গল্প

ইউ. এস. এ কলিং

জয়িতা দত্ত Aug 2, 2020 at 3:32 am গল্প



- হ্যালো, হ্যালো… নিরুদা শুনছ … হ্যালো নিরুদা !!!
নিরুপম শীতল চোখে কুট করে লাইন কেটে দিল। সকাল সাতটা থেকে এগারোটার মধ্যে এই নিয়ে তিনবার। মাসতুতো বোন কলাই। মানে কল্যাণী। বিরাটির বেশ নামকরা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ইংরেজির টিচার। সত্যি কথা বলতে টিচার ছিল। আপাতত সাসপেন্ডেড। বছরখানেক মাথার গণ্ডগোলে ভুগছে। রেগে গেলে মাত্রাছাড়া হয়ে যায়। নিজে ভুগছে আর শতগুণ ভোগাচ্ছে অরিন্দম আর একরত্তি নেহাকে। ট্রিটমেন্ট চলছে। দেখা যাক কী হয়। আবার মোবাইল সংগীত। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে… যখন পড়বে না মোর…’। মোবাইলের ঝাঁ চকচকে দেওয়ালে সবুজ আলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটে উঠছে কলাইয়ের নাম। কলাই কলিং। কলাই কলিং।
- হ্যাঁ বলছি। নিরুপমের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকল। ভয়াবহ গম্ভীর। চোখ মুখ বিরক্তিতে কোঁচকানো। দৃষ্টি তেরছা সরু। গোঁফের ফাঁকে ঝুলন্ত উষ্মা। অথচ নিরুপম তো এমন ছিল না। এই গত পরশু পর্যন্তও না। কলাইয়ের প্রতি যথেষ্ট মমতাসম্পন্ন। কলাই কেন, আত্মীয়-স্বজন সকলের প্রতি। কিন্তু দু-দিন হল সংসারের আদেখলেপনা দেখে ঘেন্না ধরে যাচ্ছে।
ওপাশ থেকে কলাইয়ের উদ্বেল কণ্ঠ।
- ব্যস্ত আছ নাকি গো নিরুদা?
- হ্যাঁ হ্যাঁ। যা বলবার তাড়াতাড়ি বল।
- বলছিলাম কী… সেজমামা ঠিক কখন আসবেন… তোমাদের বাড়ি?
- একবার বলেছিলেন বিকেলের দিকে। দেখা যাক।
- বিকেলবেলা আমি আর অরিন্দম একবার যাব গো দেখা করতে?
ডাইনিং হলের কর্নার ওয়ালে কারুকার্য করা পাথরের তাক থেকে ল্যান্ডফোন বাজতে শুরু করল।
- একটু ধর তো কলাই… একটা ফোন এসেছে…
হ্যালো, হ্যাঁ… অ্যাঁ, কে, ওহ রিপুদি। বলো কী ব্যাপার।...সেজমামা!! ইয়েস। হি উইল কাম। বাট কখন ঠিক জানি না।..কী বলছ? বললাম তো জানি না। হতে পারে আজ সন্ধ্যায়। না। এখানে অসুবিধা আছে। মামা পরশুদিন ছোটমাসির বাড়ি যাবেন। ওখানেই দেখা করে নিও।
মেজাজটা এখন আগুন নিরুপমের। সভ্যতার লেভেল-ক্রসিং পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। হাতে ধরা মোবাইল কানের কাছে পৌঁছতেই বোঝা গেল উদ্বিগ্ন কলাই ওপাশে ঘাপটি মেরে।
- নিরুদা কে গো?
- রিপুদি। সেজমামা এখানে আসছেন শুনেই কাঠবিড়ালির মতো লাফাচ্ছে। আসতে চাইছে।
- তুমি তো আসতে দিলে না শুনলাম।
- ঠিকই শুনেছিস।
- কেন গো? - কলাইয়ের স্বরযন্ত্র খাদ ভেঙে খানিকটা চড়ায়।
পাত্তা দিল না নিরুপম। কেটে কেটে বলল – খুব কম সময়ের জন্য সেজমামা আসছেন। আমরা তিনজনে একসঙ্গে জাস্ট খানিকক্ষণ আড্ডা মারব। রাতে ডিনার সেরে মামা ফিরে যাবেন। নিপুণের অ্যানুয়াল এক্সাম সামনে। এই সপ্তাহে বাড়িতে গ্যাদারিংটা ঠিক চাইছি না।
- কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছ গো নিরুদা। তুমিও কাউকে আসতে দিচ্ছ না। ছোটমাসিও দিচ্ছে না। তোমরা পেয়েছটা কী…! আমারও নিজের ব্যাপারে কিছু বলবার ছিল। আই উড নট টেক লট অফ টাইম।
নিরুপম ভূতগ্রস্তের মতো নির্বিকার। - না রে। হবে না।
- কেন হবে না ! এবার তারস্বরে চেঁচাচ্ছে কলাই। হবে না কেন শুনি? তোমার ধান্দা গুটোতে অসুবিধে হবে, তাই??
- এ কী? সাপের মতো ছোবলাচ্ছিস কেন তুই? শোন…
কিন্তু এখন খেপে আগুন কলাই। কোনও কথায় নো কর্ণপাত। মাথার ব্যামোটা মনে হয় চাগাড় দিল।
- আমেরিকা বায়ু চড়েছে না তোমার ? ওখানে সেটল করবে? সেজমামাকে হাতে পায়ে ধরে একটা হিল্লে…
- চোপ! ডোন্ট টক রাবিশ! পেল্লায় ধমকে কলাই চুপ করে গেছে।
- শোন কলাই,আমি আর তোর বউদি যে স্ট্যাচারের সার্ভিস করি না, তাতে অন্য কোনও দেশে গিয়ে ফ্রিলান্সার হবার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই অন্য কোনও ধান্দার কথা মনেও আনিস না। বাই দ্য ওয়ে, সাইকিয়াট্রিক মেডিসিনগুলো ঠিকঠাক নিচ্ছিস তো?
ডাক ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে ফোন কেটে দিল কলাই।



