়াও চেরাবান্দা লিখেছিলেন একটি উপন্যাস ও তিনটি একাঙ্ক নাটক।
শাসকশ্রেণিকে সরাসরি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আক্রমণ করতেন বলে শাসকের পাল্টা আগ্রাসন তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে সারাজীবন ধরেই। তাঁর ‘অমর’ নামে একটি গল্পের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘বিরসম’-এর একটি ছোটগল্প সংকলনকে। ১৯৭৪ সালে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় কুখ্যাত সেকেন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলায়। খোয়াতে হয় স্কুলশিক্ষকের চাকরি। প্রতিক্রিয়ায় তিনি নির্দ্বিধায় লেখেন - “হতে পারে আমি একজন বন্দী, কিন্তু আমি দাস নই।” তাঁর লেখা থেকে জন্ম নিয়েছে অনেক বিপ্লবী স্লোগান। পীড়ন তাঁকে ভাঙতে পারেনি, বরং শক্ত করেছে আরও। তিনি লিখেছেন,
“আমি কি গলায় দড়ি দেব
নাকি নিজেই হব গলার ফাঁস?”
এমারজেন্সির পর যখন তিনি ছাড়া পেলেন তখন শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ। ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। পরে বোঝা গেল টিউমারটি ম্যালিগন্যান্ট, অর্থাৎ ক্যান্সারে ভুগছেন কবি। এরপরেও প্রাতিষ্ঠানিকতা তাঁকে লোভ দেখিয়েছে। পুরস্কার আর সাহায্যের টোপ দিয়ে তাঁকে গিলতে চেয়েছে ক্ষমতা আর প্রশাসন। কিন্তু দারিদ্র্য, রোগভোগ সত্ত্বেও সে সমস্ত কিছু ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। ১৯৮২ সালের ৩ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। চেরাবান্দা রাজু আসলে এক মৃত্যুহীন অগ্নিশিখা। সেই কারণেই অন্ধ্রপ্রদেশ সাহিত্য আকাদেমির মরণোত্তর পুরস্কারকে অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাঁর স্ত্রী শ্যামলা রাজু। বলেছিলেন, সরকারি পুরস্কার গ্রহণ করার অর্থ চেরাবান্দাকে অস্বীকার করা। এই পুরস্কার নেওয়া মানে শুধু চেরাবান্দার অপমান তা-ই নয়, যে জনসাধারণের কথা ভেবে তিনি সারাজীবন কবিতা লিখেছেন, লেখার মাধ্যমে যাদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন - তাদেরও অপমান।
..............................
#Cherabanda Raju #poet #revolutionary poet # Telugu language # Andhra Pradesh #Varavara Rao #কবি #তেলুগু কবি #ফিচার #Feature #টিম সিলি পয়েন্ট