পরীক্ষা
কলিংবেলটা বাজতেই ভ্রূ কুঁচকে গেল অসীমার। প্রতি সপ্তাহের এই রুটিনে সে এখনও অভ্যস্ত হতে পারেনি। এমন নয় যে তাকে দৈনন্দিন কাজের বাইরে খুব বেশি কিছু করতে হয় – শুধু এক কাপ চা বানিয়ে সামনে রেখে আসা। ব্যস। তবু অকারণ একটা খচখচানি মনের মধ্যে খেলে বেড়ায়।
দরজাটা খুলতেই বোকার মতো হাসল মানুষটা। প্রয়োজন ছিল না। আজ প্রায় তিনমাস হতে চলল সুখেন্দু এই বাড়িতে আঁকা শেখাতে আসছে। প্রতিবারই ঢুকে বসার ঘর পেরিয়ে বাঁদিকের ছোট ঘরটায় চলে যায়। চেনা গতে বাঁধা। তা সত্ত্বেও তার এই অপ্রস্তুতি দেখলে অসীমার বিরক্তি বেড়ে যায়।
“রুহি ...?”
“ঘরেই আছে। আসুন।”
ছোট ফ্ল্যাটে এই ঘরটায় আসবাবপত্র সামান্যই, রিডিং টেবিল আর একটা আলমারি, ডিভানের মাথার কাছে রাখা। এই ঘর থেকে বসার ঘরটা খুব একটা ভালোভাবে দেখা যায় না। প্রথম দু’দিন সুখেন্দু ওইখানে বসেই আঁকা শিখিয়েছিল রুহিকে। অসীমা তখনই টের পেয়েছিল, রান্নাঘর থেকে এদিকে চোখ পড়লেই খচখচানিটা তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই পরের দিন থেকেই জায়গা বদল। অথচ তাতেও কি রেহাই আছে? এই অস্বস্তির কারণ না বুঝতে পারাটাই তো আরও বেশি অস্বস্তিকর! আচ্ছা, অসীমা তো কোনও দোষ করেনি, কারও খারাপও ভাবেনি, তাহলে এই অস্বস্তি কেন? শুধুই ওই লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে? একবার রজতকেও বলেছিল, সে তো বলে দিল গ্যাস হলে নাকি ওরকম অস্বস্তি হয়! বারান্দার কাপড়গুলোয় ক্লিপ লাগিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল অসীমা, টিফিন বানাতে হবে। আঁকার ক্লাস শেষ হলেই রুহির পুল-কার চলে আসবে সময়মতো। এই সময়টা তার পুরো যন্ত্রের মতো কাটে, একচুল এদিক ওদিক হলেই মাথা খারাপ! তাও বাঁচোয়া, রজত অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য সিকিম গিয়ে বসে আছে, সে থাকলে তো হুজ্জুতি আরও বাড়ে।
টিফিন বানানোর মাঝেই বসার ঘরে রুহির গলা পেল অসীমা। ক্লাস শেষ। অন্য মানুষটার গলা বিশেষ পাওয়া যায় না, দরজার আওয়াজে বুঝল সে বেরিয়ে গেছে। যমুনামাসি একবার বলেছিল, “আচ্ছা বউদি, গুড়গুড়ির মাস্টারমশাই কি কচ্ছপ?” মনে পড়তেই কোনোরকমে হাসি চাপল সে। রুহি শুনলে খুব রেগে যায়, এখনও কেন মাসি তাকে গুড়গুড়ি বলে ডাকবে! তার না ক্লাস ফোর! “রুহি, স্নানে যাও মাম্মা। এবার কিন্তু দেরি হয়ে যাবে” – কথাটুকু বলেই আবার টিফিনবক্সটা মুছতে লাগল অসীমা।
“জানো মাম্মাম, স্যার বলেছে, আমায় নেক্সট দিন থেকে ওয়াটার কালার শেখাবে!”
অসীমা রান্নাঘরের দরজার দিকে ঘুরে তাকাল। রুহির চোখেমুখে উত্তেজনা উপচে পড়ছে। হেসে বলল, “বেশ তো, তাহলে তোর প্রোমোশন হল বল? ভেরি গুড!”
