বিবিধ

আমার জানলা দিয়ে

পথিক মিত্র Oct 22, 2022 at 10:33 am বিবিধ

আমার পায়ে একটা তিল আছে, তাই নাকি আমার ভাগ্যে প্রচুর ঘোরা আছে - ছোটবেলায় মা বলত। যদিও মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে থেকে দীঘা,পুরি,দার্জিলিংয়ের বাইরে বেশি ঘোরার সুযোগ হয়নি ছোটবেলায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চাকরিসূত্রে সারা ভারতে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়। তারপর জীবনসঙ্গিনীর চাকরিসূত্রে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কয়েক বার বিদেশ ভ্রমণও হয়ে যায়। যদিও ছোটবেলাতে এগুলো স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে এটা ট্রিভিয়াল। যাক সে কথা, আমার ঘুরতে বা নতুন জায়গা দেখতে খুব ভালো লাগে। আর আমার কাছে নতুন দেশ দেখা মানে কিন্তু শুধু তার দর্শনীয় ঐতিহাসিক বা প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর স্থানগুলো নয়। ভিনমুলুকের মানুষও কি কম দর্শনীয়? ভেবে দেখুন, আলাস্কার এক এস্কিমো যদি আপনার বাড়ি এসে কড়া নেড়ে হাতপাখা চায়, কেমন হবে ব্যাপারটা? মাধ্যমিকের সময় ইতিহাসে একটা ১৫ নম্বরের প্রশ্ন খুবই আসত - "unity in diversity" বা 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য'। এই সময় বোধহয় এই প্রশ্নটা আমাদের মাধ্যমিকের সিলেবাস থেকেই নয়, সারা বিশ্বের সিলেবাস থেকেই নিখোঁজ। মানুষে-মানুষে হিংসা, হানাহানি, ঘৃণা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিন্ন রুচি, ভিন্ন মতামত, ভিন্ন জীবনবোধকে আজকাল আমরা মর্যাদা দিতেই হয়তো ভুলে গেছি। সেই ভাবনা থেকেই আজকের এই লেখার অবতারণা। এখানে বিষয় আমার দেখা দেশবিদেশের দর্শনীয় স্থান নয়, সেসব জায়গার মানুষ। অঞ্জন দত্তের 'আমার জানলা দিয়ে' গানটা আমার খুব প্রিয়। তাই চলুন, আপনারাও না হয় উঁকি মারবেন আমার জানলা দিয়ে।

২০১৫ সালের শেষের দিকে মধুচন্দ্রিমা সারতে আমরা থাইল্যান্ডের ফুকেট শহরে যাই। যেহেতু সেটা আমাদের প্রথম বিদেশ সফর ছিল,আমাদের উত্তেজনাটাও ছিল দ্বিগুণ। চোখ ধাঁধানো নীল সমুদ্র, আলো ঝলমলে রাস্তা যেখানে সারা রাত ধরেই উৎসব চলছে, এই সব নিয়েই মায়া নগরী ফুকেট। সেখানে রকমারি খাবারের দোকান। তারই মাঝে দেখলাম একটি দোকান বড় করে "ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট" লিখে রেখেছে। আমরাও সেখানে ছুটে গেলাম। অর্ডার দিলাম একটি বিফ রোল। আমাদের দেখেই দোকানের মুসলমান মালিক এসে বললেন "সালাম ভাইজান"! আমি স্মিত হাসলাম। ভদ্রলোক বেশ মিশুকে। অনেক কথা বললেন। রোলটিও দারুন সুস্বাদু। কিন্তু বড্ড ঝাল। এখানে আবার জল কিনে খেতে হয়। আমি কিপটে বাঙালি।  খেজুরে আলাপ জমিয়ে একটু জল চাইলাম। ভদ্রলোক হালকা হেসে জল দিতে বলেন সহকারীকে। এরই মধ্যে তাঁর প্রশ্ন," ভাইজান লাহোর ইয়া করাচি?" আসলে দীর্ঘকাল বাংলার বাইরে থাকা ও ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি হওয়ার সুবাদে আমার হিন্দিতে  কোনো বাংলা টান নেই, তার উপর বিফ রোল খেলাম। আমি হেসে বললাম, "কলকাতা"। ব্যাস!! ওই যে ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন, আর ফিরলেন না, জলটাও আর জুটলো না। অথচ রেস্তোরাঁটা নাকি 'ইন্ডিয়ান'।  


দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি মার্কিন মুলুকের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। খোদ হলিউড আর বেভারলি হিলসের রূপকথার শহর। আমরা ফিরছি ইউনিভার্সাল স্টুডিও দেখে। গন্তব্য এয়ারপোর্ট থেকে লাস ভেগাস। আমরা উবের বুক করলাম এয়ারপোর্ট যাব বলে। আমেরিকাতে একটা চল আছে যে একজন যাত্রীকে অন্তত ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে হয়। ড্রাইভারকে তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হতে যেন না হয়। সেইমতো আমি বসলাম ড্রাইভারের পাশে। ড্রাইভার দরজা খুলে আমাদের স্বাগত জানিয়ে বসতে বললেন। এটা আগেই দেখেছি যে ড্রাইভাররা বেশ গপ্পো করতে ভালোবাসেন। ফ্রেড, মানে, যে নাম বলে সে নিজের পরিচয় দিল,সে-ও এর ব্যতিক্রম নয়। ফ্রেড চল্লিশোর্ধ্ব সোনালি চুলের একজন সুদর্শন পুরুষ। অনেক গল্প করল আমাদের ট্রিপ নিয়ে। আমার তখন বেজায় সর্দি, হালকা জ্বর-জ্বর। তা শুনে ফ্রেড হঠাৎ একটি ওষুধ ধরিয়ে দিল আমার হাতে। আমাদের সন্দেহবাতিক সিরিয়াল-দেখে-বড়-হওয়া-মন বলে কথা। ভাবলাম, নিশ্চয়ই ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমাদের কিডনি খুলে বেচে দেবে। এর কাছ থেকে কিছু খাওয়া অসম্ভব। হয়তো ফ্রেড বুঝতে পেরেছিল আমার মনের কথাটা। তাই সে নিজের পুরো পরিচয় দিয়ে একটা কাগজে ওষুধটা লিখে দিল। ওর পুরো নাম ডক্টর ফ্রেডরিক হামার। লস অ্যাঞ্জেলেস এর একজন স্বনামধন্য সার্জেন। সেটা পরে গুগল জানায়। ফ্রেড বলে, জটিল সার্জারির পর নাকি সে একটু রিলাক্স করার জন্যে শুধু এয়ারপোর্ট রুটে উবের চালায় তার নিজের গাড়িতে। এটাই নাকি তার রিলাক্সেশন!


পরের অভিজ্ঞতাটি বার্লিন শহরে, ২০১৯ সালে। আমি উঠেছি একটি জস্টেলে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, জস্টেল হল এক আধুনিক ধর্মশালা। সেখানে এক ঘরে পাশাপাশি বেডে ভিন্ন দেশ ,জাতির, বর্ণের লোক থাকে। হোটেলের থেকে সস্তা এবং আপনার অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য আদর্শ। সেই জস্টেলে রাতে লাইব্রেরী রুমে, বিয়ার সহযোগে , আড্ডা চলছে জোড় কদমে। সেই আড্ডাতে আছে মেলবোর্নের বছর কুড়ির লিয়ুক, একজন কলেজ পড়ুয়া। একটি সেমিস্টার বাতিল করে সে ব্রেক নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। গোটা ব্যাপারটা শুনেই আমার বাবার রাগি মুখটা মনে পড়ে গেলো। কথায় কথায় 'মেট' বলে সম্বোধন করা তরুণ ঠিক যেন মোটা স্টিভ স্মিথ। ভয়ানক সপ্রতিভ,চনমনে,খোলামেলা লিয়ুক-এর পাশে বসা মেক্সিকোর সমারিনাকে আবার দারুণ পছন্দ হয়েছে লিয়ুকের। সেই কথাটা বেশ ঠাট্টার ছলে স্পষ্ট বলেই দিলে সে। আমি ভাবলাম এই বোধহয় রেগে গেল মেয়েটি। কিন্তু তিরিশোর্ধ্ব সমারিনা একজন মেক-আপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে এসেছে বার্লিনে। সে জানালো বার্লিনে নয়ার হাউস বলে এক আন্ডারগ্রাউন্ড পাবে সে গতকাল গেছিল। এই পাবে নাকি ঢুকতে গেলে ভূত সাজতে হয়। যদি কর্তৃপক্ষের আপনার সাজ বিশ্বাসযোগ্য লাগে তবেই আপনি ঢুকতে পারবেন। তবে লিয়ুককে নিরস্ত করে বেশ সাবলীল ভাবেই সমারিনা এক সময় জানালো," I am not into guys, I like girls"। আমার ঠিক পাশে বসে ছিল কিঞ্চিৎ গম্ভীর ,লম্বা সোনালি চুলের পনিটেল বাঁধা আর্জেন্টিনার উকিল আন্দ্রে। তার নাকি গত মাসে তার তৃতীয় বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়ার পর সেও লিয়ুকের মত ব্রেক নিচ্ছে একটু ! এ ছাড়া ছিল ইকুয়েডর থেকে স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে আসা সালাম আলি। কৃষাঙ্গ যুবকের চোখে বড় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। কথায় কথায় তার পারিবারিক দারিদ্রের  আর তার মায়ের জীবন সংগ্রামের কথা উঠে এলো।

