“তারার পানে চাইবি যখন…”

(নভেম্বর, ১৯৫৪) কদিন থেকেই শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না সাদাকোর। অল্প পরিশ্রমেই যেন ক্লান্ত লাগছে। জ্বর আসছে মাঝে মাঝে। ছুটোছুটি করে খেলতে, দৌড়তে তার জুড়ি মেলা ভার। তাই স্কুলের রিলে টিমেও তার ভারী কদর। সেই মেয়ের সমস্ত প্রাণশক্তি কেউ বুঝি শুষে নিয়েছে মন্ত্রবলে। ঘাড়ের কাছে, কানের পিছনে চামড়ার কোনো-কোনো অংশ ফুলছে বলেও মনে হচ্ছিল। কয়েকমাস পরে পা দুটোও যখন দগদগে লালচে বিন্দুতে ভরে গেল, ডাক্তার জানালেন, বিশেষ কিছুই করার নেই। সাদাকোর মেয়াদ আর মাত্র বছরখানেক।
(ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫) হাসপাতালের ঘরে ঘড়ির কাঁটা কি বড্ড আস্তে ঘোরে? সময় কিছুতেই কাটতে চায় না। পুরনো কথা মনে পড়ে সাদাকোর। বাবা-মায়ের কথা, দাদার কথা, বন্ধুদের কথা। দশবছর আগের ওই দিনটার কথাও মনে করার চেষ্টা করে সে। তখন ওর বয়েস সবে বছরদুয়েক। শৈশবের আবছা হয়ে আসা স্মৃতিতে কান ফাটানো শব্দ আর প্রচণ্ড আলোর ঝলক ছাড়া কিছুই নেই। বাকিটা মায়ের মুখে শোনা। সে নাকি ছিটকে পড়েছিল জানলার বাইরে। মা ছুটে গিয়েছিলেন। দিশাহারার মত। ধরে নিয়েছিলেন জীবিত মেয়েকে নয়, তার মৃতদেহই হয়তো বা কুড়িয়ে আনতে হবে। অথচ সাদাকোর গায়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। ডাক্তারের মতে, সেই অভিশপ্ত দিনেই নাকি সাদাকোর শরীরে ঢুকে যায় অসুখের বীজ। বহুকাল ঘুমিয়ে ছিল। এতদিনে সে জানান দিয়েছে নিজের অস্তিত্ব।… আচ্ছা, মানুষ কী আনন্দ পায় অন্য মানুষকে মেরে? কীভাবে সুখ পায়, তাদের চিরকালের মত পঙ্গু করে দিয়ে, দুরারোগ্য রোগের বীজ ছড়িয়ে? অনেক ভেবেও এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর পায় না সাদাকো। মন খারাপ হয়ে যায়।
মন ভালো করার ম্যাজিক অবশ্য একজনই জানেন। তার বাবা। এক একদিন এসে আশ্চর্য সব গল্প শোনান। মেয়েকে ভুলিয়ে রাখতে কাগজ ভাঁজ করে কত কী বানিয়ে দেন! নৌকো, মাছ, পাখি। একদিন গল্পের ছলে বলেন, হাজারটা কাগজের সারস যদি কেউ বানাতে পারে তাহলে নাকি তার যে কোনও ইচ্ছে পূর্ণ হয়। যত অসম্ভব ইচ্ছেই হোক না কেন, নাগাল পাওয়া কঠিন হয় না।
(অগাস্ট, ১৯৫৫) বাবার সেদিনের কথাগুলো খুব মনে ধরেছিল সাদাকোর। হাজারটা সারস বানাতে পারলে সেও তো তাহলে ভালো হয়ে উঠবে! স্কুলে যেতে পারবে। ছুটতে পারবে। স্কুল টিমের হয়ে মেডেল আনতে পারবে আবার। সারাটা দিন বিছানায় সে আনমনে বসে থাকে। ধীরে ধীরে সন্ধে নামে। বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে, ঘরে ফেরা পাখিদের ডানায় মিশে যায় কিশোরী সাদাকোর অন্তিম ইচ্ছে।
পরদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সাদাকো। তার বেডসাইড টেবিলে ছড়ানো দু-একটা এলোমেলো পাতা। তাদেরকে যত্ন করে ভাঁজ করতে থাকে সে, ঠিক যেমনটা বাবা দেখিয়েছিলেন। একটু পরেই বুঝতে পারে কাজটা দেখতে যত সহজ, আসলে তত সোজা নয়। তবু দশটা পাখি সেদিন সে তৈরি করে ফেলে।
হাসপাতালে সময়ের অভাব নেই। কিন্তু কোনো কোনোদিন কাগজ ফুরিয়ে যায়। এক একদিন খুব ক্লান্ত লাগে। হাত চলে না। আশেপাশের প্রায় সবাই ততদিনে জেনে গেছে তার এই খেয়ালের কথা। কেউ তাকে পৌঁছে দেয় ওষুধ মোড়ার কাগজ, কেউ আবার জমা রাখে বাড়ি থেকে আসা উপহারের মোড়ক। তার প্রিয় বন্ধু চিজুকি এনে দেয় রঙিন নকশাদার অরিগ্যামি পেপার। এমনকী নার্সদিদিরাও কোনো কোনোদিন যোগান দেয় কাগজের।