“কিন্তু আমার তো ওয়াটার কালার নেই।”
“বাবা কাল ফিরুক, আমি বলব। এবার কিন্তু তুমি স্নানে না গেলে গাড়িকাকু চলে যাবে।”
(২)
বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট ছাড়তে কখনও এত লেট করে না। আজ সকালেই রজত বুঝেছে দিনটা খারাপ। শেষ মুহূর্তে ক্লায়েন্ট বেঁকে বসল, টেকনিক্যাল টিমও চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারল না। রজত আর টেকনিক্যাল টিমের অরিন্দম তিনদিন ধরে মাটি কামড়ে পড়েছিল ডিল ক্লোজ করার জন্য। সবকিছুই আপাতত এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে ফেলে আসতে হয়েছে। যদিও রজতের বিশ্বাস, ব্যাপারটা এখনও তাদের হাত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যায়নি, তবু উপরমহলে এটা বোঝাতে কালঘাম ছুটে যাবে। তাড়াহুড়োয় অসীমাকে সারাদিনে একটা ফোনও করা হয়নি। অ্যাপক্যাবের সিটে মাথাটা এলিয়ে দিল রজত, খুব ক্লান্ত লাগছে এবার।
বাবা!” কলিং বেলের আওয়াজটা মিলানোর আগেই রুহির গলা টের পেল রজত। দরজা খুলতেই একটা ছোট্ট শরীর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। “ওহ হো হো! আমার রুহিসোনা যে এই তিনদিনে আরও একটু পাগলি হয়ে গেছে! দাঁড়া বাবা, একটু ফ্রেশ হয়ে আসতে দে”, কোনোরকমে নিজেকে মুক্ত করে বউয়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল। “জামাকাপড়, তোয়ালে সব বাথরুমেই রেখেছি। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে এসো প্লিজ, চা বসাচ্ছি কিন্তু”। অসীমা রান্নাঘরে যেতে যেতে ফিরে তাকাল, “হোমওয়ার্কগুলো শেষ করে নে রুহি, বাবা এখন পালিয়ে যাচ্ছে না।”
“সরি, ফোন করতে একদম ভুলে গেছিলাম”, চায়ে চুমুক দিয়ে বালিশটা টেনে নিল রজত। “আসলে এত ঝামেলা হল এবারের কাজটায়...” তিনদিনের জমানো গল্পের ঝাঁপি খুলে যায়। অসীমা জানে, এখন রজতকে থামতে বলা মানে সারাদিনের মুখভার, অতএব অফিসের সব গল্প, সব খুঁটিনাটি শুনে তবে শান্তি। যতি টানতে হল অবশ্য রুহির জন্য। পড়া শেষ করেই একলাফে বাবার পাশে বসে বায়না, “বাবা, আমায় ওয়াটার কালার এনে দেবে প্লিজ?”
“কেন রে? আবার ওয়াটার কালার কেন?”
“স্যার বলেছে এবার থেকে আমি ওয়াটার কালার শিখব, প্যাস্টেল দিয়ে তো আমি সব আঁকতে পারি।”
“এত্ত জলদি প্রোমোশন! করেছিস কী রে! আচ্ছা বেশ, স্যার বলেছেন যখন, তখন তো দিতেই হয়।”
“থ্যাংক ইউ বাবা!”
অসীমা চট করে একবার কালকের শিডিউলটা ভেবে নিল। “পাড়ার দোকানটাতেই পেয়ে যাবে তো?” মাথা নাড়ল রজত, “পাগল! ওই সহদেব স্টোর্সে? থোড়াই কোনো কোয়ালিটির জিনিস থাকে ওখানে! তা ছাড়া রং কিনলেই তো হবে না, ভালো ব্রাশ চাই, একটা প্যালেট চাই। না না, গড়িয়াহাট যেতে হবে।” “তাহলে এই উইকএন্ডেই কিনে ফেলো, সপ্তাহের মাঝে তো আর সময় পাবে না ওদিকে যাওয়ার”, অসীমা চায়ের কাপগুলো তুলে রান্নাঘরের দিকে এগোল।
“শোনো না...”
“কী হল?”
“তুমি কিনে আনো না।”
“আমি! আমি এসবের কী বুঝি? আর তোমার যেতে কীসের আপত্তি?”
“না মানে, এই শনিবারটা...”
“আবার তুমি দেরিতে ফিরবে?”
“প্লিজ ম্যাডাম, একটু বোঝো! তোমায় তো বললাম আজকের ব্যাপারটা, এই নিয়ে এজিএম অবধি তোলপাড় হচ্ছে। সামনের হপ্তা অবধি অবস্থা খুব টাইট। সামাল দাও প্লিজ!”
“রজত, আমি এগুলো চিনি না, বুঝিও না! গড়িয়াহাটে গিয়ে কি শাড়ির দোকানে রং চাইব?”
