সৃষ্টির আদি অণুর ধারণা দিয়ে নোবেল পেয়েছিলেন সিডনি অল্টম্যান

সুখী শৈশব বলতে ঠিক কী বোঝায় ছেলেটি তা কোনোদিনই বোঝেনি। ইহুদি অভিবাসী বাপ-মা কানাডার মন্ট্রিল শহরে কোনোমতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থাটুকু করতে পেরেছিলেন। দুই ছেলের মুখে অন্ন তুলে দিতে বাবা একই সঙ্গে জমিতে চাষ করতেন আবার দোকানও চালাতেন। মা যদিও বা শুরুর দিকে কাপড়ের কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন, ছোট ছেলের জন্মের পর পরিবারের দেখভালের জন্য সেটাও ছাড়তে হল। সেদিন যদি ছোট্ট সিডনিকে কেউ বলত, “বড় হয়ে তুমি নোবেল প্রাইজ জিতবে”, নিশ্চিতভাবেই তাকে সবাই পাগল ঠাউরাতো।
সিডনি অল্টম্যানের শৈশব-কৈশোর জুড়ে আর্থিক অস্বচ্ছলতা থাকলেও তাঁর লেখাপড়া কখনও তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বিশেষত তাঁর বই পড়ার নেশা, যার ফলে মাত্র ছয় বছর বয়সেই সিডনি জেনে গেছিল পর্যায় সারণীর কথা, অ্যাটম বোমা তৈরির গল্প, সেই নেশাও তাঁকে ইন্ধন জুগিয়েছিল পরবর্তীকালে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য এগোতে। বাবার সেই ছোট্ট দোকানের ব্যবসা মোটামুটি ভালোভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় এসব ব্যাপারে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। প্রথমে ভেবেছিলেন কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন, পরে এক বন্ধু তাঁকে রাজি করায় এমআইটি-তে দরখাস্ত করার জন্যে। সিডনি এমআইটি-তে পড়ার সুযোগ পেলেও সেই বন্ধুটি পায়নি!
ফিজিক্স নিয়ে পড়ার পরে দুবছর কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করলেন। অবশেষে বায়োফিজিক্সে পিএইচডি করলেন তিনি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছর গবেষণা করে কেমব্রিজের এমআরসি ল্যাবরেটরি অফ মলিক্যুলার বায়োলজিতে ক্রিক এবং ব্রেনারের সঙ্গে গবেষণার জন্যে ইংল্যান্ডে গেলেন। পরে থিতু হলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণার জগতে ঢুকে সিডনি বুঝতে পারলেন এর যাত্রাপথ মসৃণ নয়। সাফল্যকে ছুঁতে হলে নিরন্তর সাধনায় ডুবে থাকতে হবে। পরবর্তী সময়ে যেদিন তিনি সফলতার মুখ দেখলেন, প্রথমেই বাবা মায়ের কথা মনে পড়েছিল। বাবা মায়ের কাছেই তো ছোট্ট সিডনি শিখেছিল যে কঠিন পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।
মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট সিডনি অল্টম্যান বাকিদের থেকে কোথায় আলাদা, তা বুঝতে হলে জানতে হবে তাঁর আবিষ্কারের কথা। বিশেষ ধরনের আরএনএ-র মধ্যে যে উৎসেচকের মতোই অনুঘটক হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা থাকে - এই চমকপ্রদ বিষয়টি সিডনি অল্টম্যানের গবেষণা থেকে প্রথম উঠে আসে। ষাটের দশকের আগেই বিজ্ঞানীরা জেনে গিয়েছিলেন যে, লম্বা প্যাঁচানো শৃঙ্খলের মতো DNA আর RNA অণুর কথা। এছাড়াও, ততদিনে জানা ছিল উৎসেচক বা ‘এনজাইম’ হল এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন নির্মিত পদার্থ, যা শরীরের কোশের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সংঘটিত করতে পারে। উৎসেচক ছাড়া শরীরের কোশগুলির কোনো বিক্রিয়াই সম্ভব নয়। এই ধারণা আমূল বদলে গেল সত্তরের দশকে এসে। জানা গেল শুধু উৎসেচক নয়, এক বিশেষ ধরনের RNA (রাইবো-নিউক্লিক অ্যাসিড) আছে, যাদের মধ্যেও রয়েছে ‘ক্যাটালাইটিক ক্ষমতা’। এই চমকপ্রদ আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের এতদিনের ধারণার ভিতটি ঝাঁকিয়ে দিল।