(অক্টোবর, ১৯৫৫) এইভাবে সারসের সংখ্যা বাড়ছিল। সাদা, সবুজ, গোলাপি, কমলা নানা রঙের। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সাদাকোর রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা। শেষপর্যন্ত ওরাই জিতে গেল। অরিগ্যামির সারস রূপকথার সংখ্যা ছোঁয়ার অনেক আগেই ছুটির পরোয়ানা এসে গেল সাদাকোর। অক্টোবরের এক বিষণ্ণ সকালে কাগজের খেলাঘর ফেলে রেখে একা একাই পাড়ি দিল সে। পড়ে রইল বাবা-মা, দাদা, বন্ধুরা, স্কুলের রিলে টিম আর শেষ না-হওয়া রঙিন পাখির ঝাঁক।
সাদাকোর মৃত্যুর পর তার বন্ধুরা কিন্তু ভুলল না তার ইচ্ছের কথা। সাদাকো তো আর ফিরতে পারবে না, তাই রক্তলাঞ্ছিত পৃথিবীর আরোগ্য কামনা করে কাগজের ভাঁজে ভাঁজে তারা বুনতে লাগল যুদ্ধহীন দুনিয়ার স্বপ্ন। তাদের হাতে হাতেই সারসের সংখ্যা হাজার ছুঁল। ওদের সাজিয়ে রাখা হল মাটির তলায়, যেখানে অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে সাদাকোর মরদেহ।
# # #
মাত্র বারো বছরে বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছিল সাদাকো। সাদাকো সাসাকি। জন্ম, ১৯৪৩ সালে জাপানের হিরোশিমায়। সাদাকো আক্রান্ত হয়েছিল অ্যাকিউট ম্যালিগন্যান্ট লিম্ফ গ্ল্যান্ড লিউকেমিয়ায়। জাপানের বাসিন্দাদের কাছে সেইসময় এর পরিচিতি ছিল 'অ্যাটমিক বম্ব ডিজিজ' নামে। ১৯৪৫ এর ৬ আগস্ট ‘লিটল বয়’-এর বিস্ফোরণ কেবল অগণিত মানুষের প্রাণ ছিনিয়ে নেয়নি, তেজস্ক্রিয় বিকিরণে অসংখ্য মানুষের দেহ তাদের অজান্তেই হয়ে উঠেছিল মারণরোগের কূপ। তছনছ হয়েছিল কত শিশুর আগামী জীবন। সাদাকো সাসাকি তাদেরই একজন।
আর এতক্ষণ ধরে যে আখ্যান আপনারা শুনলেন, তার অনেকটা সত্যি, আর খানিকটা গল্পকথা। সাদাকোর জীবন নিয়ে মার্কিন লেখক এলিনর কোর লিখেছিলেন আস্ত একটি উপন্যাস – ‘Sadako and the Thousand Paper Cranes’। গল্প ও বাস্তব অবশ্য সবসময় এক পথে হাঁটে না। দাদা মাসাহিরোর জবানবন্দী থেকে জানা যায়, সহজে হাল ছাড়ার মেয়ে ছিল না সাদাকো। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েই ১৯৫৫-র আগস্ট নাগাদ এক হাজার সারস তৈরি করে ফেলেছিল সে। বেঁচে থাকার এমন নাছোড় ইচ্ছেও শেষমেশ হেরে গেল মৃত্যুর কাছে। কিন্তু যুদ্ধক্লান্ত, ছিন্নভিন্ন জাপানে কিশোরী সাদাকো হয়ে উঠল শান্তির প্রতীক। হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে গেলে দেখা যায়, আজও দাঁড়িয়ে আছে সোনার সারস হাতে সাদাকোর মূর্তি। তলায় লেখা “ This is our cry. This is our prayer. Peace in the world.”
গল্পে হোক বা বাস্তবে, সাদাকো সাসাকি আসলে স্পর্ধার অন্য নাম। ধ্বংস, অপচয় আর মৃত্যুর অনিবার্যতা জেনেও বাঁচতে চাওয়ার স্পর্ধা। অলীক স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা। সাদাকো শিখিয়েছে, জীবনের চোরাগলিতে কোথাও না কোথাও মৃত্যু ওত পেতে আছেই। তা বলে বাঁচতে ভুলে যাওয়ার সত্যি কি কোনও মানে হয়?
[কভারের ছবিটি শিল্পী Standish Backus-এর আঁকা।]
#নিবন্ধ #হিরোশিমা
Nandini Daschattopadhyay
খুব ভালো লেখা।
সিদ্ধার্থ মজুমদার Siddhartha Majumdar
খুব ভালো লেখা।নিদারুণ দু:খ যন্ত্রণার এই বিধুর ঘটনার বুনোন কাহিনি আচ্ছন্ন ও ভারাক্রান্তকরল, সমৃদ্ধও করল।
Souvik Sinha
সত্য আর গল্পকথার মিশেলটা সুন্দর। এমন স্পর্ধার গল্প জানা জরুরী।
ঈশানী
নিজেকে এই একই দুনিয়ার মানুষ বলে ভাবলে একবার মুখ লজ্জায় পোড়ে আর একবার অন্তর গর্বে ভাস্বর হয়।অনবদ্য লেখা।
Sayan
Khub khub bhalo lekha :) Ei lekha jodi samanyo kichhu manushkeo bhabito kore, setai asol prapti.
Soumya
এমন লেখনীর সামনে দু'দণ্ড থমকে দাঁড়াতে হয়, নিজেকে অপাংক্তেয় লাগে।
সাগর পাত্র
এখানে এলে বারবারই নতুন কিছু জানতে পারি।