বিচার
জীবনে এর চেয়ে অদ্ভুত কোনো খুনের মামলার বিচারে আমি কখনও উপস্থিত থাকিনি। যদিও কাগজের হেডলাইনে ‘পেকহ্যাম খুন’ নামে ঘটনাটা ঝড় তুলেছিল, কিন্তু আসলে নর্থউড স্ট্রিট – মানে যেখানে ওই বৃদ্ধাকে পিটিয়ে, থেঁতলে খুন করা হয়েছিল – ঠিক পেকহ্যাম এলাকার মধ্যে পড়ে না। এ এমন মামলা ছিল না যেখানে অকুস্থলে পড়ে থাকা আনুষঙ্গিক চিহ্ন ছাড়া খুনির বিরুদ্ধে আঁটোসাঁটো প্রমাণ বলতে কিছুই থাকে না। সেই সব মামলায় জুরিরা উদ্বিগ্ন মনে ইতস্তত করতে থাকেন – কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না – কারণ তাঁরা জানেন যে ব্যাপার যখন এই রকম ঘোরালো তখন কোথাও না কোথাও ভুলচুক নিশ্চয়ই হয়েছে। আর গোটা আদালতের দম বন্ধ হয়ে আসে।
নাহ্! এই মামলায় খুনি কে স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল মৃতদেহের পাশেই। রাজপ্রতিনিধি সরকারি উকিল যখন মামলার পুরো কাহিনি খুলে বলছিলেন তখন আদালতে উপস্থিত একজনেরও মনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার বাঁচার আর কোনো রাস্তা খোলা আছে বলে কোনো সন্দেহ ছিল না। ভারভার্তিক, শক্তপোক্ত চেহারা লোকটার। ড্যাবড্যাবে চোখদুটো রক্তের মতো রাঙা। শরীরের সব মাংস যেন পায়ে গিয়ে জমা হয়েছে তার। এক কথায় কুৎসিত দেখতে। এ চেহারা একবার দেখলে চট করে ভোলার নয়। এইটা মনে রাখার মতো কথা, কারণ যে চারজনকে প্রধান সাক্ষী হিসেবে সরকারি উকিল হাজির করলেন তাঁদের প্রত্যেকেই এই চেহারাটিকে অকুস্থলে একবার দেখার পর আর ভুলতে পারেননি। এই প্রত্যক্ষদর্শীরা এই লোকটিকেই নর্থউড স্ট্রিটের ওই লাল ভিলা থেকে বেরিয়ে পালাতে দেখেছিলেন। ঘড়িতে তখন রাত দুটো বাজছিল।
১৫ নম্বর নর্থউড স্ট্রিটের মিসেস স্যামনের ঘুম আসছিল না। হঠাৎ দরজার ‘খট’ শব্দ শুনে তিনি ভাবলেন তাঁরই দরজায় বুঝি আওয়াজ হল। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবেন বলে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি দেখেন মিসেস পার্কারের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে অ্যাডামস (হ্যাঁ, ওটাই কাঠগড়ায় দাঁড়ানো এই ব্যক্তির নাম)। সবেমাত্র বেরিয়েছে সে। তার দস্তানা পরা হাতে ধরা একটা বিরাট হাতুড়ি যেটা সে পাশের লরেল ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল। কিন্তু সরে পড়ার আগে খচ করে একবার মুখ তুলে সে তাকাল মিসেস স্যামনের জানলার দিকে, তার মুখের উপর সটান এসে পড়ল রাস্তার আলো। কেউ আমাদের একদৃষ্টে খেয়াল করতে থাকলে মনে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় না? মিসেস স্যামনকে মুখ দেখানোর জন্য অ্যাডামসের সেই অনুভূতিটাই দায়ী। রাস্তার আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখলেন তার ড্যাবড্যাবে চোখ ফেটে পড়ছে জান্তব আতঙ্কে – ঠিক যেমনটা কোনো পশুর চোখে ফুটে ওঠে তার সামনে চাবুক আছড়ালে। পরে আমি নিজে মিসেস স্যামনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এই মামলার অতি বিচিত্র রায়ের পর তিনি নিজেও ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন।