“আরে দোকান তো আমি বলে দেব, তুমি শুধু গিয়ে দাঁড়াবে। ওরা সব হেল্প করে দেয়।”
“মাম্মাম প্লিজ!” রুহির দিকে তাকিয়ে নিজেকে আটকে নেয় অসীমা। “ঠিক আছে, কাল তোমরা বেরিয়ে গেলে আমি কিনে আনব। কিন্তু রুহি, তুমি স্যার আসার আগে সেগুলো নিয়ে ওলটপালট করবে না”, রজতের দিকে কটমট করে তাকাল একবার। একগাল হেসে রজত বলে, “আজ ডিনারে কী আছে?”
(৩)
নন্দী স্ট্রিটের মুখটা পেরিয়ে ফুটপাথের উপরে ছোট্ট দোকানটা খুঁজে পেতে অসীমার সময় লেগে গেল ঝাড়া পনেরো মিনিট। অফিসটাইমের গড়িয়াহাটে এমনিতেই হাঁসফাঁস দশা, তার উপর আজ মনে হচ্ছে যেন একটা জ্বলন্ত কড়াই উল্টে শহরের উপর এঁটে আছে। দোকানের ছোট জায়গায় ফুল স্পিডে একটা ফ্যান ঘুরলেও গায়ে হাওয়া লাগছে না। নিজের প্রয়োজনটা জানিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল অসীমা। একজন কাস্টমার বেরিয়ে গেলে দোকানটা একটু ফাঁকা হল, দোকানদার তার দিকে ফিরলেন।
“কী লাগবে বলছিলেন যেন? জল-রং?”
“হ্যাঁ, আমার মেয়ের জন্য। সবে শিখছে কিন্তু।”
“বেসিক ছয় কালারের সেটটাই নিন তাহলে, নাকি? বারো রঙের সেট তো এখনই লাগছে না।”
“আচ্ছা ...”
“ছোটটাই নিন, এখন কাজ হয়ে যাবে।” কথাটা শুনে ঘুরে তাকাতেই অসীমার বুকের ভিতর যেন একটা ধাক্কা লাগল! এই লোককে কোথাও কোনোভাবেই দেখার আশা করেনি সে। সুখেন্দু হেসে বলল, “রুহির জন্য তো? ছোটটাই নিন, এখন ওকে কিছুদিন ভালোমতো প্র্যাকটিস করতে হবে।”
“দিদি, প্যাক করে দিই তাহলে?” দোকানির কথায় অসীমার সংবিৎ ফিরল। আসলে সুখেন্দুকে এখানে দেখে যতটা অবাক লেগেছে, তার চেয়েও বেশি অবাক লেগেছে এত হেসে হেসে কথা বলতে দেখে। বাড়িতে এলে যে লোক গুটিয়ে বসে থাকে, বাইরে যেন সে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে! দোকানি এবার তাকিয়েছে সুখেন্দুর দিকে। “ওই সাইজের ক্যানভাস তো হচ্ছে না সুখেন্দুদা, তুমি নেক্সট উইকে আস না একবার!”
সুখেন্দু একটু হতাশ হয়ে অসীমার দিকে তাকাল। তারপর তার মুখের ভাব লক্ষ করেই যেন আবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে “আজ আসি, কেমন?” বলেই দোকানের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। অসীমা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, স্পষ্ট টের পাচ্ছিল তার খচখচানিটা আবার ফেরত আসছে। দোকানি টাকাটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সুখেন্দুদা আপনার মেয়েকে আঁকা শেখায় বুঝি?”
“হ্যাঁ, এই মাস তিনেক হল।”
“ভালো লোককেই পেয়েছেন। এখন ছোকরা টিচারগুলো যা হয়েছে, অসহ্য! ফালতু কেসে না জড়ালে এই লোকের আরও ভালো ইনকাম হত।”
অসীমা খুচরোগুলো ব্যাগে রাখতে গিয়ে আটকে গেল, “ফালতু কেস মানে?”
“ওই কেচ্ছার ব্যাপার, আপনার সামনে আর কী বলব। কমবয়সি ছাত্রীর সঙ্গে... তা সে দোষ দু’পক্ষেরই, বোঝেন তো? বউ-বাচ্চা ছেড়ে চলে যাওয়াতে খুব ভেঙে পড়েছিল লোকটা, শুনেছি ডাক্তার-ফাক্তার দেখাতে হয়েছিল। তবে ভাববেন না চুকলি করছি, আঁকাটা সত্যিই ভালো শেখায়।” দরজার বাইরে গাড়ির হর্ন আর হকারদের আওয়াজ যেন মাথার ভিতরে চেপে বসে সবকিছু অন্ধকার করে দিল। গা গুলিয়ে উঠছে, কোনোমতে ল্যাম্পপোস্ট ধরে সামলে নিল। মোবাইলের স্ক্রিনটা ঝাপসা, তবু রজতের নম্বরটা খুঁজে পেতেই হবে। প্রাণপণে হাতড়াতে থাকল অসীমা।
(৪)
“ইম্পসিব্ল!” চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শব্দটা ছুড়ে দিল রজত। “একটা লোক কবে কী করেছে, তার জন্য এখন তাকে তাড়িয়ে দেব? আমাদের কোম্পানিতে এসব হলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যেত। আর এর সঙ্গে তোমার খচখচানির কী সম্পর্ক, আমার তো মাথায় ঢুকছে না!”
