ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

রূপকথার ক্যানভাস, জীবনের রং

সায়নদীপ গুপ্ত Aug 14, 2020 at 3:49 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছায়াছবি : কুম্বালাঙ্গি নাইট‌স
পরিচালক : মধু নারায়াণন
গল্পকার : শ্যাম পুষ্করন
চিত্রগ্রাহক : শাইজু খালিদ
সঙ্গীতকার :সুশিন শ্যাম
পরিবেশক : অ্যামাজন প্রাইম

সে ছিল এক গ্রাম। তার প্যালেটে নানান শেডের সবুজ, তার চাঁদোয়া জুড়ে আকাশরঙা নীল। জোছনাভাঙা খাঁড়ির জল সে গ্রামের শরীর ভিজিয়ে দেয় সুয্যি ডুবে গেলে। সকাল হলে বাড়ির জোয়ান ছেলেরা নদীতে জাল ফেলতে যায়। মাছ ওঠে, ট্রলারে চাপে, চলে যায় বরফঢাকা অন্ধকারে। শ্রান্ত দেহ ঘরে ফিরে আসে, মেয়েরা কাজের শেষে সন্ধ্যের আঙিনায় নিজেদের স্কুটার হেলান দিয়ে রাখে। ঝগড়া হয়, খাবার ফেলে উঠে যায় কেউ, তবু খুশি টসকায় না। কারও হাসি মলিন হতে শেখেনা।

ভগবানের আপন দেশের সেই কুম্বালাঙ্গি গ্রামের নানান রাতের কোলাজ নিয়ে তৈরি এক মায়াবী জলছবির নাম কুম্বালাঙ্গি নাইট্স। গোটা ছবির শরীর জুড়ে গল্প বয়ে যায় মোহনায় মিশে যাওয়া নদীর মতো; ঋজু অথচ পেলব স্রোতের ধারা। ইতিউতি বাঁক আছে, অতলের চোরা টান আছে, তবু সে ধারা শান্ত, স্নিগ্ধ। গল্পের কেন্দ্রে চার ভাইয়ের এক জোড়াতালি সংসার। বড় ভাই সাজি আর ববি, খুচরো কাজে দিনযাপন করে, সামান্যতম সুযোগেই একে অন্যের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাদের এই নির্বোধ রোজনামচায় বিরক্ত হয়ে মেজোভাই বনি তার মূক কণ্ঠের ভাষা খুঁজে নেয় নাচের ছন্দে। ম্যাচ জেতার আনন্দের মাঝেও স্কুলের বন্ধুরা যখন ছুটিতে তার বাড়ি আসতে চায়, ছোটভাই ফ্র্যাঙ্কি আপ্রাণ চেষ্টা করে ইঁটের কঙ্কালে ঢাকা সেই হতাশা লুকিয়ে রাখতে, তার দুই দাদার বেকার জীবনের দৈনন্দিন আকচাআকচি সবার থেকে আড়াল করতে। তবু সে বনির মতো সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারেনা, রাত নামলে খাবারের থালা তুলে দেয় দুই ভাইয়ের হাতে। একরাশ শূন্যতা নিয়ে তাদের অসংবেদী আচরণ চেয়ে দেখে দিনের পর দিন। তাই হয়তো বনিও তার এই ছোট ভাইটিকে আগলে আগলে রাখতে চায়।

তবু একটানা বৃষ্টির পরে হঠাৎ একদিন যেভাবে বাগানের মাটিতে ঝরে থাকে একমুঠো শিউলি, ববির উড়নচণ্ডী জীবনে সেভাবে নেমে আসে বেবি। শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটির প্রত্যয়ী স্বভাব ববিকে বাধ্য করে রোজগারের কথা ভাবতে। বেবির জামাইবাবু শাম্মি তার পৌরুষের কর্তৃত্ব জাঁকিয়ে দেয় আস্তে আস্তে – খাওয়ার টেবিলে বসার জায়গা থেকে শুরু করে বেবির নিজের হাতে গড়ে তোলা হোম-স্টে ব্যবসাতে অনধিকার চর্চায়, শাম্মির মেকি স্বাভিমান সব সম্পর্ককে গিলে খেতে থাকে। সাজির এক দুর্বল মুহূর্তের ভুলে তার একমাত্র বন্ধু প্রাণ হারায়। চরম আত্মগ্লানিতে সাজি এমন এক সিদ্ধান্ত নেয়, যা সমাজের ঠিক-বেঠিকের ধারণাকে খড়কুটোর মত অবজ্ঞা করে। ববি ও বেবির ভবিষ্যতকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবু এই প্রথমবার, কোন এক অদ্ভুত একাত্মতার বীজ চার ভাইকে আরও কাছে টানতে থাকে। গল্প এগিয়ে চলে আরও অদ্ভুত এক বাঁকের পথে।

ছবির প্রথমার্ধেই শাইজু খালিদের ক্যামেরা বুঝিয়ে দেয় কেরালার প্রকৃতি এই গল্পের শিরদাঁড়া। জেলেদের জীবনের ছোটখাটো মুহূর্ত, জলের বুকে অলস নৌকাটান, আকাশের গায়ে ছুঁড়ে দেওয়া মিহিজাল আর রাতের কুম্বালাঙ্গির আদর – সবকিছু ঘুরেফিরে আসে প্রতিটি চরিত্রের কোল ঘেঁষে। আবহসঙ্গীত কোথাও এতটুকু উচ্চকিত নয়, বরং ছবির অনেকাংশ জুড়েই নৈঃশব্দের সুর খেলা করে, কী প্রেমে কী কলহে। চেরাথুকাল বা উইরিল থোড়ুম-এর মতো গান স্নায়ুকে অবশ করে, মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে অঘটন বাড়ে। নাটকীয়তা আসে, কিন্তু তার অভিঘাত কোন ক্ষত সৃষ্টি করে না, শুধু গল্পকে এক জমি থেকে অন্য জমিতে নিয়ে যেতে যেতে আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে মাত্র। দেখতে দেখতে ভুলে যাওয়া যায় ভাষার ব্যবধান, মানুষের ভাল রাখার ইচ্ছাতে বিশ্বাস জন্মায়, প্রাত্যহিকতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ম্যাজিক চিনতে শিখি আমরা সবাই।

সেই ম্যাজিকের এক ছোট্ট হগওয়ার্টস, কুম্বালাঙ্গি নাইট‌স।

#ফিল্ম রিভিউ #টলিউড #কুম্বালাঙ্গি নাইটস

  • শুভ
    Aug 26, 2020 at 11:35 am

    লোভ হয়ে গেল গল্পের দেশটায় ঘুরে আসার।

  • Suvankar
    Aug 14, 2020 at 2:41 pm

    একদম ঠিক যে জায়গায় থামলে লোকে সিনেমাটা দেখবে এর পর, সেইখানে থেমেছিস।

  • Anwesha Sengupta
    Aug 14, 2020 at 10:20 am

    Jamon shundor chhobita... Tamon e shundor kore khub jotno niye lekha ei golpo ta..

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

14

Unique Visitors

225510