চাঁদের গায়ে লেখা আছে সোফিয়ার নাম

প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিলেন সেই প্রতিভাময়ী নারী। মৃত্যুর একশ বছর কেটে যাওয়ার পর তাঁর জীবন এবং অবদানের কথা উঠে আসতে থাকে নানা লেখার মাধ্যমে। তাও প্রথম দিকের লেখায় তাঁর জীবনের কথা সঠিক ভাবে তুলে ধরা হয়নি; কী বিরোধিতার মধ্যে তিনি নিজের স্বপ্নগুলোকে সফল করেছিলেন, সম্ভবত সচেতনভাবেই সেসব কথা বলা হয়নি। তাঁর নিজের লেখাপত্র ঘেঁটে ২০০২ সালে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে সেই সব অজানা সত্য ঘটনা। নাম ‘বিয়ন্ড দ্য লিমিট : দ্য ড্রিম অফ সোফিয়া কোভালেভস্কিয়া’। সোফিয়া কোভালেভস্কিয়ার ব্যক্তিগত জীবন যেন অজস্র বাধার খানাখন্দ পেরিয়ে সফলতার শীর্ষে পৌঁছানো এক অসামান্য উত্তরণের কাহিনি, সমাজের জগদ্দল শাসন সরিয়ে যিনি হয়ে উঠবেন গণিতে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্ত প্রথম নারী। অতি সম্প্রতি ‘বিয়ন্ড দ্য লিমিট’ বইটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে সুবিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে; আলোচনার শিরোনামটি বাংলা তর্জমা করলে এই রকম - ‘নুড়ি পাথর গোনা থেকে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স : ক্যালকুলাসের কাহিনি’। শুধু উপন্যাস নয়, সোফিয়াকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তিনটি চলচ্চিত্র এবং ‘এ হিল অন দ্য ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন’ নামের একটি টিভি-বায়োগ্রাফি (১৯৮৩)।
রাশিয়ায় মস্কোর কাছে একটি জায়গায় সোফিয়া, তাঁর দিদি এবং ছোটো ভাইয়ের বেড়ে ওঠা। শুরুতে বাবার ঠিক করে দেওয়া গৃহশিক্ষক এবং গভর্নেসের কাছে কাছে পড়াশোনা শেখা। বাবা ছিলেন সামরিক অফিসার আর মা মিউজিক চর্চা করতেন। তাহলে অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা এল কী করে? সম্ভবত তাঁর অ্যাস্ট্রোনমার দাদু’র কাজের সূত্রেই গড়ে উঠেছিল সোফিয়ার গণিতের প্রতি আগ্রহ। যে বয়সে বাচ্চারা দেয়ালে ফুল,পাখি নদীর ছবি এঁকে টাঙিয়ে রাখে, সেই বয়সে সোফিয়া নিজের ঘরের দেওয়াল জুড়ে নানান গাণিতিক বিশ্লেষণ আর ফর্মুলা টাঙিয়ে রাখত। এদিকে সেই সময়ে রাশিয়ায় মেয়েদের উচ্চশিক্ষার দরজা খোলা ছিল না! বাবা ভালো করেই জানতেন সোফিয়া গণিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন না। তাই গণিত শেখায় বাবারও ঘোর আপত্তি। তবে উপায়?
