ফিচার

যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?

বিবস্বান Aug 13, 2024 at 6:43 am ফিচার

ধরা যাক সব ঠিক হয়ে গেছে। থেমে গেছে শহর জুড়ে মিছিলের ঢল। প্রতিবাদী রাত্রিজাগর। ধরা যাক, ধরা পড়ে গেছে সমস্ত ধর্ষক এবং খুনি, যারা যুক্ত ছিল আর জি কর মেডিকেল কলেজের ঘটনায়। তাদের যথাযথ শাস্তি হয়েছে। তারপর?

একটা ধর্ষণের খবর এলে মনে পড়ে যায় আগের ধর্ষণ-সংবাদের স্মৃতি। সেই সময়ের প্রতিবাদগুলো। এবং অপরাধীর ধরা পড়া অথবা না-পড়া। শাস্তি হওয়া অথবা না-হওয়া। 

আর সেই স্মৃতি নিয়েই আমরা এসে দাঁড়াই আর-একটা ধর্ষণ-সংবাদের সামনে। আর এই দুই সংবাদের মাঝখানে আমরা ঠিক কী করি?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। কী কী করব আর কী কী করব না, সেইটা ভাবাও জরুরি। একটি সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত একজন সরকারি ডাক্তার ধর্ষিতা এবং খুন হয়েছেন, তার দায় তো সরকারকে নিতেই হবে। সুনিশ্চিত করতে হবে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অপরাধীর শাস্তি। না করলে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিজের কাজ করতে বাধ্য করা। যে রাষ্ট্র তার নিজের কর্মীকে কর্মক্ষেত্রেই সুরক্ষা দিতে পারে না, সেই রাষ্ট্রের আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কি? ভেবে দেখার সময় এসেছে।

কিন্তু এইসব জরুরি প্রশ্নের সঙ্গে আরও এক জরুরি প্রশ্ন আমাদের নিজেদের করা দরকার। আমরা কি এই ঘটনার অভিঘাত থেমে গেলে আবারও অপেক্ষা করব পরবর্তী ধর্ষণ-সংবাদের? নাকি সেই ধর্ষণ সংস্কৃতি আটকে দেওয়ার জন্য কিছু বহমান পদক্ষেপ নেব?

একবার নিজের এক লেখার প্রয়োজনেই আমার আশেপাশের সেই সমস্ত মানুষকে একটি সাধারণ প্রশ্ন করেছিলাম, যাঁরা লিঙ্গপরিচয়ে নারী। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই অযাচিতভাবে এবং অস্বস্তিজনকভাবে স্পর্শিত হয়েছেন। এবং খুব ফাঁকা জায়গায় নয়। হয়তো বাসে ট্রামে। দৈনন্দিন যাপনের মধ্যে। এমনকি পারিবারিক বৃত্তের মধ্যেও। এঁদের মধ্যে আছেন আমার মা, প্রেমিকা, বোন, দিদি, বন্ধু, সহকর্মী প্রত্যেকেই। কেউ প্রতিবাদ করেছেন। কেউ সেই সুযোগ পাননি। কেউ সাহস পাননি। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই হয়তো, ‘খুব বাড়াবাড়ি’ নয়। যতটা হলে গণমাধ্যমের আলো এসে পড়ে। অধিকাংশ ঘটনাই আমাদের মা-বোন-প্রেমিকা-সহকর্মী-সহনাগরিকের দৈনন্দিন যাপনের অংশ। অনেকেই আর এসব নিয়ে আলাদা করে মাথা ঘামান না। শুধু ভিড় বাসে ওঠার সময় ব্যাগটা নিজের সামনের দিকে নিয়ে নেন। 

সতর্ক থাকেন। কারণ আমাদের সমাজ আমাদের রাষ্ট্র তাঁদের শিখিয়েছে, সতর্ক থাকার দায় তাঁদেরই। আগন্তুক কনুই কিংবা লোভী স্পর্শের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে নিজেদেরই। অথচ কী আশ্চর্য, তাঁরা এক স্বাধীন দেশের ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিক। রাষ্ট্র যাঁদের সুরক্ষা দিতে অপারগ। 