নীহারকান্তি সেনগুপ্ত। যেন সাক্ষাৎ এক কল্পতরু। অথবা পেটভর্তি সোনার ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ানো রাজহাঁস। পর্বতময় স্বপ্নভুবনের সুনীল সরোবরে যিনি কেলি করেন। আর এদিকে – বুভুক্ষু তাপিত জীবরূপী আত্মীয়কুল কত যোজন বায়ুস্তর নীচে ক্লেদ জীবন কাটাচ্ছে। সংসারের পাকে পাকে জড়িয়ে আছে অবসন্ন শৈবালদামের মতো। মধ্যে মধ্যে ডাক-ব্যবস্থার কল্যাণে কিছু স-ডলার আশীর্বৃষ্টি ঘটে কারো কারো অদৃষ্টে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ক্ষণিকের অরুণাভের মতো দূরভাষ যোগে কিঞ্চিৎ দৈববাণীর পরশ পায় কেউ কেউ। তারই মাধুর্যে মামারবাড়ি মাসিরবাড়ি নির্বিশেষে তাপিত মর্তলোক ধন্য ধন্য – সাধু সাধু - উদ্গার তুলতে থাকে। আজন্ম এই ভদ্রলোককে ‘দ্য গ্রেট আইকন’ হিসাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে নিরুপম সহ অজস্র তুতো ভাইবোনের কোমল হৃদয়ে। গাঁথনির কর্তব্য অত্যন্ত দায়িত্বের সঙ্গে পালন করেছেন সমগ্র মাতুল পরিবার। অতঃপর একে একে নিভিছে দেউটি। দিদা মা মাসি মামারা ইহলোক ছেড়েছেন। কেবল পড়ে আছেন ছোটমাসি এবং তামাম গুরুজন-প্রদত্ত ‘মামানামামৃত মন্ত্র’। সেই মন্ত্রই জপে চলেছে নিরুপম অ্যান্ড কোম্পানি। স্বভাবতই আমেরিকা-প্রবাসী মাতুল মর্তাসীন হলেই এদের মোচ্ছব। নাম-সংকীর্তন। শুধু একটাই তফাত। উৎসবে মানুষে মানুষে যত পারো মেলো-মেশো-হাসো-খেলো। কিন্তু মামা-উৎসবে সবার সঙ্গে আড়ি। আড়ি মানেই আড়ি পাতবার সাংঘাতিক ধুম।