মনে হয় শেষতক একই রকম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন অন্যান্য সাক্ষীরাও। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হেনরি ম্যাকডুগাল, যিনি সেইদিন অত রাত্রে বেনফ্লিট থেকে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলেন। নর্থউড স্ট্রিটে একটা মোড় ঘুরতেই হঠাৎ তাঁর গাড়ির সামনে চলে আসে অ্যাডামস। কেমন যেন ছন্নের মতো রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল সে, আর একটু হলেই ম্যাকডুগাল তাকে গাড়ি-চাপা দিয়ে ফেলতেন। আরও ছিলেন মিসেস পার্কারের পাশের ১২ নম্বর বাড়ির বৃদ্ধ মিঃ হুইলার। গভীর রাত্রে চেয়ার-জাতীয় একটা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে – ভিলার পাতলা দেওয়াল ভেঙে ভারী কোনো জিনিস পড়লে যে রকম শব্দ হয় – তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনিও মিসেস স্যামনের মতোই জানলার ধারে ছুটে গিয়ে দেখেন অ্যাডামস বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে দেখতে পেয়েছিলেন শুধু অ্যাডামসের পিঠটা, তারপর সে মোড় ঘুরলে তাঁর নজরে পড়ে তার মার্কামারা ব্যাঙের মতো চোখ দুটো। লরেল অ্যাভিনিউতেও একজন অ্যাডামসকে দেখেছিল। ভাগ্য সেদিন একেবারেই তার সঙ্গে ছিল না, যা দেখা যাচ্ছে। এর চেয়ে সে প্রকাশ্য দিবালোকেই খুনটা করতে পারত – রাতের অন্ধকারে খুন করার তো কোনো অর্থই রইল না আর!
সরকারি অর্থাৎ বাদীপক্ষের উকিল বললেন, “আমরা বুঝতে পারছি যে প্রতিবাদীপক্ষ বলবে— সবটাই চোখের ভুল। সে রাতে সেখানে অন্য কেউ ছিল, অ্যাডামস নয়। অ্যাডামসের স্ত্রীও হয়তো বলবেন, ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাত দুটোর সময় অ্যাডামস বাড়িতে তাঁর সঙ্গেই ছিল। কিন্তু আপনারা সাক্ষীদের কথা শুনলেন, সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আপনাদের সামনে রয়েছে, এবং সর্বোপরি আসামির চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলিও আপনারা নিজের চোখেই দেখছেন। আমার মনে হয় না এখানে দৃষ্টিবিভ্রমের কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে আপনারা মেনে নেবেন।”
এই কথার পর মামলা প্রায় শেষ বলে ধরে নেওয়াই যেতে পারে, তাই নয় কি? শুধু ফাঁসিটা হওয়া বাকি।
মৃতদেহ প্রথম দেখেছিলেন যে পুলিস এবং পরীক্ষা করেছিলেন যে ডাক্তার, তাঁরা তাঁদের সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন। তারপর আবার তলব পড়ল মিসেস স্যামনের। কথায় হালকা স্কচ টান, হাবেভাবে সততা, করুণা আর আন্তরিকতার প্রতিমূর্তি – তিনি হচ্ছেন যাকে বলে একেবারে আদর্শ সাক্ষী। সরকারী উকিল মিসেস স্যামনের মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো গল্পটা সাজিয়ে নিলেন। কথা বলার সময় তাঁর মধ্যে কোনো জড়তা দেখা গেল না। কোনো অসূয়ার ভাবও নেই তাঁর মধ্যে। তিনি যা বলছেন লাল জোব্বা পরা বিচারক একমনে তা শুনে যাচ্ছেন আর আশপাশে থাকা সাংবাদিকের দল খসখস করে তা লিখে নিচ্ছে। কিন্তু এসব কিছু যেন খেয়ালই না করে দৃঢ়ভাবে তিনি বলে গেলেন কী ভাবে ওই দৃশ্য দেখামাত্রই একছুটে নীচে একতলায় নেমে তিনি থানায় ফোন করে খবরটা দিয়েছিলেন।
“ওই যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, দেখতে পাচ্ছেন?”