এদের সাথেই গপ্পে মজেছিলাম আমি। বলেছিলাম কলকাতার গল্প, দুর্গাপুজোর গল্প।


এরই ঠিক এক সপ্তাহ পর আমাদের ট্যুরের শেষ লগ্নে আমরা প্রেমের শহর,স্বপ্নের শহর প্যারিসে। আমাদের টিমটাও এবার বেশ অদ্ভুত আমি,আমার স্ত্রী ও শ্বশুর মশাই। প্রথম অভিজ্ঞতা হলো ফ্রেঞ্চ rudeness এর। একজন খবরের কাগজ পড়া ভদ্রলোককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কত নম্বর প্ল্যাটফর্ম। আমরা হামেশাই করে থাকি এটা। ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে উত্তর দিলেন, " I will not tell you"! দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলাম বিখ্যাত লুভার (লুভ) মিউজিয়ামে। টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আঁতকে উঠলেন আমার গিন্নি। পকেটমারি হয়েছে। কড়কড়ে ১৫০ ইউরো সহ তার পার্স লোপাট। তাও নাকি স্বপ্নের নগরী প্যারিসে। শেষে একই দিনে আর এক পকেটমারের হাতে আক্রান্ত হতে হতে বেঁচে যান আমার শ্বশুরমশাই। আর এবার পকেটমার একজন সুসজ্জিতা, হটপ্যান্ট পরিহিতা, শার্টের তিনটি বোতাম উন্মুক্ত লাস্যময়ী রমণী। কিন্তু মোক্ষম সময় তার হাতটা খপাত করে ধরে গোদা বাংলায় তাকে কয়েক টা সাধুবাদ দিতে কিন্তু ছাড়েননি আমার সহধর্মিণীর পিতা! আমি শুধু বলেছিলাম,"What a pleasant distraction!"


এবারের ঘটনাগুলো ২০২১ সালের মিশর সফরে। কভিডের ঘেরাটোপ ফেলে অনেকটা বেপরোয়া ভাবেই হঠাৎ ঠিক করলাম এই সফর। এই সফরেও সাথে ছিল আমার স্ত্রী , শ্বশুর মশাই, অকৃতদার লেখক মামাশ্বশুর ও তার এক বন্ধু-দম্পতি। একেবারে অনসম্বল কাস্ট যাকে বলে। মিশরে ভাষার সমস্যা প্রবল হলেও লোকগুলো কিন্তু খুব ভালো মনের। এক মুসলমান রাষ্ট্র হাওয়ার দরুন মিশর একটু হলেও রক্ষণশীল। এরই মধ্যে আমাদের মামার সাথেই খুব জোর গপ্পো জুড়ে দিলেন এক মহিলা। কিঞ্চিৎ বিরক্তই হলাম আমার তার অনর্গল বকবকানির ঠেলায়। কিন্তু সে তো থামার পাত্রী নন। তার বুক ভরা কৌতুহল। তবে যখন সে জানতে পারলো ষাটোর্ধ মামাবাবু অবিবাহিত, সে ভয়ানক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, " what? you dont even have a single wife?" যদিও এটা নিয়ে অনেক মশকরা করি আমরা , এই প্রশ্নটা কিন্তু একটা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।