কলাইয়ের সঙ্গে প্রবল এক পশলা বিবাদ বর্ষণ হয়ে গেল। নিরুপমের মুখখানা এখন আসন্ন কালবৈশাখী প্রকৃতির মতো থমথমে। উপমার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বাজার করা প্যান্টেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে গুষ্টির বাপান্ত করছে। শালারা কী সুযোগসন্ধানী! এমনিতে সব রোগের ডিপো। নড়তে পারে না। যার যত দরকার আমি ছুটছি। আর এখন ধেয়ে আসবার জন্য ব্যস্ত। নো অসুখ। নো বাত। নো মেন্টাল ডিজিজ…!
ভাবতে ভাবতে সবে চোখটা লেগেছে। উপমার ফোন। সেরেছে। আজ আবার তাড়াতাড়ি ফিরবে নাকি কে জানে। গলায় নিজের অজান্তেই মধু মিশে গেল - তুমি কোথায় এখন? উল্টোদিকে যথারীতি গাম্ভীর্য। এই কেসটাই রেগুলার হচ্ছে। উপমার মর্নিং কলেজ। কলেজে থাকাকালীন ফোন করলেই একটা আর্টিফিশিয়াল অ্যাটিচিউড দেখায়। এখনও তাই। চাপা গলায় বলল
- আমি যেখানেই থাকি, তুমি কী করছ?
- আমি… আমি এই তো সবে বাজার করে ফিরলাম। ফ্রিজে মাছ-মাংস গুছিয়ে তুললাম। ডলি কেটে পড়েছে। অনুও আসেনি। কাজের লোক দুটো যা হয়েছে না। এবার বাথরুমটা ওয়াশ করব। রেডি হচ্ছি।
ফোনের ওপ্রান্তে কৃতজ্ঞতাশূন্য প্রভুকণ্ঠ।
- ঝুল ঝাড়া হয়েছে?
ধাঁ করে মাথা ঘুরিয়ে নিরুপম চকিতে একবার দেখে নিল ঘরের কোণগুলো। অনায়াসে বলে দিল – ইয়েস ম্যাম।
তারপর আরো দু-তিন মিনিট উপমার ইন্সট্রাকশন চলল। কোনোরকমে হুঁ হাঁ করে মোবাইল সুইচড অফ করল নিরুপম। করা হয়নি। কিচ্ছু করা হয়নি। না ঝাড়া হয়েছে ঝুল। না হয়েছে বেসিন ঘষা। না হয়েছে বাথরুম ক্লিনিং। দৌড়োদৌড়ি করে এবার কাজ করতে থাকে। শুধু মেঝের অ্যান্টিস্কিড টাইলস ঝকঝক করছে। হাজার স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটের ফ্লোরে পিছলে যাচ্ছে বসন্তের রোদ। উপমার দায়িত্ব ছিল এটা। গতকাল ঠিক সময়মতো সনাতন সবজিওয়ালার ডিগডিগে হেল্পারটার হাতে একশো টাকা গুঁজে করিয়ে নিয়েছে। রাঁধুনি ডলিকে সঙ্গে নিয়ে কিচেনের মেঝে স্ল্যাব ফ্রিজ তকতকে করেছে। এমনিতেও অবশ্য নিরুপম কোথাও কোনও ময়লা টের পায় না। ক্লিনিং-এর আগে পরে সবই একরকম লাগে। শুধু যখন উপমা গর্জায়, বাড়িটা একেবারে নরক হয়ে গেল, তখন বোঝে সূক্ষ্ম কোনও গণ্ডগোল ঘটে গেছে নিশ্চিত।