মিসেস স্যামন সোজা তাকালেন তাঁর উল্টোদিকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে, যে তার চিনেম্যানদের মতো কুতকুতে চোখ মেলে তাঁরই মুখের দিকে চেয়ে ছিল।
“হ্যাঁ,” তিনি বললেন, “এই সেই লোক।”
“আপনি নিশ্চিত?”
“আমার ভুল হতেই পারে না,” সহজ গলায় তিনি উত্তর দিলেন।
এইবার প্রতিবাদীপক্ষের উকিলের পালা, তিনি সাক্ষীকে ক্রস এক্সামিন করতে উঠে দাঁড়ালেন। আমি আন্দাজ করছিলাম উনি কোন পথ ধরতে চলেছেন। আমার মতো এতগুলো খুনের মামলার এজলাসে সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে থাকলে যে কেউই আন্দাজ করতে পারবে। দেখা গেল আমার আঁচ ভুল ছিলও না— একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।
“মিসেস স্যামন, একজন মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে আপনার সাক্ষ্যের উপর— আশা করি আপনি জানেন সেটা?”
“জানি স্যার।”
“আপনার দৃষ্টিশক্তি ভালোই, কী বলেন?”
“জীবনে কোনোদিন চশমা পরতে হয়নি আমায়।”
“আপনার বয়স তো পঞ্চান্ন?”
“ছাপ্পান্ন, স্যার।”
“আর তখন বাজছিল রাত্তির দুটো। সত্যি, আপনার চোখের জোর আছে বলতে হবে মিসেস স্যামন!”
“না স্যার। চাঁদের আলো ছিল তখন। আর লোকটা যখন মুখ তুলে তাকিয়েছিল তখন ওর মুখে রাস্তার আলোও পড়েছিল।”
“আর আপনার মনে কোনো সন্দেহই নেই যে তখন যাকে আপনি দেখেছিলেন সে এই আসামিই— কি, তাই তো?”
আমি বুঝতে পারছিলাম না ভদ্রলোক ঠিক কী বলতে চাইছেন। আর কোন উত্তর তিনি আশা করেন ভদ্রমহিলার থেকে?
“বিন্দুমাত্র না স্যার। ওই মুখ একবার দেখলে কেউ ভুলতে পারে না।”
উকিলবাবু একবার চোখ ঘুরিয়ে গোটা এজলাসটা দেখলেন। তারপর বললেন, “মিসেস স্যামন, একটু কষ্ট করে একবার এই ঘরের লোকেদের দিকে একটু তাকিয়ে দেখবেন? না না, আসামীকে দেখতে বলিনি। মিঃ অ্যাডামস, একবার উঠে দাঁড়ান তো।”
বলার সঙ্গে সঙ্গেই আদালতকক্ষের একদম পিছনদিকের সারি থেকে উঠে দাঁড়াল এক ব্যক্তি আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল গোটা আদালতের। এ লোক আসামির হুবহু নকল! সেই এক স্থূল তাগড়াই দেহ, ড্যাবড্যাবে রক্ত-লাল চোখ আর মাংসল একজোড়া পা। এমন কি জামাকাপড়ও দুজনের এক — নীলরঙের আঁটো স্যুট আর ডোরাকাটা টাই। তাজ্জব মিল!
