শিকড়

শিকড়ের টান বড় অদ্ভুত।
ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে সবাই মিলে যেতাম দেশের বাড়ি। দাদু ঠাম্মার কাছে। খুব আনন্দ হত সেই সময়। ফেরবার সময়ও মনখারাপ বিশেষ হতো না। “আবার তো আসব”, চিরাচরিত এই কথাখানা ভেবে। আজ ছোটবেলার আনন্দরাঙা দিনগুলো খুব মনে পড়ে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোথাও মনে হয় ফেরবার সময় বাবার কি একটুও কষ্ট হতো না! বাবার ছেলেবেলামাখা ঘর, সাঁতার কেটে বেড়ানো পুকুর, ধুলো মেখে দৌড়ানোর মাঠ, কপালের বড় লাল টিপ পরা ঠাম্মার মুখ, কিংবা 'আবার তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবু' বলে যতক্ষন রাস্তা দেখা যায়, ততক্ষন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকা দাদু - এই শিকড় ফেলে আসতে বাবার বুকের ভিতরটা কি একবারও মুচড়ে উঠতো না? হয়তো বা হত, হতই। শুধু চোখের নাগালের বাইরের কষ্টটুকু ধরবার মতো চোখ দুটো তখনও ঠিক ফোটেনি আমাদের। একটা একটা করে দিন কেটে গিয়েছে। কত পুরোনো ডাল ভেঙে গিয়েছে, হলুদ পাতা ঝরে গিয়ে শিকড়ের মায়াও কাটিয়েছে হয়তো। তবু কচি পাতারা আজও শিকড়ের টানে ফিরে যেতে চায়, ছেলেবেলায় - যেখানে বাবার হাত ধরে ঘুরতে যাওয়া আর ছুটির দিনে বসে অঙ্ক কষা ছিল পরিপূরক; রবিবার দুপুরের মাংস-ভাত আর সাদা-কালো সিনেমা ছিল একই মোড়কে জড়ানো; স্কুল থেকে ফিরে মায়ের হাতের সরবত আর মায়ের আদর ছিল অক্সিজেনের মতই প্রয়োজনীয়।
আস্তে আস্তে সিনেমার দৃশ্যপটের মতো সেই সব ছবিও পর্দা থেকে হারিয়ে সংরক্ষিত হয়েছে মনের যাদুঘরে। সমস্ত পর্দা জুড়ে, জীবন জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে সেই একই শিকড়ের টান। আমাদের সবার জীবন, ফেলে আসা প্রত্যেকটা দিনের অলিতে গলিতে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই রসের স্রোত। সেই স্রোতের টান বারবার ফিরে ফিরে আসে; ভাবায়, কাঁদায়, ভাসায় আর টেনে নিয়ে যায় অতীতের শিকড়ে। ছেলেবেলায় বিকেলবেলাগুলো প্রায়শই কাটতো বাবার সাথে গঙ্গার পাড়ে বসে – সূর্য ডোবা থেকে সন্ধ্যে নামা পর্যন্ত। তারপর, এক শীতের রাত্রে বাবাকে গঙ্গার পাড়ে রেখে আমি ফিরলাম, একা। বহু বছর বাদে মায়ের হাত ধরে আবার সেই বিকেলের পড়ন্ত আলোমাখা গঙ্গার ঘাট। অতীত-বর্তমান, বাবা-মা আবার সমস্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে শুধু মনের মধ্যে জেগে ওঠে একটাই ঢেউ, অকৃত্রিম এক টান। শিকড়ের টান। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মুচড়ে বের করে আনে আমাকে, ছড়িয়ে থাকে চাঁদ-তারাদের আকাশ জুড়েও। নিরন্তর শুধু অনুভূত হয় জীবনে জুড়ে, হয়তো বা জীবনের পারেও। অবিরত অনুরণিত হতে থাকে, আবর্তিত হতে থাকে অবিচ্ছেদ্য শিকড়ের সেই অনন্ত অকৃত্রিম টান।
[অলংকরণ ঋণ : Franz Kline]
#গদ্য #শৈশব #স্মৃতি #উদিতা আচার্য
Poulami Ghosh
Ami emotional hoye gelam re!! Ar ki prochondo shundor likhechish re!! Oshamanno!! ❤️❤️❤️❤️
Soumya
ভাল লিখেছেন, এক লহমায় নিজের শৈশব-কৈশোর মনে পড়ে গেল।
Hena
কোথাও যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম। খুব সুন্দর লেখনী। Keep it up🧡
Arghya Bhowmick
Ki osadharon likhecho...khub bhalo laglo pore..😊
Chandrima
Boddo valo likhechis re. Mon chhuye gelo.