লাঞ্চ সারতে সারতে বেলা সাড়ে তিনটে বেজে গেল। ইতিমধ্যে উপমা গৃহ প্রসাধনে ফিনিশিং টাচ দিয়েছে। বেডকভার-পর্দা-কুশন কভার সবই পাটভাঙা। এভ্রিথিং বদলে ফেলা। পুরনোগুলো ওয়াশিং মেশিনের পেটে-ভরে চারপাশে আনকোরা জৌলুশ। রাঁধুনি এসে গেছে। রান্নাঘরে আজ বিচিত্র সব দেশি বিদেশি মেনু। ইউটিউব ট্রেনিং-এ। পুরোটাই অবশ্য ভেজ। সেজমামার নন-ভেজ চলে না। নিরুপম ড্রইংরুমের ডিভানে আধশোয়া। উপমাকে ডেকে বলল - বুঝলে, এত ঝামেলার মধ্যে যেও না। সেজমামার বয়স কত বলো তো?
উপমা কাস্টার্ড ফ্রিজে ঢোকাচ্ছে।
- তোমাকে সেসব ভাবতে হবে না। মামাকে একবার নক করে নাও। তোমাকেই তো নিয়ে আসতে হবে।
- করছি করছি। ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এই তো সবে সকালে পৌঁছলেন। এখন পুত্রের শ্বশুরালয়ে একটু আদরযত্ন …
- বেশি কথা বোলো না। শোনো সেজমামাকে আজকের রাতটা আটকে দাও। একবার তোমার ছোটমাসির খপ্পরে পড়লে…
- সে তো বটেই। কী নির্লজ্জ হয়ে গেছে জানো – ফুলদার কাছে শুনলাম নিজের বড় ছেলে মানে অভির যোধপুরের ফ্ল্যাটটা সেজমামাকে দিয়ে ফার্নিশড করাবে ভাবছে।
- কী বলছ গো? …
সর্বান্তঃকরণে আঁতকে উঠেছে উপমা। ওর কপট গাম্ভীর্য এক ধাক্কায় উধাও। এতক্ষণে বেশ জীবন্ত দেখাচ্ছে। সুযোগ বুঝে ঝুলি খোলে নিরুপম।
- আরে তাই তো বলছি। সকাল থেকে একের পর এক ফোন। কলাই, তপুদি, রিপুদি, ফুলদা, ওদিকে মুকুন্দপুর থেকে বড়দা, বড়বউদি… ইভন লোপা।
- ঐ স্নব মেয়েটা, তোমার মাসতুতো ভাইঝি?
- আরে রাখো… সেজমামা আমার কাছে আসছেন শুনে স্নবারি ছুটে গেছে।
উপমা হাউজকোটে হাত মুছতে মুছতে এই প্রথম পাশে বসল। মুখটা এত খাটুনির পরেও আশ্চর্য চকচকে। পেলব। পার্লার ঘুরে এসেছে। শিওর। বড় বড় চোখ করে উপমা বলল –
- আর আমাকে কে ফোন করেছিল বলো তো? … তোমার নিজের বোন।
- কী বলছে?
- যেমন বলে… বাঁকা বাঁকা কথা। শুধু ডিসস্যাটিসফ্যাকশন। আর সবেতেই সন্দেহ। ইঙ্গিতে বলছিল ও নাকি জানে আমরা কেন সেজমামাকে ডেকেছি।