“এই লোকটিকে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখুন মিসেস স্যামন। দেখে এইবার নিঃসন্দেহ হয়ে বলুন, আপনি সেদিন এই কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকেই লরেল ঝোপে হাতুড়ি ফেলে পালাতে দেখেছিলেন তো? ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকা এঁর ওই যমজ ভাইটিকে নয়?”
ভদ্রমহিলা বাক্যহারা। তাঁর ঘাড় দুলতে থাকল দুই দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভাইয়ের মুখের মাঝখানে। হতভম্ব দৃষ্টিতে বারবার তিনি দুই ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে থাকলেন। কাঠগড়ায় পা জড়ো করে বসে আছে এক দানবের মতো চেহারা আর আদালতের পিছনে সটান দাঁড়িয়ে আছে একই রকম আর এক বিশালকায় মূর্তি। ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন।
তারপর আর কী? মামলা শেষ হয়ে এল। সাক্ষীদের কেউই হলফ করে বলতে পারল না যে সে রাত্রে তারা আসামিকেই দেখেছিল। আর আসামির ভাইয়েরও বজ্রবাঁধুনি অ্যালিবাই ছিল। খুনের সময় সেই রাত্রে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে ছিল।
প্রমাণের অভাবে আসামি ছাড়া পেয়ে গেল। কিন্তু খুনটা সত্যিই সে করেছিল, নাকি তার ভাই – বা করে থাকলেও শাস্তি সে পেল কি না – তা আর জানা গেল না। গোটা দিনটা যেমন অবাক-করা, তার শেষটাও হল তেমনই বিস্ময়কর আর আকস্মিক। মিসেস স্যামনের পিছু পিছু আমি বেরোলাম, আর বেরিয়েই আমরা গিয়ে পড়লাম একটা বিপুল ভিড়ের মধ্যে। জনতা যমজ দুই ভাইকে দেখবে বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তাদের কৌতূহল বাগ মানছে না — ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ির সে এক চূড়ান্ত পর্যায়! পুলিস আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের সামলানোর, কিন্তু গাড়ি চলাচলের রাস্তাটুকু ফাঁকা রাখা ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারছে না। পরে শুনেছিলাম যে পুলিশ দুই ভাইকে পিছনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তারাই নাকি রাজি হয়নি। এক ভাই – কোনজন তা জানি না – নাকি বলেছিল, “খালাস পেয়ে গেছি তো— এখন আবার অত কী?” তারা সামনের দরজা দিয়েই বুক ফুলিয়ে বেরোল।
আর ঠিক তখনই ঘটল অঘটনটা। মাত্র ছ’ফুট দূরে দাঁড়িয়েও আমি বুঝলাম না ব্যাপারটা ঘটল ঠিক কী ভাবে। ভিড়ের চাপে আর ধাক্কাধাক্কিতে এক ভাই ছিটকে গিয়ে পড়ল সোজা রাস্তায়— বিদ্যুদ্বেগে ছুটে আসা একটা বাসের চাকার ঠিক সামনে।
একটা চিৎকার দিয়ে উঠল লোকটা – খরগোশ যেমন চেঁচায় – ব্যস্! ওই শেষ! তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। মাথা ছেতরে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল— ঠিক যেমনটা গিয়েছিল মিসেস পার্কারের। কী বলব একে? কর্মফল? দৈব প্রতিহিংসা? ঈশ্বরের বিচার? জানি না। মৃত লোকটার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার ভাই অদ্ভুত চোখে মিসেস স্যামনের দিকে চেয়ে রইল। সে লোকটা কি খুনি, না কি নির্দোষ? না কি তার যে ভাই মরে গেল এমন অদ্ভুতভাবে সে করেছিল খুনটা? না কি সেই ছিল নির্দোষ?
প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউই জানে না। আর জানা যাবেও না।
কিন্তু আপনি যদি মিসেস স্যামন হতেন, রাত্রে আর ঘুমোতে পারতেন তো?
#অনুবাদ