ফিচার

মৃত্যুঞ্জয়ী রাজপুত্র

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Aug 30, 2020 at 3:53 am ফিচার

ওয়াকান্ডা রাজপ্রাসাদের সামনে প্রশস্ত মাঠে কাত হয়ে পড়ে আছে সদ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমান। জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপের পিছন থেকে রাজকীয় ভঙ্গিমায় উঠে আসে এক যুবক, তাকে দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে রাজবাহিনী। স্বয়ংক্রিয় মুখোশ খুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে সে এগোতে থাকে প্রাসাদের দিকে, দু’হাত ছড়িয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, "দেখতেই পাচ্ছ, আমি মারা যাইনি।"

২০১৮ সালে ব্ল্যাক প্যান্থার ছবিতে যখন এই সংলাপ বলছেন চ্যাডউইক অ্যারন বোসম্যান, পৃথিবী জুড়ে নানা প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়ছিল দর্শকের হাততালিতে। বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি ২০১৯ সালে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে তিনখানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল ছবিটি। কে জানত, তার পরের বছরই স্টেজ থ্রি কোলন ক্যান্সারের ছোবলে মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে শেষ হয়ে যাবে বোসম্যানের জীবন? করোনাকালে আর সকলের মতই বিধ্বস্ত পৃথিবীব্যাপী কমিকস ও সিনেমাপ্রেমীদের কাছে বাড়তি মনখারাপের হাওয়া বয়ে এনেছে এই সংবাদ, আন্তর্জালে শোকপ্রকাশ করছেন অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, ক্রীড়াপ্রেমী ও অগণিত সাধারণ মানুষ। ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার ছবিতে প্রথমবার ব্ল্যাক প্যান্থারের চরিত্রে অভিনয় করবার আগেই বোসম্যান কাজ করে ফেলেছিলেন ৪২, গেট অন আপ  প্রভৃতি বেশ কিছু ছবিতে, কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, পাঁচটি ছবি জুড়ে অভিনীত ওয়াকান্ডারাজ ট’চালার চরিত্রটিই তাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়, প্রবচনে পরিণীত হয় ‘উই ডোন্ট ডু দ্যাট হিয়ার’, ‘গেট দিস ম্যান আ শিল্ড’ ইত্যাদি ব্ল্যাক প্যান্থারের মুখের কথাগুলি। কিন্তু বোসম্যানের তাৎপর্য কি শুধুই ঝাঁ চকচকে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের জনৈক সুপারহিরোর অভিনেতা হিসেবে? অবশ্যই নয়। বর্তমান বিশ্বসংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সিনেমার পর্দায় ব্ল্যাক প্যান্থার চরিত্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মার্কিন সুপারহিরো কমিকসের প্রথম পর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির উৎকট প্রাধান্য বিদ্যমান। ডিসি মার্ভেলের জয়যাত্রার পূর্বে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় আশি ও নব্বইয়ের দশকের কচিকাঁচারা যেসব কমিকসে অভ্যস্ত ছিল, সেই টারজান বা ফ্যান্টম ছিল শুধুই কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে শ্বেতাঙ্গ নায়কের একঘেয়ে জয়গাথা, জাদুকর ম্যানড্রেকের সহকারী লোথারের মত কেউ কেউ কালেভদ্রে জায়গা পেত বড়জোর পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। অপরিণত পাঠকের বীরত্ব ও ব্যক্তিসৌন্দর্যের ধারণায় এভাবেই ঢুকে পড়তে থাকে জাতিভেদের বিষ, কৃষ্ণাঙ্গদের বারংবার কমিকসে ব্যবহার করা হয় সমাজবিরোধী বা বুদ্ধিহীন দর্শকের ভূমিকায়। তবে ষাটের দশক থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরবর্তীকালে ওঠে যে বিশ্বব্যাপী বিকল্প তত্ত্বচিন্তার ঢেউ, তার অভিঘাত ক্রমশ অনুভূত হয় মার্কিন গণসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায়, অনিবার্য পরিণতি হিসেবে প্রশ্নের মুখে পড়ে কমিকস ও কমিকস নির্ভর ছবিতে জাতিভেদের অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটি। মনে রাখতে হবে, ব্ল্যাক প্যান্থার কিন্তু প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো নির্ভর চলচ্চিত্র নয়, মার্ভেল কমিকসের আরেক কৃষ্ণাঙ্গ অতিমানব ভ্যাম্পায়ার শিকারী ব্লেডকে নিয়ে ইতিমধ্যেই তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে গিয়েছিল : ব্লেড (১৯৯৮), ব্লেড টু (২০০২) ও ব্লেড: ট্রিনিটি (২০০৪)। মানবজাতি ও ভ্যাম্পায়ারের মিশ্র জিন বহনকারী ব্লেডের কৃষ্ণবর্ণ নিঃসন্দেহে তার প্রান্তিক পরিচিতিটিই তুলে ধরে, কিন্তু ব্ল্যাক প্যান্থার ছবিটির সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এই তিনটি চলচ্চিত্রের থেকে