গল্প

প্রমিস

সায়নদীপ গুপ্ত Dec 6, 2020 at 7:22 am গল্প

(১)

দরজা বন্ধ করে চাবির গোছাটা আস্তে করে কি-র‍্যাকে ঝুলিয়ে রাখল আর্য। অন্য সময় হলে সেন্টার টেবিল বা সোফার উপর ছুড়ে ফেলে ঘরে ঢুকে যেত, কিন্তু শেষ দেড় সপ্তাহ ধরে হাওয়া যা গরম হয়ে আছে তাতে এটুকুও না করলে অশান্তির ভিসুভিয়াস খুলে যাবে। 

মহারানি স্নানে গেছেন, বাঁচোয়া! টি-শার্ট খুলে তাই দিয়ে গায়ের ঘামটা আরাম করে মুছে নিতে পারে, কেউ খ্যাঁকখ্যাঁক করার নেই। গ্রসারি আইটেমগুলো কি বের করে গুছিয়ে রাখবে? হাসি পেয়ে গেল আর্যর। মনীষার সান্নিধ্যে এসে মুদিখানার জিনিসও এখন গ্রসারি আইটেম! না না, হাসি নয়। কাঠিন্য চাই। গোটা সপ্তাহ জুড়ে মনীষা যেভাবে তার সঙ্গে নামমাত্র কথায় কাজ চালাচ্ছে, হাসিমুখে তার জবাব দেওয়া যায় না। 

অথচ শুরুটা মোটেই এমন গুরুতর ছিল না। হ্যাঁ, মনীষা দু-হপ্তা আগেই টিকিট কেটে রেখেছিল। হ্যাঁ, আর্যই আটকে পড়েছিল অফিসের কাজে। কিন্তু সবকিছু তো সবসময় ম্যানেজ করা যায় না! একটা শনিবার, একটা প্রতীক কুহর লাইভ ম্যানেজ করা যায়নি। সেও তো মেনে নিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে সিস্টেম বসে যাওয়া, ক্লায়েন্টের হুড়কো দেওয়া, সব তারই দোষ। খারাপ লাগা স্বাভাবিক, তা বলে একের পর এক সিন ক্রিয়েট, দিনের পর দিন কথা না বলা– অসহ্য! 

“আভেনের মধ্যে খাবারটা রাখা আছে, খেয়ে নিস”, চুলটা বাঁধতে বাঁধতে আবার বড়ো ঘরের আয়নাটার সামনে চলে গেল মনীষা। এখনই তৈরি? আর্য একবার স্মার্টব্যান্ডটা দেখে নিল, সবে পৌনে নটা। এমনিতে তো আরও আধঘণ্টা পরে বেরোয়। 

“তুই খাবি না?”

“প্যাক করে নিয়েছি, ক্যাবে খেয়ে নেব। আজ একটু জলদি যেতে হবে।” 

“কেন?” 

কোনও উত্তর নেই। আর্য বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। “কী রে? জলদি কেন যাচ্ছিস বলবি তো?” মনীষা একটা কালো কুর্তি পরেছে, মেক-আপের প্রতি সেরকম আগ্রহ কোনও কালেই ছিল না, কিন্তু আজ যেন খুব ফ্যাকাশে লাগছে। শুধু সাজগোজের জন্য, নাকি শরীরটা খারাপ? আর্য আর-একবার মুখ খোলার আগেই মনীষা মুখ খুলল। “অফিসে কাজ থাকে। সেই কাজের জন্য যেমন শনিবার রাত অবধি থাকতে হতে পারে, তেমনই উইকডে-তে আগে বেরোতেও হতে পারে। খাবারটা ভুলিস না আর পারলে গ্রসারিটা তুলে রাখিস”, শেষের কথাগুলোর রেশ ধরেই সদর দরজাটা বন্ধ হল। 

দশ মিনিট। জাস্ট দশটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারল না মেয়েটা! আর্যও রেডি হয়ে একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু জেদ তো এখন অভদ্রতা হয়ে গেছে! নাহ্‌, আজ একটা এসপার-উসপার করতেই হবে। 

(২)

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে। ‘কেন জলদি যাচ্ছিস?’ সবকিছু ছেড়ে শুধু এটাই জানার ছিল আর্যর? একবার তো বলতে পারত, একটু দাঁড়িয়ে যা, আমিও সঙ্গে যাব। সকাল থেকে মাথা টিপটিপ করছে, কেউ খোঁজ নিয়েছে? কেউ খোঁজ নেয় তার? মনীষার চোখে জল চলে এল। 