গত দু-দিনে সেজমামাকে অন্তত তিনবার আই এস ডি করেছে। দিল্লিতে আসবার পরেও নিরুপম ফোনে কথা বলেছে। আসতে রাজি হয়েছেন মামা। কোনোদিন আসেননি। এই প্রথম। কার বাড়িতেই বা গেছেন। কালেভদ্রে কখনও এলে ছেলের শ্বশুরবাড়িতেই ওঠেন। সল্টলেকের অট্টালিকায়। আত্মীয়কুল খবর পেলে সেখানেই দেখা করতে যায় সন্তর্পণে। কুণ্ঠিত ব্যাকুল মুখে মামার চরণকমল ছোঁয়। শুধু ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকে ছোটমাসি। আর মেজমাসির দুই মেয়ে। নিরুপম অ্যাদ্দিন বিশেষ গুরুত্ব দিত না। কিন্তু এবার উঠে পড়ে লেগেছে। ঠিক করেছে ভি. আই. পি রোডের ওপর দক্ষিণ-পূর্ব খোলা এই বিশাল ফ্ল্যাটে একবারের জন্য নিয়ে আসবে মামাকে। মামাও এককথায় রাজি হয়েছেন।
পরশু রাতে নিপুণকে পড়া থেকে তুলে গুগল ম্যাপ খুলে বসেছিল নিরুপম। ল্যাপটপের স্ক্রিনে হুমড়ি খেয়েছিল তিনজনেই। নেট সার্চ করে খুঁজে বের করেছিল সেই অপার্থিব ঠিকানা। প্রাসাদ-দ্বারে ঝকঝকে নেমপ্লেট। N. K Sengupta Ph.D / Jay D. Sengupta MD. 190 Grovelland Road. Minneapolis. MN 55403.
কী গহন – কী সবুজ – অরণ্যমধ্যবর্তী এই আশ্চর্য উপত্যকা। তারই মধ্যিখানে ওই অট্টালিকা। পর্বতের খাঁজে খাঁজে কত নাম না জানা বৃক্ষ। মাথায় মাথায় ঠেকে তৈরি করেছে রাজতোরণ। যেন নমস্কারের যুগ্ম কর। যেন গথিক চার্চের আর্চশেপ। গাছে গাছে ঘন কচি সবুজ পাতার ছাউনি। লতায় লতায় পুষ্পকোরক। আর সবকিছুর ওপরে স্বর্গীয় বরফের ফিনফিনে প্রচ্ছদ। টাচপ্যাডে হাত ঘুরছে বনবন। সম্মিলিত দৃষ্টির একাগ্রতাকে কুর্নিশ জানিয়ে কারসর তার সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করছে। নন্দনভূমির মধ্যিখান থেকে তুলে এনেছে পিয়ানো বাদনরত সহাস্য সেজমামার মুখ। গান গাইছেন মামা।
- দেখ – দেখ নিপুণ, দেখ, এই তোর সেজদাদু। দেখিসনি তো কোনোদিন। এইবার দেখবি… আসবেন উনি আমাদের বাড়ি।
আপ্লুত নিপুণ। উপমাও। ওই এক মহামানব… দিকে দিকে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে তিনি আসবেন। মায়াবী সেই রাতে আবারও একই পদ্ধতিতে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়ে গেল নীহারকান্তি-শেকড়।
উপমা এখনও কিচেনে। রান্নাবান্নার তদারকি চলছে উচ্চগ্রামে। একটু আগে ডলিকে ধমকাচ্ছিল। নিশ্চয়ই কোনও ভুলচুক নজরে পড়েছে। সিস্টেমের কোনও গণ্ডগোল দেখলেই রি রি করে ওঠে উপমা। দূর থেকে চেঁচাল – কী হল, ফোনটা করা হয়েছে?
টুথপিক নিয়ে ডিভানে সবে গা এলিয়েছে নিরুপম। এখন সাড়ে চারটে। মামা হয়তো ঘুমিয়ে। ধকল তো কম হয়নি। থাক না! একটু দেরি হলে কী! আজকের রাতটা তো মামা এখানেই। তাড়া কীসের কে জানে। - একটু দাঁড়াও। আমি ঠিক সময়ে ফোন করব।
উপমার সবুর সয় না। দ্রুতপায়ে ড্রয়িংরুমে হাজির।
- আমি বলছি আগে করো। বিদেশিদের টাইমজ্ঞান টনটনে। প্রবাসীদের আরও বেশি। সময় ঠিক না থাকলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দেবেন।
নিরুপম নিমরাজি। - ও মোবাইলটা।…
- রিং হচ্ছে – ধরেননি। চেঁচাল নিরুপম। তোমাকে বললাম না মামা রেস্ট নিচ্ছেন! সব ব্যাপারে তোমার ব্যস্ততা।
এখন আর প্রত্যুত্তর নেই। রান্নাঘরে বাসনের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে ডিনারসেট প্রক্ষালন পর্ব চলছে। নিরুপম নিশ্চিন্তে শুল… একটু ছোট্ট করে ভাতঘুম সেরে নেবে। আর তখনই ফোন। তড়াক করে উঠে পড়েছে।
ইয়েস। সেজমামা। ভক্তির ঢেউয়ে আপাদমস্তক ডুবুডুবু। ইসস্। আমার জ্বালাতনে বেচারি একটু ঘুমোতেও পারলেন না। গদগদ কণ্ঠ নিরুপম।
- হ্যালো সেজমামা, ঘুমোচ্ছিলে নাকি গো?
ও পাশে নারীকণ্ঠ। খানিক ঘুম জড়ানো… খানিক বিরক্ত –
- হু আর য়্যু?
চূড়ান্ত থতমত নিরুপম।
- আই অ্যাম নিরুপম। মে আই স্পিক টু সেজমামা, আই মিন নীহারকান্তি সেনগুপ্তা?
- সরি, হি’জ লেফট।
আঁতকে উঠে… হোয়াট…?? বেরিয়ে গেছেন? কোথায় গেছেন? বুলেটের মতো মাতৃভাষা ছুটে গেল চর্চিত বুদ্ধির আগল ভেঙে।
- ইয়েস…!!
নিরুপম কাঁপছে… হাই ভোল্টেজ দ্রুত ডিপ করে যাচ্ছে।
- ডু য়্যু নো হোয়ার হি গন?
- নো, আই ডোন্ট নো। বাট আই থিঙ্ক হি মে গো টু হিজ রিলেটিভ…।
রিলেটিভ। মানে আত্মীয়। কে সে…আমি নয়? আমি তো নয়ই। আমার ঠিকানাই জানেন না… তার মানে অন্য কেউ…।
এ কি হতে পারে নাকি? দুশ্চিন্তার দুরন্ত ঘূর্ণি গুমগুমিয়ে উঠছে হৃৎপিণ্ড ভেদ করে।
- লিসন লিসন… হ্যালো, ডিড হি টেল য়্যু হোয়ার হি ওয়াজ গোয়িং…
- আই অ্যাম নট ভেরি শিওর, আই গেস, সাম অ্যাকোয়েনটেন্স…
- ইজ দিস হিজ কনট্যাক্ট নাম্বার?
- নো
- মে আই গেট হিজ কনট্যাক্ট নাম্বার… প্লিজ...!!