বেশি। সাম্প্রতিক অতীতে নিক ফিউরি চরিত্রটির কৃষ্ণাঙ্গ চিত্রায়ণের মাধ্যমে মার্ভেল যে সামগ্রিক সম্প্রীতির বার্তা দেয়, তারই পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণ ঘটে অ্যাভেঞ্জার হিসেবে ব্ল্যাক প্যান্থারের আবির্ভাবে। ব্ল্যাক প্যান্থার জাতিভেদের প্রসঙ্গটির একেবারে মূলে আঘাত করে, শূরির তাচ্ছিল্যসহকারে উচ্চারিত ‘ডোন্ট স্কেয়ার মি, কলোনাইজার’ থেকে এরিকের শেষ সংলাপে দাসব্যবসার উল্লেখ সরাসরি আঘাত হানে ইউরোপ দ্বারা আফ্রিকার লুণ্ঠনের ইতিহাসের প্রতি। আফ্রিকার অভ্যন্তরে ওয়াকান্ডার মত সমৃদ্ধশালী নগরীর ধারণাটি নতুন নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কুকুয়ানাল্যান্ড বা জু-ভেন্দি অথবা বিংশ শতাব্দীর মার্কিন এডগার রাইজ বারোজের ঐশ্বর্যময় ওপার নগরীর মত নিদর্শন রয়েছে তৎকালীন একাধিক সাহিত্যকর্মে। কিন্তু এই লেখকেরা যেখানে এই নগরীর স্থাপক হিসেবে দেখিয়েছেন কোন কাল্পনিক অধুনালুপ্ত শ্বেতাঙ্গ জাতিকে, ওয়াকান্ডা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণাঙ্গ সৃষ্টি, এবং এই নগরীর অপার ধনসম্পদ ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বিস্মিত করতে পারে যেকোনো শ্বেতাঙ্গকে। ব্ল্যাক প্যান্থারের পিতার চরিত্রটির নামকরণ হয়েছে আফ্রিকার জুলু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি ট’চাকার নামানুসারে। পরিশীলিত, শক্তিধর ও অসীম বিত্তশালী রাজপুত্র ট’চালার সত্বাটি যেন শ্বেতাঙ্গ মননে পুষে রাখা অসভ্য, দরিদ্র ও কলহপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গের ধারণাটিকে সজোরে আঘাত করে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, টনি স্টার্ক/জেমস রোডস বা স্টিভ রজার্স/স্যাম উইলসন প্রভৃতি শ্বেতাঙ্গ নায়ক/কৃষ্ণাঙ্গ সহকারী জাতীয় চেনা ছকটিকে চুরমার করে দেয় ব্ল্যাক প্যান্থার, শ্বেতাঙ্গ সিআইএ এজেন্ট এভারেট রস এখানে সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হয়েছেন ট’চালা, শূরি ও ওকোয়ে দ্বারা। ডব্লিউ ই বি দু বোয়ার আগ্রাসী নীতি নয়, ট’চালার কর্মপদ্ধতিতে প্রাধান্য পেয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা বুকার টি ওয়াশিংটনের শান্তিকামী ও পারস্পরিক সহাবস্থানমূলক দর্শন, তাই তো ইনফিনিটি ওয়ার ছবিতে থ্যানোসের আক্রমণের মিলিত প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সে বহির্বিশ্বের কাছে ওয়াকান্ডার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে থাকে ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ব্ল্যাক উইডো প্রমুখ শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধাদের সঙ্গে। পরিশেষে বলা যাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের নিরিখে এই কাহিনী অবশ্যই বাড়তি গুরুত্ব বহন করে। মাত্র কয়েকদিন আগেই ২৫শে মে মিনিয়াপলিসে অফিসার কমান্ডো ডেরেক শভিনের নিপীড়নে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে প্রাক্তন বাস্কেটবল খেলোয়াড় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের, প্রতিবাদে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস' আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিক্ষোভের আঁচ লাগে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে। ব্ল্যাক প্যান্থারের স্বপ্ন সফল করে বর্ণভেদ ভুলে কি একসঙ্গে বাঁচতে পারবে আমেরিকার সাধারণ মানুষ, নাকি বৈষম্যমূলক অপমানের জ্বালা সইতে সইতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ যুবসমাজ পরিণত হবে এরিক কিলমঙ্গারের মত প্রতিশোধপরায়ণ দানবে, আজ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ এই অমোঘ প্রশ্নের মুখোমুখি। তাই নিঃসন্দেহে বলাই যায়, ছবিতে প্রদর্শিত ওয়াকান্ডার বেগুনি ফুলের দ্বারা বাস্তবের বোসম্যানকে পুনর্জীবন দান যদিও অসম্ভব, কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যু কখনোই খর্ব করতে পারবে না ব্ল্যাক প্যান্থার চরিত্রের বিপুল প্রাসঙ্গিকতাকে। বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ক্রমবর্ধমান আস্ফালনে যখন নিপীড়িত, অত্যাচারিত, জাতিভিদে জর্জরিত মানুষের প্রাণ হাঁফিয়ে উঠবে, মনে হবে মুমূর্ষু এই সমাজকে রসাতল থেকে উদ্ধারের আর কোনও আশা নেই, তখন হয়তো মৃত্যুঞ্জয়ী সেই আফ্রিকান রাজপুত্রের মতোই ফিনিক্স পাখির মত উঠে আসবে কোনো নতুন দিনের নায়ক, যুগান্তরের বার্তা এনে দৃপ্তকণ্ঠে দু’হাত ভাঁজ করে বলে উঠবে, "ওয়াকান্ডা ফরএভার!!" 