এই সবকিছু হয়েছে ওই হতচ্ছাড়া ক্লায়েন্টের জন্য। কতদিন ধরে প্রতীক কুহরের গানের জন্য হা-পিত্যেশ করে শেষটায় সব ভেস্তে গেল। আর্যর নিজেরও কি কম খারাপ লেগেছে? কলেজে পড়ার সময় দুটো দলের সঙ্গে গিটার বাজাত আর্য, মাঝেমধ্যে ব্যাক-আপ ভোকাল। শনি-রবি মানেই তখন হয় কোনও ক্যাফে বা পাবের লাইভ পারফরম্যান্স, নয়তো রিহার্সাল। কতবার তাদের দেখা করার দিন পিছিয়েছে, কতবার শো-গুলোই হয়ে গেছে দেখা করার মাধ্যম। সেই আর্য জেনেবুঝে তো এমন অনুষ্ঠান হাতছাড়া করবে না। কিন্তু সেদিন আর মাথার ঠিক ছিল না, যা যা খুচরো ক্ষোভ জমা ছিল সব উগরে দিয়েছে। আর্যটাও এমন, অন্যান্য দিন সে-ই তাকে শান্ত করে, অথচ সেদিন দুম করে বলে দিল, মনীষার খেয়াল রাখতে গিয়েই তাকে নাকি মিউজিক ছাড়তে হয়েছে! এক লহমায় চারপাশটা তেতো হয়ে গেছিল। বিয়ের আগেই যখন চাকরি বদল করল, তখন থেকেই তো আস্তে আস্তে সব কমে যাচ্ছিল। মনীষা কোনও দিন কিচ্ছু বলেনি, ভেবেছে আর্য হয়তো চাকরিতে বেশিরভাগ সময়টা দিতে চায়। এখন এই ফালতু দোষারোপ শোনার পর তার কথা বলার ইচ্ছেটুকুও চলে গেছে। 

“মণি, সুপ্রতীকদা এই ইলাস্ট্রেশনগুলো পাঠালেন। থরোলি চেক করে জানা। আর শোন, কালকের সাপ্লিমেন্টারির জন্য একটা মিটিং রাখছি বিকেলে, ওকে?” একটানা বলে একটু থামল সুমেধা। “এই, তোর কি শরীর খারাপ নাকি?”

“ওই, মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বড্ড বেড়েছে।” 

“এ বাবা! মিটিং অফ করে দেব?” 

“ধুস, ওসব লাগবে না। আমি এই কাজগুলো নামাই, তুই আমায় এক পাতা ডার্ট এনে দে বরং।” 

“কথায় কথায় এসব পেইনকিলার খাস না মণি, কিডনিতে স্টোন হয়।” 

“আপাতত মাথায় যে স্টোনটা চেপে আছে সেটাকে নামানো দরকার। প্লিজ এনে দে!” 

“দিচ্ছি, কিন্তু তুই জোর করে মিটিং-এর শেষ অবধি থাকবি না। বিকেল বিকেল বেরিয়ে যাবি, ব্যস।” 

ডেস্কে পড়ে থাকা ফাইলটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠল। আর্যর নম্বরটা ডায়াল করে স্ক্রিনের অসমাপ্ত কাজটায় চোখ রাখল মনীষা। বিকেলে একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করলে কেমন হয়? এভাবে কথা না বলে কাহাঁতক থাকা যায়! 

কিছুটা রিং হয়েই কেটে গেল। নাকি কেটে দিল? 

টিং। “Client call. Will talk later.” 

মাথাব্যথাটা আরও জাঁকিয়ে বসল। ইউএস ক্লায়েন্টের দুপুরবেলা মিটিং? ডাহা মিথ্যে বলতে একটুও আটকায় না? 

(৩) 

ফোনটা পকেটে রেখে দিল আর্য। মনীষা হঠাৎ এই সময় কী বলতে ফোন করেছিল? অত যে মেজাজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল, তখন তো কিছু মনে হল না! যাকগে, এখন কোনওমতেই ওর ফোন ধরা যাবে না। গুছিয়ে ঢপ মেরে অফিস থেকে বেরোনো গেছে, এখন ফোন ধরলেই টের পেয়ে যাবে। আর যে মানুষ সারা সপ্তাহ বোবা হয়ে কাটাতে পারে, আরও কয়েকটা ঘণ্টা কথা না বললে সে মূর্ছা যাবে না। 