সোফিয়ার জীবন কাহিনি পড়লে মনে হবে এ যেন কোনও টানটান চিত্রনাট্য, যেখানে আছে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, প্রেম, প্রেমহীনতা আর অদ্ভুত ট্যুইস্টের ঝলক। সেসময় রাশিয়াতে ঘরের বাইরে বা অন্য জায়গায় মেয়েদের একা থাকার জন্য বাবা অথবা স্বামীর লিখিত অনুমতি প্রয়োজন হত। বাবার অনুমতি যে পাওয়া সম্ভব নয়, তা ভালোই জানতেন সোফিয়া। তাই ঠিক করলেন এমন একজন পুরুষকে বেছে নিতে হবে, যার সঙ্গে শর্ত সাপেক্ষে বিয়ে হবে। কেবল মাত্র বিদেশ যাওয়ার জন্যই হবে এই বিয়ে! আবার এটাও দেখতে হবে যেন সেই তথাকথিত স্বামী সোফিয়ার পড়াশোনাতে কোনোরকম আপত্তি না করেন। এর আগে দিদিও এই পথ অনুসরণ করেই বিদেশে ডাক্তারি পড়তে গেছে। যাই হোক, সদ্য আঠারো সোফিয়ার কাগুজে বর ভ্লাদিমিরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সোফিয়া গেলেন জার্মানির হাইডেলবার্গ। সেখানে গিয়ে খ্যাতনামা গণিতবিদের অধীনে ক্লাস করার অনুমতি যদি বা মিলল, তবু নিয়মমাফিক ভর্তি হতে পারলেন না। সে সময় ইউরোপের গণিত গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বার্লিন। হাইডেলবার্গের শিক্ষা সম্পূর্ণ করে সোফিয়া বার্লিন এসে বিশ্বখ্যাত গণিতবিদের কাছে গবেষণার সুযোগ পেলেন। তবে সেখানেও সরাসরি ভর্তি হতে পারলেন না, পড়তে হল প্রাইভেটে।
আরও পড়ুন
হিরের দুল ছেড়ে চেয়েছিলেন বই - শতবর্ষে বিস্মৃত বিজ্ঞানী আন্না মনি
তখন সোফিয়ার চব্বিশ বছর বয়স। এইসময় তিনটি খুব উচ্চমানের গবেষণার কাজ প্রকাশিত হল জার্নালে। গবেষণাপত্রের বিষয়গুলি ছিল পার্শিয়াল ডিফারেনশিয়াল ইকোয়েশন্স অন দ্য ডায়ানেমিক্স অফ স্যাটার্ন রিংস অ্যান্ড অন ইলিপ্টিক ইন্টিগ্রাল্স। অবশেষে এই কাজের ভিত্তিতে গটিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন সোফিয়া। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন গণিতে। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি ইউরোপে ফুল প্রফেসরশিপ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রথম মহিলা হিসেবে তিনিই কোনও বৈজ্ঞানিক জার্নালের সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন। মহিলাদের মধ্যে গণিতে তাঁকে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। সোফিয়া বিশ্বাস করতেন “It is impossible to be a mathematician without being a poet in soul.” গণিতের মধ্যে যে খুঁজে পায় সৌন্দর্য, সে তো কবি-ই। অবশ্য নানা বিভাগেই তাঁর বিচরণ ছিল স্বচ্ছন্দ। সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টি করে সমাদৃত হয়েছেন তিনি। উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ছাড়াও লিখেছেন আত্মজীবনী। তাঁর লেখা বইয়ের নতুন সংস্করণ এখনও প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা ‘নিহিলিস্ট গার্ল’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯২ সালে সুইডেনে। যা আজও জনপ্রিয়, বিশেষত তরুণ তরুণীদের মধ্যে। ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, সুইডেন, পোলিশ, ইউক্রেনিয়ান এবং চেক ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই বই। এছাড়াও ১৮৯০ এ প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘রিকালেকশনস অফ চাইল্ডহুড’। তাতে তাঁর জীবনের ছবি এবং পরিবেশ, তাঁর ইচ্ছা, স্বপ্ন ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতা অধিকার আন্দোলনের একজন নেত্রীও ছিলেন সোফিয়া।
ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেও রাশিয়া অথবা ইউরোপের কোনও কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে উপযুক্ত পদ পেলেন না তিনি। এক মহিলা শেষে ঘরভর্তি পুরুষ প্রোফেসরদের সঙ্গে একই উচ্চতায় আসীন হবে? ওটি হচ্ছে না! বরং দীর্ঘদিন ধরে যখন তিনি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষারত, তখন তাঁকে প্রাথমিক শ্রেণীতে পাটিগণিত শেখানোর প্রস্তাব দেওয়া হল! হতাশ ও বিরক্ত সোফিয়া সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন - ‘I was unfortunately weak in the multiplication table’। যাঁর ডক্টরেট থিসিসের কাজের ওপর পরবর্তীকালে মান্যতা পাবে ‘Cauchy-Kovalevskaya Theorem’, সেই কৃতবিদ্য গণিতবিদ শিক্ষাজগতে কোনও চাকরি পেলেন না। ফিরে এলেন রাশিয়ায়। আরও পরে অস্থায়ী একটি টিচিং পোস্ট পেলেন স্টকহোমে। জীবনে অনেক যন্ত্রণা লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, সেসব সামলেই হাসিমুখে লড়াই চালিয়ে গেছেন। কাগুজে বিয়ের দশ বছর পরে সে বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, এসেছে কন্যাসন্তান। একটা সময় কপর্দকশূন্য হয়েছেন দু’জনেই। মেয়ের তিন বছর বয়সে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, তারপর স্বামীর আত্মহনন। একা মেয়েকে বড়ো করতে হয়েছে, পরের পর সংকট নেমে এসেছে জীবনে। এসবের মধ্যেই দূরে সরে গিয়েও আবার ফিরে এসেছেন প্রিয়তম আশ্রয় গণিতের কাছে। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে এই উজ্জ্বল প্রতিভাময়ীর জীবনের আলো নিভে যায়। সুইডেনের স্টকহোমে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
তাঁর মৃত্যুর ষাট বছর পরে সোভিয়েত রাশিয়া তাঁর সম্মানে নামাঙ্কিত পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে। চাঁদের একটি গহ্বর এবং একটি অ্যাস্টেরয়েড তাঁর সম্মানে নামাঙ্কিত হয়েছে। তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ চালু হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলেও এটাই সত্যি যে, প্রতিভার সমাদর করতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়! কেন জীবিত অবস্থায় প্রতিভার সমাদর না হয়ে, মূল্যায়ন হবে মৃত্যুর পরে একজন মনীষার? বিশেষ করে তিনি যদি নারী হন? মাস খানেক আগে ১৫ই জানুয়ারি নীরবে পেরিয়ে এলাম সোফিয়া কোভালেভস্কিয়ার ১৭১তম জন্মদিন। স্মরণ করা তো অনেক দূরের কথা, গণিতশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করা বহু মানুষজন তাঁর নাম শোনেননি আজও। গণিতবিশ্বের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র জীবন আমাদের মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে শেখাক, বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করুক। সেখানেই এই আলোচনার সার্থকতা।
তাপস সরকার
অপূর্ব অজানা তথ্য। শুধু জানা নয় ।নতুন করে আবার ভাবতে শেখায়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব কে মনে করিয়ে দেয়।
ডঃ অঞ্জনা ঘোষ
সিলি পয়েন্ট'এর বিজ্ঞান দপ্তরে "বিজ্ঞান BY নারী" সিরিজে আরো একটি অমূল্য সংযোজন। যে গভীর নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে লেখক ইতিহাসের গভীর অন্ধকারে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা একের পর এক নারী প্রতিভা... বিজ্ঞান জগতের বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁদের অসামান্য অবদানের কাহিনী উপহার দিয়ে চলেছেন ... তার জন্য লেখককে জানাই অজস্র ধন্যবাদ। এ যেন গভীর সমুদ্রের তলদেশ ছেঁচে তুলে আনা বিশিষ্ট মুক্তের সম্ভার। চলতে থাকুক লেখকের এই অমূল্য অনুসন্ধান পর্ব আর মসৃণ কলম। আর তৃপ্ত ও সমৃদ্ধ হয়ে চলি আমরা মুগ্ধ পাঠকের দল।