“কিছুই ঢুকছে না মাথায়? এইরকম একটা নোংরা লোকের সঙ্গে রুহিকে বসিয়ে রাখতে কী সমস্যা, সেটাও মাথায় ঢুকছে না নিশ্চয়ই?”
“এবার কিন্তু তুমি ওভাররিয়্যাক্ট করছ, রুহি একটা বাচ্চা মেয়ে ...”
“ওভাররিয়্যাক্ট! একটা দুশ্চরিত্রের সামনে তুমি বয়সের দোহাই দিচ্ছ?”
“আরে লোকটা রেপ করেনি, অ্যাফেয়ার করেছে!”
“গলা নামিয়ে কথা বলো! রুহি পাশের ঘরেই আছে। আর এটাই যদি তোমার যুক্তি হয়, কাল তুমিও তাহলে অ্যাফেয়ার করতে পারো? মেন উইল বি মেন, তাই না?”
রজত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। “তুমি যা ভালো বোঝো করো, আমার আর তোমার সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছে নেই। শুধু এটুকু মাথায় রেখো, রুহির কিন্তু ড্রয়িং-এ সত্যি ইন্টারেস্ট আছে আর এঁর কাছে শেখাটা ও এনজয় করে।”
“তিন মাস। তিন মাসে একটা মানুষ এমন কিছু ম্যাজিক করেনি যে আর-একজন ভালো টিচারের কাছে শিখতে ইন্টারেস্ট পাবে না।” চায়ের কাপ দুটো নিয়ে অসীমা রান্নাঘরে চলে গেল।
(৫)
ম্যাজিক কাকে বলে, রজত দিব্যি টের পেয়েছে। নতুন চাকরির শুরুতেই অরিন্দম ছেলেটা যেভাবে বিজয়গড়ে একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট নামিয়ে দিল, তার অন্য কোনো ব্যাখ্যা হয় না। বহুদিন ধরেই বলছিল, “রজতদা, একদিন চলে এসো পরিবার নিয়ে”, আজ একটা ফোন করে তাই চলে এসেছে রজত। একা। রোববার সকালে রুহির গানের ম্যাডাম আসেন, সবার আসা হত না। সত্যি বলতে সে নিজেই বাড়িতে থাকতে চায়নি। ছুটির দিনগুলোতে মেয়ের মুখের দিকে চাইতে তার কষ্ট হয়।
শেষ চারমাসে একটা আঁকার স্কুল আর একজন টিচার বদলাতে হয়েছে, কাউকেই রুহির বেশি দিন পোষায়নি। উল্টে বাচ্চা মেয়েটা দিনে দিনে আরও গোমড়া হয়ে গেছে। রুহিকে যদিও বলা হয়েছিল স্যারের শরীর খারাপ, মেয়ে যে সেটা মোটেই হজম করেনি সে ব্যাপারে রজত নিশ্চিত। বাচ্চাদের মধ্যে মিথ্যে ধরে ফেলার একটা রাডার লুকোনো থাকে। মেয়েটা এমনিতেই একটু অনুভূতিপ্রবণ, এই ঘটনাটা ধীরে ধীরে তাকে জাপ্টে ধরেছে। গান শেখাটাও অসীমা চাপিয়ে দিয়েছে, আঁকার পরিবর্ত হিসেবে। কিছু কিছু বিষয় যে রিপ্লেস করা যায় না, সেটা রজত বুঝিয়ে উঠতে পারেনি। মা-মেয়ের জেদের মাঝে সংসারের স্বাভাবিক তালটাই কেটে গেছে।
অরিন্দমের বাড়ি থেকে বেরোতেই প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। মনীষাকে কথা দিয়েছে একদিন বউ-বাচ্চা নিয়ে আসবেই আসবে। গলি থেকে বড়রাস্তা একটু ঘুরপথ, সম্ভবত সেইজন্য ফ্ল্যাটটা একটু সস্তায় পেয়ে থাকতে পারে - সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গলির মুখে পুরসভার স্কুলটার কাছে এসে থমকে যায় রজত। সকালে যখন এসেছিল, এদিকে বিশেষ লোকজন ছিল না। এখন স্কুলঘরের সামনে কতগুলো কচিকাঁচার ভিড়, ইতিউতি কয়েকজন বাবা-মাও আছেন। ভিড়ের চেহারায় বিত্তের ফারাকটা স্পষ্ট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে তাকিয়ে রজতের দম আটকে গেল।
“আপনি এদিকে?” আলতো হাসি সুখেন্দুর মুখে।
“আমি, মানে, এক কলিগের বাড়িতে... আপনি?”