এই সফরেই আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এক সন্ধ্যায় নিজেরা খাবার কিনতে গিয়ে আমরা অদ্ভূত ভাষাবিভ্রাটে পড়ি। ওরা কেউ ইংরেজি জানে না আর আমরা ওদের ভাষা জানি না। এমনকি মেনু কার্ডেও ভাষা আরবি। সবরকম মূকাভিনয় করে বোঝাবার চেষ্টা যখন ব্যার্থ হল, তখন আমরা কোনোমতে আন্দাজে কিছু খাবার দেখে অর্ডার দিই। সেই সময় সেই দোকানের পাশে চাদর গায়ে এক মোটা দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় বসে ছিলেন। আমাদের দেখেই জড়ানো গলায় তিনি বললেন," Hey you Indian!!"! পাশেই আমার স্ত্রী ফিসফিস করে বলল, "যাস না ড্রাংক কেস"! কিন্তু সে ছাড়বার পাত্র নয়। ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বিকৃত উচ্চারণে বলেই চললো, " I like India, Amitabh bacchan, Shahrukh Khan, kareena kapor"। আমরা চলেই যাচ্ছিলাম. হঠাৎ আমার শ্বশুরমশাইকে দেখে সে বলল, "Gandhi! Great Man! What a man! I like Gandhi!!" আমরা একটু থমকে দাঁড়ালাম। ব্যবসায়িক স্বার্থে এখানকার লোকেরা ভারতীয় দেখলেই শাহরুখ খান, অমিতাভ বচ্চন বলে ডাকে, কিন্তু এ গান্ধীজি কে চেনে? বেশ অবাক হলাম আমি। সে বলেই চললো, " Gandhi great man!! I respect!" কিন্তু এর ঠিক পরে রেসপেক্ট এর যে কারণ সে বলল তা শুনে হয়তো উপর থেকে গান্ধীজী স্বয়ং আরবি ভাষা শিখে ওকে দু কথা শুনিয়ে যেতেন! সে বলল," Great man Gandhi, did not sleep with wife for twenty years"। এই বিরল তথ্য যে সে কোথা থেকে পেয়েছে তা ভগাই জানে। 

শেষের অভিজ্ঞতাটা কিন্তু খোদ ভারতেই। আমার খুব প্রিয় লখনউ শহরে।

একটি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির বিজ্ঞাপনে এই লাইনটা শুনেছিলাম, " There are somethings that money can't buy"। এই লাইনটার বাস্তবে অনুধাবন করার একটা সুযোগ এসে গেল লখনউ-এর হজরতগঞ্জে।

লখনউ বললেই প্রায় সমার্থক শব্দের মত যে শব্দটি ভেসে ওঠে তা হলো 'তেহজিব' বা আদব কায়দা। মেহমান-নাওয়াজির ক্ষেত্রে লখনউ যে সেকেন্ড টু নান, তার প্রমাণ এই শহরে নামার পর থেকেই পেয়েছি। তবে লখনউয়ের ইতিহাসের ব্যাপারে যত জানতে পারছিলাম ততই নবাবদের ব্যাপারে কৌতূহল বাড়ছিল। একটা বই খুঁজছিলাম যা থেকে মোটামুটি সবটা জানা যাবে। 

নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের বেগম ছিলেন বেগম হজরত মহল। তাঁর নামেই এলাকাটির নামকরণ। এখানে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো একটি বাজার আছে। প্রথমে দেখলে অনেকটা এসপ্ল্যানেডের সঙ্গে মিল পেতে পারেন কিন্তু ভালো করে দেখলে খেয়াল করবেন এখানে বেশির ভাগ দোকানই সেই আমলের। বেসিক কনস্ট্রাকশন কিন্তু পাল্টানো হয়নি। তারপর সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত্র সাইনবোর্ড গুলো কিন্তু সাদাকালো। বেশ একটা ভিনটেজ পরিবেশ পাবেন এলাকাটাতে। উচুঁ উচুঁ ছাদওয়ালা সব দোকানের উপরে নকশাকরা ঘুলঘুলি যাতে পায়রা বসে। এই রকম একটা দোকান হল ব্রিটিশ বুক ডিপো। দোকানটা দেখেই একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়া তৈরি হচ্ছিল। আর দোকানের মালিক প্রায় আশি ছুঁই-ছুঁই বৃদ্ধ মির্জা সাহেবের সঙ্গে পরিচয়টা তো উপরি পাওনা।

আমি লখনউয়ের নবাদের নিয়ে আগ্রহী শুনে ভদ্রলোক তার সহকারীকে কিছু বই নামিয়ে আনতে বলে আমায় জিজ্ঞেস করলেন "জনাব, আজকাল কেউ ইতিহাস নিয়ে মাথাব্যথা রাখে?"

আমি জবাব দেবার আগেই তিনি বলতে শুরু করলেন ব্রিটিশ বুক ডিপোর ইতিহাস। মির্জা সাহেবের ওয়ালিদ কাগজের ব্যবসা করতেন। কিন্তু সেই সময় লখনউতে কোনো ইংরেজি বইয়ের দোকান ছিলনা। এতে সবচেয়ে সমস্যা হত মেমদের। তখনকার মেমসাহেবরা ছিলেন যাকে বলে 'ভরেসিয়াস রিডার' বা বইয়ের পোকা। তাই ইংরেজ অফিসারদের অনুমোদন পেয়েই লখনউয়ের প্রথম ইংরেজি বইয়ের দোকান খোলা হয়। ব্রিটিশ বুক ডিপো।  ইংল্যান্ড থেকে কলকাতা হয়ে আসতে থাকল বই, আর বাড়তে থাকলো মেমসাহেবদের ভিড়। এ সেই ১৯৩০ সালের কথা। তারপর আস্তে আস্তে ইংরেজি বইয়ের পাশাপাশি হিন্দি বইও স্থান পেল। বইয়ের টানে নাকি বিপ্লবীরাও রাতের অন্ধকারে ঢুঁ মারতেন ব্রিটিশ বুক ডিপোয়। মির্জা সাহেব জানালেন, তাঁর আব্বার অবস্থা বেশ নাজুক ছিল এই সময়। এ ছাড়াও নবাবের পরিবারের লোকেরাও আসতেন তার দোকানে। বসে আড্ডা হত রাত অবধি। মেমসাহেবরা অপেক্ষায় থাকতেন প্রতি মাসে নতুন বই আসার। ফিটন গাড়ির ভিড় লেগে থাকতো দোকানের সামনে।