সিগন্যাল সবুজ হতেই আর্য উলটোদিকে হাঁটা লাগাল। টালিগঞ্জ ফাঁড়ির এই মোড়ের ট্র্যাফিকটা একটু গোলমেলে। দোকানের সামনে এসে থমকে গেল। কত বছর পরে? অন্তত চার বছর। শেষ দুবছর ধরে তো প্যাশনের উপর পলি পড়েছে। সবকিছু ছেড়ে কাজে তরতর করে এগিয়েছে, আবার একের পর এক অন-সাইটের হাতছানি উপেক্ষা করেছে। কীসের টানে? কোন হতাশায় সেদিন মণিকে ওই কথাগুলো বলে দিল? তবে কি মনের মধ্যে একটা টানাপোড়েন থেকেই গেছিল? 

টানাপোড়েন। শুধু এই কারণেই এক দিন থেকে এক হপ্তা গড়িয়েছে। কাঁধের ব্যাগটা সামলে দোকানের দরজাটা ঠেলল আর্য। 

(৪) 

লিফ্‌ট থেকে বেরিয়েই গন্ধটা নাকে এল। চেনা খাবার, কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মনটা হুহু করে বলল, কতদিন বাইরে খাওয়া হয় না! অবশ্য আজ যদি সব মিটমাট হয়, রাত্রে রান্নার ঝামেলায় যাবে না। সোজা সুইগি। 

চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই ভুরু কুঁচকে গেল মনীষার। প্রথমত, আলো জ্বলছে। কিন্তু মনীষা নিজেই যেখানে তাড়াতাড়ি এল, আর্য সেখানে কত আগে এসেছে? দ্বিতীয়ত, খাবারের গন্ধটা তাদের ফ্ল্যাট থেকেই বেরোচ্ছে। সব কীরকম তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। 

“আর্য?”

“তুই... এত আগে? তোর শরীর ঠিক আছে?” 

“আমার শরীরের কথা পরে হবে। তুই তাড়াতাড়ি এলি কী করতে?” 

“রান্না করতে আর গিটার সারাতে।” 

“মানে?”

“সব দিন তো ম্যানেজ করা যায় না। আজ পেরেছি। বেক্‌ড ফিশ আর পিঙ্ক সস পাস্তা। গিটারের স্ট্রিংটাও লাগিয়ে এনেছি। প্রতীক কুহর তো হবে না রে, আর্য ভৌমিক লাইভ চলবে?” 

“আর্য আমি...” 

“আরে আমিও সরি, তুইও সরি। ওসব বলতে লাগবে না।” 

“দূর হ রাস্কেল! আমি যে স্পেন্সার্সে লাইন দিয়ে এইটা আনলাম!” 

“উরিশ্‌শালা! এ যে ওল্ড... !” 

“ওল্ড ইজ গোল্ড।” 

“উফ্‌! সুরার সলিল! তবে এর সঙ্গে তো পাস্তা ...” 

“চলবে না। কুচি কুচি করে পেঁয়াজ-লংকা-টমেটো-শসা।” 

“আহা, সলিলের সাথে লতা!” 

“শসা অবশ্য তুই আনিসনি।” 

“বাদ দে। লতার আবার পাকা চুল!” 

“উপর দিয়ে সামান্য তেল আর বাদাম।” 

“তালাত মেহ্‌মুদ ছুঁয়ে যাচ্ছেন, ওরে আর পারছি না!” 

“আগে প্রমিস কর, এবার থেকে রোজ একঘণ্টা করে গিটার?” 

“সেইসঙ্গে, হাত আগের মতো সেট হলেই, ইউটিউব চ্যানেলে রেগুলার আপলোড।” 

“যাও বৎস, গিটার টিউন কর। দেবী গা ধুয়েই আসছেন।” 

বারান্দা থেকে তোয়ালেটা নিয়ে আসার সময় কানে এল জ্যামিং। নির্ভুল সুরে সারা ঘর জুড়ে, ‘আহা রিমঝিম কে ইয়ে পেয়ারে পেয়ারে গীত লিয়ে’। মনীষা জানে, আজ সব ভুল ঠিক হয়ে যাওয়ার দিন। তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢোকার মুখেই বাঁদিকে নজর গেল।  


গ্রসারি ব্যাগটা রান্নাঘরের মেঝেতেই পড়ে আছে। 

*****





[ অলংকরণ: অভীক ]
#বাংলা #গল্প #সায়নদীপ গুপ্ত #SILLY পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

9

Unique Visitors

214972