“আমি রবিবার করে এই বাচ্চাগুলোকে একটু আঁকা শেখাতে আসি।”
“এখানে?”
“হ্যাঁ, স্কুলঘরটা ব্যবহার করার অনুমতি নেওয়া আছে। আসলে অবৈতনিক তো, ক্লাবের ছেলেদের বলতে ওরাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।”
এখান থেকে ডানদিকে সোজা এগোলেই বড়রাস্তা। ঘাড় ঘোরালেই দেখা যাচ্ছে। তবু রজতের মনে হল তার পা দুটো যেন পিচের সঙ্গে সেঁটে গেছে।
“রুহি ভালো আছে তো?”
এই প্রশ্নটাই শুনতে চায়নি রজত। এই প্রশ্নটাই এড়িয়ে যেতে চেয়েছে এতদিন। কেমন আছে রুহি? এত শূন্যতা কোথায় ছিল?
“আপনি এই... এই বাচ্চাদের এমনি এমনি বিনা পয়সায় আঁকা শেখান?”
প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলল সুখেন্দু। “কোনটা এমনি? বিনা পয়সায় শেখানোটা, নাকি একটা খারাপ লোকের সমাজসেবা করাটা?”
রজতের মনে হল দলা দলা কী যেন বুকে পেটে পাক খেয়ে উঠছে। “আমি অসীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম! কিন্তু ও শুনল না!” গোঙানির মতো কথাগুলো ছিটকে বেরিয়ে এল।
সুখেন্দু মাথা নাড়ল, “আমি বুঝি। আমার জন্য এটা নতুন নয়। কিছু দাগ মানুষের সঙ্গে থেকে যায়, বারবার মনে করিয়ে দেয় যেন ওই পাঁকে আর ডুবে না যাই।”
একটু চুপ করে থেকে সুখেন্দু বলতে থাকে, “এখানে যারা আসে, তাদের হয়তো কিছু টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আছে। কিন্তু টাকা দিলে ওরা মন দেবে না, জানেন? স্কুলে কী শেখে জানি না, এখানে অন্তত একঘণ্টা প্রাণ খুলে রংতুলি নিয়ে কাটায়। আপনি জিজ্ঞেস করলেন না, এমনি এমনি শেখাই? ধরে নিন, এটা একটা অ্যাসিড টেস্ট। সপ্তাহের এই একটা দিন, নিজেকে নিজের কাছে ছোট হতে না দেওয়ার লড়াই।” গলার শিরাগুলো দপদপ করতে থাকে। “আমি আসি, ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে”, সুখেন্দু ফিরে হাঁটতে শুরু করে।
বুকের ভিতর শব্দ হাতড়াতে থাকে রজত। কিছু দাগ মানুষের সঙ্গে থেকে যায়। এই দাগ সঙ্গে নিয়ে চলতে পারবে সে?
“সুখেন্দুবাবু ...”, রজতের গলা ধরে আসে। “রুহি ভালো নেই। আঁকাটা বন্ধ হয়ে গিয়ে ও একেবারেই ভালো নেই। মেয়েটার চোখ দুটো কীরকম... ওই চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়। আপনি ওকে আবার শেখাবেন প্লিজ? আমার বাড়িতে যেতে না চাইলে রুহিকে এখানে নিয়ে আসব?”
“এখানে?” বিস্ময় ঝরে পড়ে সুখেন্দুর গলায়।
“হ্যাঁ এখানে! রংতুলি নিয়ে একঘণ্টা। রুহির খুব প্রয়োজন, বিশ্বাস করুন!”
“আপনার আপত্তি নেই, রুহিকে এদের সবার সঙ্গে শেখালে?”
“না।”
“আর রুহির মা?”
বেলা বাড়ছে। সে শুনলে কী বলবে? অশান্তি হবে। কতটা অশান্তি? রুহির মনের চাইতে বেশি?
সুখেন্দুর চোখে চোখ রাখে রজত, “অসীমাকে আমি বোঝাব। ওটা আমার অ্যাসিড টেস্ট।
অলংকরণ: বিদিশা বিশ্বাস