নম্বর নেওয়া হয়ে গেছে। তবে নীহারকান্তিকে ফোনাফুনি করতে আর ইচ্ছে করেনি। ফুলদা-কে ফোন করে জেনে নিয়েছে সবকিছু। পৃথিবীর অন্তিম কিনারায় দাঁড়িয়ে ওই সেজমামা নামের লোকটা দানবের শক্তিতে নিরুপমকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ধরিত্রীর গভীরতম খাদে। রাশি রাশি আত্মীয়-স্বজনের কোলাজ ওকে লক্ষ্য করে কোরাসে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গাইছে। সামনে ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায় বিদেশি ফুলের প্রদর্শনী। মনে হচ্ছে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলে। এরই মধ্যে স্কুলফেরত নিপুণ লাফাতে লাফাতে হাজির। ঘামে ভেজা স্বপ্নমুখ। প্রচণ্ড উত্তেজিত। - বাবা বাবা, মা জিগ্যেস করছে দাদুকে ফোন করেছ…?
- হুম।
উপমাও এসে গেছে। গণ আদালতে আসামি নিরুপমকে এবারে নাঙ্গা করা হবে। ফালতু সময় নষ্ট না করে স্ট্রেট ব্যাটে খেলল। এক নিশ্বাসে স্কাউন্ড্রেল-অপারচুনিস্ট-লায়ার বলে গালাগাল করল। পরে বোঝা গেল – ছোটমেসোকে। কারণ তিনিই সেজমামাকে হাইজ্যাক করেছেন। ছোটমাসির শরীর খারাপ। তাই মি. সেনগুপ্ত এখন হরিদেবপুরের পথে। বোনের বাড়ির উদ্দেশে।
- কী বলছ গো!! আর্তনাদ উপমার।
অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ – ঘ্যানঘ্যানিয়ে কাঁদবে নিপুণ। একবগগা জেদি ঘোড়ার মতো বেখাপ্পা নিরুপম।
- ঠিকই বলছি। ছোটমাসি নাকি কালকে দুবার ডিগবাজি খেয়েছে।
কান্না ভুলে নিপুণ হেসে কুটিপাটি। - বাবা, ছোটঠাম্মা ডিগবাজি খেতে পারে?
উপমা পরিস্থিতি সামলাচ্ছে নিজস্ব কায়দায়।
- না বাবা, ডিগবাজি হল কথার কথা। মানে হল – ছোটঠাম্মা মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।