এর পর দেশ স্বাধীন হল। দোকানের ভার নিলেন তরুণ মির্জা সাহেব। তখন লখনউ ভারতের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম। তখন ব্রিটিশ বুক ডিপোতে আসতেন তৎকালীন রাজনীতির অনেক হোমরাচোমড়া ব্যক্তি, হাই কোর্টের জজ, উকিলরা। কিন্তু কালের নিয়ম বড়ই নিষ্ঠুর। সময়ের সঙ্গে ঠিক তাল মেলাতে পারল না এই ঐতিহাসিক দোকানটি। হয়ত এই ব্যবসায় আগ্রহ ছিল না পরবর্তী প্রজন্মের। ছলছল চোখে বৃদ্ধ জানালেন," মুঝে নোটিশ ভেজা ইন লোগোনে, দুকান খালি করনা পড়েগা। বেওরা মালিকনে বেচ দিয়া কিসি কো।"

আসলে ব্রিটিশের অনুমোদনের তৎকালীন নবাব পরিবারের থেকে লিস নিয়েছিলেন মির্জা সাহেবের বাবা। সেই চুক্তি শেষ আর ওয়ারিশরা রাখতে চায়না এই জায়গা। অতয়েব আর কি ঠিক যেমন শহরের বুকে সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল গুলো হারিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনই হয়তো হারিয়ে যাবে ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বুক ডিপো। আর সাথে মুছে যাবে একটা সময়ের দলিল।

বৃদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে ডিসকাউন্ট চাওয়ার কথাও মনে আসেনি। করমর্দন করে যখন বিদায় নিচ্ছি, তখন বুড়ো বললো "ফির আনা বেটা"। ক্ষণিকের পরিচয়,কিন্তু তাও বুকের ভিতর একটা অচেনা চিনচিনে ব্যথার উদয় হল। সেই এক ক্লিশে, নস্টালজিয়ার রং সেপিয়া। ফিরে হয়তো পরের বার দেখব একটা আধুনিক Crossword দাঁড়িয়ে আছে এখানে - ঝাঁ-চকচকে দেওয়ালে ফেলে আসা সময় এর কোনো গন্ধ নেই, ফিটন গাড়ির শব্দ নেই, মেমদের হাসি নেই, কোনো ইতিহাস নেই।

মির্জা সাহেব মানুষটা কিন্তু বেশ রসিক। হবে না-ই বা কেন, লখনউ তো রসিক মানুষজনেরই  শহর। হয়তো আমার মনের মেঘের আঁচ পেয়ে ছিলেন।যাওয়ার আগে, হালকা হেসে একটি শের শোনালেন আমাকে। সত্যি এই শহরটা নবাবদের আদবকায়দা দিয়ে গড়া। হাজার হোক লখনউ বলে কথা।

ইকবাল  বলছেন ," পরিন্দো কো উড়নে দিজিয়ে গালিব, জো আপনে হায়,খুদ ওয়াপাস আ যায়েঙ্গে।"

গালিব বলছেন, " দুনিয়া বড়ি বেইমান হ্যায়, জব পর নিকল আতে তো আপনে ভি নই আশিয়ানা ধুন্ড লেতে হ্যায়।"

নজমটা ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিল আমাকে। সেপিয়া টোনের দৃশ্য ভিড় করে এল চোখের সামনে। দেখলাম ফিটন গাড়ির জ্যাম, মেমদের কফি সহযোগে  আড্ডা , বিপ্লবীদের রাতের মিটিং, এক ভারাক্রান্ত নবাব ধরা গলায় গাইছেন,"ছোর চলে লখনউ নগরিয়া"। সত্যিই, "There are somethings that money can't buy!"

........................... 

#গদ্য #ভ্রমণ #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

27

Unique Visitors

215800