#Chadwick Boseman #ফিচার #স্মরণ #শ্রদ্ধাঞ্জলি #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

  • অনর্ঘ বিশ্বাস
    Aug 31, 2020 at 7:03 am

    বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ' বাজা তোরা রাজা যায় ' লেখেননি বুদ্ধদেব গুহ লিখেছেন অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

  • Ashutosh Sarkar
    Aug 30, 2020 at 3:37 pm

    এমনকি, এক জায়গায় পড়লাম, সিনেমায় আফ্রিকান একসেন্টকেই জায়গা দেওয়ার জন্যও যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো চ্যাডউইককে। তোমার লেখা সব সময়ই নতুন কিছু শেখায়, এবারেও তার অন্যথা হয়নি।

  • অনর্ঘ বিশ্বাস
    Aug 30, 2020 at 2:33 pm

    বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য - এর একটি লেখা ছিল, ' বাজা তোরা রাজা যায় ' - বনের রাজার জীবন চরিত। শেষ বেলায় কাপুরুষ শিকারির গুলি বুকে নিয়ে চলে যেতে যেতে যে আকাশের চাঁদ কে খেলতে ডাকে, চলে যায় হাসতে হাসতে - আসলে রাজাদের তো কাঁদতে নেই। আজকে কিন্তু বাজনার শব্দের বড্ড প্রয়োজন। রাজা তো সত্যিই আজ চলে গেলেন -- জঙ্গল কাঁপানো হুংকার আর শোনা যাবে না সে বাঘের। অন্ধকারে মিশে গিয়ে নজর রাখবেনা সেই অতন্দ্র প্রহরী। প্রিয় পাহাড়ের উপর থেকে সূর্যাস্ত আর দেখবে না সে। বাবার সাথেই প্যান্থার-বট বৃক্ষের আসে পাশে ঘুরে বেড়াবে হয়তো। বাবা হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, 'ভালো করে তাকিয়ে দেখো তাচালা, পৃথিবী কি আজ সত্যিই ভালো আছে?' তার সদাহস্যময় পুত্র, জবাবে বলবে, 'পৃথিবীকে ভালো রাখবো তো আমরাই, নয়কি?' তার সেই হাসিই হোক পাথেয়। বুকের কাছে জড়ো করে মুঠো বাঁধা হাত তাঁকেই তো সেলাম জানাবে। তার ফেলে রাখা আংটি তুলে নেবে নতুন প্রজন্ম। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবে সেই সোনালী সূর্যোদয়ের দিকে, যেখানে রং শুধু বৈচিত্রই আনবে, ব্যবধান নয়। বিপ্রনারায়ণ এর লেখা বড় উদ্বুদ্ধ করলো। হিরোরা আসে যায়, রাজাদের মৃত্যু হয় না।

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

24

Unique Visitors

225520