নক্ষত্রঝড় থেমে গেছে। বুকের ভেতর দাপিয়ে বেড়ানো আক্ষেপ-আক্রোশ-অসহায়তা মৃত কুমিরের খোলের মতো শীতল। ঘুমিয়ে পড়েছে নিরুপম। আর সুষুপ্তির রহস্যাচ্ছন্ন পথ ধরে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেছে মিনেসোটা মিনিয়াপোলিসে। খুঁজতে খুঁজতে হাজির হয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ইতিউতি ঘুরঘুর করে ঢুকে পড়েছে বৃক্ষতোরণ গলে। প্রাসাদ দরজা ঠেলে সটান রূপকথা-পিয়ানোর সামনে। এখনও গান গাইছেন সেজমামা। শ্যামাসংগীত! আহা… কী মধুর! সকলি তোমারি ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি…। কী স্মিত সাত্ত্বিক সহাস্য বদন! প্রতিবাদ জানাবে কী… আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে নিরুপম। ভক্তির অনন্তকম্বলের নীচে কে যেন টেনে নিচ্ছে ওকে। গোটা দুনিয়া ভোঁ ভোঁ করে দুলছে। নিরুপম যেন নরেন… সামনে প্রেমাবতার পরমহংস…। নরেনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। হাস্কি স্পিরিচুয়াল ভয়েস। বিরাট হলঘর তরঙ্গিত সে কণ্ঠস্বরের মাদকতায়।…
- আয়-আয় আমার কাছে আয়… কী চাই তোর আমায় বল…
একদম ভুলে গেছে নিরুপম, কী চাই। কেঁদে লুটিয়ে পড়ছে ও পদকমলে।
- আমি জানি না…জানি না…। সত্যি ভুলে গেছি। উপমা জানে। কলাই জানে। টুম্পা-রিপুদি-ফুলদা ওরা সব জানে…।
মামার স্মিত হাসিতে অন্তর্ভেদী পাঠ। - আমেরিকায় তিনখানা বাড়ি আমার। নিবি একখানা? সজোরে মাথা নাড়ছে নিরুপম। না না।
- তোর ছেলে, কী যেন নাম, পড়াবি , আমার এখানে রেখে… ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেব…
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিরুপম শুধু বলছে না- না- না- না। বলছে – আমাকে জ্ঞান দাও… ভক্তি দাও… চৈতন্য দাও।
আর এরই মধ্যে উপমার ধাক্কা।
- আরে ওঠো ওঠো… ফোনটা ধরো তাড়াতাড়ি… সেজমামা নতুন নম্বর থেকে ফোন করেছেন… তোমাকে চাইছেন।
চোখ মেলেছে নিরুপম। একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। প্রশান্ত বৈরাগ্য দৃষ্টি। কণ্ঠস্বরে আশ্চর্য বলিষ্ঠতা।
- উপমা, কয়েকটা ফোন করতে হবে… তাড়াতাড়ি। কলাই। রিপুদি। ফুলদা। আর লোপা…। আজ সন্ধেয় আমাদের এখানে একটা গেট টুগেদার হবে।




অলংকরণ - শুভংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

#

  • Sravani Ray
    Aug 7, 2020 at 12:24 pm

    কতদিন পরে আবার সেই পুরোনো স্বাদ। কিন্তু জীবন কি পাবো ফিরে?

  • Durga ghoshal
    Aug 2, 2020 at 2:52 pm

    অপূর্ব লেখা।বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।

  • Suvasis Guha
    Aug 2, 2020 at 1:36 pm

    দুর্দান্ত, অতুলনীয়!! 🌟

  • Soumya
    Aug 2, 2020 at 7:03 am

    দারুণ! দারুণ! একেবারে বাস্তব উঠে এসেছে!

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

84

Unique Visitors

229263