রান্নার কথা, নাকি কথার রান্নাঘর
_1366x1366.jpg)
বই: ইন্দুবালা ভাতের হোটেল লেখক: কল্লোল লাহিড়ী প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য প্রকাশক: সুপ্রকাশ বইঘর মূল্য: ২৩০/-
এককালে প্রতিভাস থেকে পাওয়া যেত দশ টাকা দামের একটি পাতলা বই। প্রচ্ছদে দুটো এবড়োখেবড়ো কালো ছোপ, যেন অসাবধানে খানিকটা কালি ফেলে দিয়েছে কেউ। তাদের মাঝখানে একটা সরু কাঁটাতার। ওরকমই অসাবধানে কেটেকুটে ফেলা দেশটার দুটো টুকরোকে নইলে কে চেনাবে! বইটির নাম ‘নন্দর মা’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এর সূত্রে জয় গোস্বামীর যে কবিতাটি অনেকেরই পরিচিত। কিন্তু, কল্লোল লাহিড়ীর সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’-এর কথা বলতে বসে হঠাৎ নন্দর মাকে মনে পড়ল কেন?
মনে পড়ল, কারণ নন্দর মা-র মতো ইন্দুবালারও শিকড় রয়ে গিয়েছিল অন্য একটা দেশে। ইন্দুবালাও ভিটে হারিয়েছিলেন। অবশ্য মেয়েদের জীবনে ‘ভিটে’ শব্দটাই তো হাস্যকর! নইলে সারা বাড়ির আর কাউকে ঠাঁইনাড়া হতে হল না, কেবল ইন্দুবালা ছাড়া! সম্পন্ন গেরস্থ ঘরের মেয়ে ইন্দু, মাতাল দোজবরে স্বামীর হাত ধরে এসে উঠেছিল একটা দমবন্ধ করা শহরে। পিছনে পড়ে ছিল কলাপোতা গ্রাম, কপোতাক্ষ নদ, গোয়ালে হরিমতি, ঠাম্মার হাতের রান্নার স্বাদ, ভাইয়ের পায়ে পায়ে ঘোরা, ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, আর...। বাকিটা কোনোদিনই বলে উঠতে পারেননি ইন্দুবালা।
“আমাদের পুরনো বাড়িরসব গোরু,ডাকছে, দুশো মাইল দূর থেকে... শুধুগোরু নয়, গোরুর রাখালও ডাকছে, বাড়ির মুনিষও ডাকছে,... ... আমাদের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, গাছপালাসবাই চিৎকার করে ডাকছে ওই পঞ্চাশ বছর ও-ও-ই পঞ্চাশ বছর দূর থেকে”
আজীবন বুকের ভিতর সে ডাক বাজছিল বলেই হয়তো একা হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ইন্দুবালার। তাঁর চেনা দেশটা তাঁর স্বপ্ন ছাড়া আর সব জায়গা থেকেই হারিয়ে গিয়েছিল ক্রমশ। হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিবারও, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। আর পূর্ব পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশ হল, সেদিনই ছেনু মিত্তির লেনে প্রথম আঁচ পড়ল ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। নিজের আর অন্যদের স্বপ্ন আর সাধ মিলে সে হোটেলে রান্নায় ফোড়ন পড়তে থাকল রোজ। আর ইন্দুবালার হিসেবের খাতায় জুড়ে যেতে লাগল অন্যদের জীবনের এক-একটা পাতা।
না, ইন্দুবালা ‘নন্দর মা’ নন। কারণ তাঁর নাম হারিয়ে যায়নি। তিনি ব্রজমোহনবাবুর মেয়ে নন, মাস্টার রতনলাল মল্লিকের বউ নন, প্রদীপ-সুদীপ-ইতুর মা-ও নন কেবল। তিনি সেইসব মেয়েদের একজন, যাদের স্বপ্নগুলো রোজ ইমিগ্রেশন খাতায় জমা পড়ে যায়। এ গল্প তাই লছমীরও। এ গল্প মনিরুল বা অলকেরও, যাদের ঘরে ফেরা হয়ে ওঠে না আর। সমস্ত উদবাস্তু মানুষের নিজস্ব আখ্যান ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’।
এ বইয়ের পরতে পরতে লেগে আছে বাংলার ভুলে যাওয়া হেঁশেলের গন্ধ। সত্যি বলতে, পুরুষের কলমে গেরস্থালির এমন নিবিড় ছবি খুব বেশি চোখে পড়ে না। ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়ার গল্পের এমন অন্যতর বয়ানও বড় অচেনা। এই চিৎকৃত সময়ে আরেক রাক্ষুসীবেলার কর্কশ শব্দেরা যে এমন মায়াঘেরা জলছবি হয়ে উঠতে পারে, এ বই না পড়লে সে কথা অজানাই থেকে যেত।
মেখলা ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ মানানসই। তবে প্রুফ রিডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশকের অবহেলা নজরকাড়া। আর এক মাসের মধ্যে বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির সমানুপাতিক সম্পর্কও আশ্চর্য করে বইকি!
(উদ্ধৃত কবিতাটি জয় গোস্বামীর লেখা, ‘নন্দর মা’ বইয়ের অংশ) কভারঃ আলোচ্য বইটির প্রচ্ছদ
#রান্না #ইন্দুবালা ভাতের হোটেল #কল্লোল লাহিড়ী #সুপ্রকাশ বইঘর #book #book review #2020 #new book #suprakash boighar #Indubala Bhater Hotel #রণিতা চট্টোপাধ্যায়
জয়দীপ চ্যাটার্জী
সুন্দর প্রতিক্রিয়া রণিতা। ধন্যবাদ।