"বিদায়' শব্দটি আমি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করি" : স্মরণে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়
যুবকবয়সে একবার ধনুষ্টঙ্কারে প্রায় মারা যেতে বসেছিলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। পরে 'কলকাতা শাসনের জার্নাল' বইয়ের 'নিজের মৃত্যু' শীর্ষক গদ্যে লিখে গেছিলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। তার কিছুটা অংশ উদ্ধার করা যাক -
"ভাসমান নৌকার মতন আমি একটা ঝড়ের জন্য অপেক্ষা করছি। উঠলেই সুইচ অফ হয়ে যাবে - তারপর তো আমার দায়িত্ব শেষ। ... চমৎকার এই তুরীয় অবস্থা - যেন একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে একবার এপার একবার ওপার চেয়ে দেখা। কে টানছে বেশি, আয়া, আমি সেইদিকেই যাব। কার স্নেহ বেশি আমার প্রতি, আয়া, আমি তারই স্নেহপ্রার্থী। জীবন এবং মৃত্যু দুপাশে দড়ি ধরে টানছে - নরম বিছানার ওপর আমি সেই অবশ দড়িটির মতো টান হয়ে আছি। আমার কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। যে-পক্ষের শক্তি বেশি সে-পক্ষ আমায় নিয়ে যাও। শুধু বন্ধুবান্ধবের মুখ যদি দেখতে পেতাম একবার। ..."
গতকাল, ২১ ডিসেম্বর, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে যখন তিনি মারা যাচ্ছেন, তখন ঠিক এরকমই ভাবছিলেন কিনা সেটা জানার উপায় নেই। কিন্তু তাঁর শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন না তেমন কোনও কবি-সাহিত্যিক। আসলে কবি-বন্ধুরা সকলেই তো পাড়ি জমিয়েছেন আগেই। গত বছর চলে গেছেন স্ত্রী, কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়ও। একা শরৎকুমারই বসে ছিলেন স্মৃতির ঝাঁপি আগলে। চলে গেলেন 'আদি কৃত্তিবাসী'-দের শেষজনও। কিছুটা যেন নির্বান্ধব, বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই চলে যেতে হল তাঁকে। বয়েস হয়েছিল ৯০ বছর।
আরও পড়ুন : 'ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম’ : স্মরণে বিজয়া মুখোপাধ্যায়
শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের ১৯৩১ সালে ওড়িশার পুরীতে জন্ম। বেড়ে ওঠা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। এরপর উচ্চতর শিক্ষা বিদেশে। পেশায় ছিলেন চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন অবশ্য ছদ্মনামে। নাম নিয়েছিলেন 'নমিতা মুখোপাধ্যায়'। অপরিচিতা 'নমিতা'-কে নিয়ে সে সময় বিস্তর হইচই পড়েছিল সাহিত্যমহলে। পরে শরৎকুমার নিজেই রহস্য ভাঙেন। বিখ্যাত কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। জীবনে কিংবদন্তী কম ছিল না। রাত বারোটার পর চার কবিতাপাগল যুবকের (শক্তি, সুনীল, শরৎ ও সন্দীপন) কলকাতা শাসনের যে খতিয়ান শরৎকুমার কবিতায় লিখে গেছেন, সে আখ্যান আজও কবিতাপ্রিয় মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। ৫২ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন লেখালিখিতে। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন গদ্য, উপন্যাস। কাল ছিল ডাল খালি, অন্ধকার লেবুবন, আহত ভ্রুবিলাস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন অনেক। 'ঘুমের বড়ির মতো চাঁদ' কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০০৯ সালে পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। কিন্তু এমন এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবির চলে যাওয়াটা যেন একটু বিচ্ছিন্ন, নির্বান্ধব হল।
আরও পড়ুন : থেমে গেল লিঙ্গবৈষম্য ও বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে অতন্দ্র কলম : প্রয়াত বেল হুকস
..............................
#শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় #মৃত্যু #স্মরণ #কবি #ব্যক্তিত্ব #ফিচার #পোর্টাল #সিলি পয়েন্ট