অথচ রাষ্ট্র তো আমাদের ছাড়া হয় না। রাষ্ট্রের দিকে একটা আঙুল তুললে অন্তত চারটে আঙুল নিজের দিকেও যে থাকে, তা আমরা ভুলে যাই। আর ভুলে গিয়ে কী করি? নর্মালাইজ করি। বলি ভিড়ে ওসব একটু হয়। পারিবারিক ক্ষেত্রে কেউ হয়তো অযাচিত আর বেঠিকভাবে স্পর্শ পেয়েছেন কোনও মাসতুতো দাদা বা কাকুর কাছে। তাঁদের বলি, চুপ করে থাকো। তুমি ভুল বোঝোনি তো! আমরা বারবার ভিক্টিমকেই বাধ্য করি নিজেকে সেকেন্ড গেস করতে। ভাবতে, সেই উড়ে আসা স্পর্শটিকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দেওয়া যায় কি না! আর যদি একান্ত দেওয়া না যায়, তাহলে আমরাই বলি একটু ‘সামলেসুমলে’ চলতে। এসব নিয়ে বেশি কথা না বলতে। কারণ আমরা তো মেনে নিয়েছি, এসব একটু হয়-টয়।


আসলে আমরা অপেক্ষা করি। কখন ‘বড়’ কিছু হবে। নারকীয় কিছু। ছোটোখাটো অস্বস্তিকে পাত্তা না দিয়ে আমরা অপেক্ষা করি, বড় কোনও অস্বস্তির জন্য। আমরা ভুলে যাই ধর্ষক আকাশ থেকে পড়ে না। তারা আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বন্ধু, আমাদেরই সহনাগরিক। আমাদের সঙ্গেই তারা থাকে। কে জানে, হয়তো প্রতিবাদে অংশও নেয়। তাদের তো আলাদা কোনও শিং থাকে না। তারা ভিনগ্রহের প্রাণী নয়।

আমরা ভুলে যাই, তাই বেনিফিট অফ ডাউট দিতে বাধ্য করি। সেকেন্ড গেস করতে বাধ্য করি। নিজেকে সন্দেহ করতে বাধ্য করি। তারপর অস্বস্তিজনক স্পর্শের নাগাল থেকে দূরে সরে যেতে বলি। বাস থেকে নেমে পড়তে বলি। ব্যাগ দিয়ে বুক আড়াল করতে বলি। অটোতে মহিলা সহনাগরিকের পাশে বসার চেষ্টা করতে বলি। আর ছোটো ছোটো হেনস্তার মেটা ন্যারেটিভ দিয়ে তৈরি করে তুলি ধর্ষণের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ। 

আর জি করে যা হয়েছে, তাকে নারকীয় বললে নরকের অপমান করা হয়। সেই সিসি টিভি-হীন সেমিনার কক্ষে কেন ছিলেন আমাদের সেই মৃত সহনাগরিক ডাক্তার? ছত্রিশ ঘণ্টা ডিউটিরত অন কল ডাক্তারের জন্য ছিল না কোনও নিরাপদ বিশ্রামকক্ষ। আমাদের দেশে সত্যিই কোনও নিরাপদ বিশ্রামকক্ষ নেই। একটা গনগনে যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে প্রত্যেকদিন প্রত্যেক মুহূর্ত হাতে অস্ত্র অথবা ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যাঁরা, তাঁরা আমাদেরই সহনাগরিক। লিঙ্গপরিচয়ে নারী। রাষ্ট্র যাঁদের দায়িত্ব নেয় না। যাঁরা বুঝে গেছেন, নিজের লড়াই নিজেদেরই লড়তে হয়। 

যে রাষ্ট্র নিজের নাগরিকের দায়িত্ব নেয় না, সেই রাষ্ট্র দিয়ে আমরা কী করব বলতে পারেন? 

আর যে আমরা নিজেদের মধ্যেই সেই রাষ্ট্রকে ধারণ করে চলছি রোজ? নিজেদের নিয়েই বা ঠিক কী করব আমরা?


****************

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান

#R. G. Kar #we want justice #woman's right #স্পর্ধা

  • Snigdha Chatterjee
    Aug 14, 2024 at 6:08 pm

    Everyone are handicapped.....only drama.....only sympathy.....no proper response .....

  • Snigdha Chatterjee
    Aug 14, 2024 at 6:07 pm

    Everyone are handicapped.....only drama.....only sympathy.....no proper response .....

  • yashodhara Ray Chaudhuri
    Aug 14, 2024 at 11:10 am

    একেবারে ঠিক ঠিক। দুটো বীভৎস ঘটনার মাঝখানে আমরা কী করি? নর্মালাইজ করিন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

37

Unique Visitors

225533