সত্তর দশকের শুরুর দিকে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন সিডনি অল্টম্যান। প্রায় দু-দশক গবেষণা চালানোর পরে অল্টম্যান আবিষ্কার করেন RNA-র ক্যাটালাইটিক ধর্ম থাকার কথা। শরীরের মধ্যে একাধিক প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত করে থাকে এই বিশেষ জাতের আরএনএ। আর এইরকম ক্যাটালাইটিক ক্ষমতা সম্পন্ন আরএনএ-কে বলে ‘রাইবোজাইম’ (রাইবো+এনজাইম)। পৃথিবীতে কোন জৈব অণু প্রথম এসেছিল? এই নিয়ে দীর্ঘ সময়ের বিতর্ক বিজ্ঞানী মহলে। এক গোষ্ঠীর বিজ্ঞানীরা বলেন - প্রথম এসেছিল প্রোটিন। অন্য বিজ্ঞানী গোষ্ঠী বলেন, না প্রোটিন নয়, ডিএনএ-ই হল আদি প্রাণ অণু। কারণ ডিএনএ-র মধ্যেই তো রয়েছে প্রোটিন তৈরি হওয়ার সংকেত। আর এই বৃত্তের বাইরে ‘ক্যাটালাইটিক-আরএনএ’ র আবিষ্কার নিয়ে এল নতুন এক মতবাদের। কী সেটা? ‘পৃথিবীর আদি অণু হল – আরএনএ’।
দীর্ঘ দিনের একটা গড়ে ওঠার ধারণা ভেঙ্গে গেলে যা হয় তাই হল প্রথমে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মেনে নিতে পারলেন না। অল্টম্যানের গবেষণার ফলাফলকে বিজ্ঞানীদের অনেকেই উড়িয়ে দিতে চাইলেন। অল্টম্যান পরে বলেছেন এক জায়গায় “I tried to get people to take notice, but no one would listen”। যাই হোক, বেশ কয়েক বছর পরে যখন অন্য একটি ল্যাবরেটোরি থেকে স্বাধীন ভাবে গবেষণা করে বিষয়টি আবার উঠে এল, তখন বিজ্ঞানীরা সবাই নড়েচড়ে বসলেন। যে বিজ্ঞানীর হাত ধরে এই সিডনির বক্তব্য মান্যতা পেল, তিনি হলেন আমেরিকার কলরেডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত রসায়নবিদ অধ্যাপক টমাস চেক।
টমাসের গবেষণার ক্ষেত্রটি ঠিক কী ছিল তা এখানে সংক্ষেপে একটু বলার চেষ্টা করি। আমরা জানি যে কোশের মধ্যে আলাদা আলাদা নানান প্রকোষ্ঠ থাকে। বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের আছে বিভিন্ন ধরনের কাজ, আর সব কিছুর মধ্যে রয়েছে নিখুঁত একটি সমন্বয় ব্যবস্থা। এভাবেই চলে কোশের কার্যকলাপ। প্রকোষ্ঠগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকোষ্ঠ হল ‘রাইবোজোম’। বলা চলে, এটি একটি ‘আণবিক মেশিন’। কোশের একটি অতীব জরুরি কাজ হল প্রোটিন সংশ্লেষ করা, আর এই কাজ সংঘটিত হয় রাইবোজোম-এর মধ্যে। এই রাইবোজোম আসলে অনেকগুলো প্রোটিন আর আরএনএ অণুর সমষ্টি, এর অন্তর্গত একটি বিশেষ এবং ছোট্ট অংশটিই হল রাইবোজাইম। যার মধ্যে রয়েছে এনজাইম-এর কার্যকরী ক্ষমতা (catalytic power)। রাইবোজাইমকে তাই ‘ক্যাটালাইটিক-আরএনএ’ বলে। প্রোটিন সংশ্লেষে অংশ নেওয়া ছাড়াও রাইবোজাইমের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। যার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল ‘আরএনএ-কে কাটাছেঁড়া করা (স্প্লাইসিং), ভাইরাসের রেপ্লিকেশনে সাহায্য করা, ‘ট্রান্সফার-আরএনএ তৈরি করা ইত্যাদি। টমাস প্রথম এই স্প্লাইসিং-এর সপক্ষে প্রমাণ দিলেন। রাইবোজাইমের মূল দুটি কাজের প্রথমটি হল – রাইবজোমের মধ্যে, প্রোটিন তৈরি করার সময়ে দুটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের মধ্যে সংযোগকারী বন্ধন (peptide bond) তৈরি করা, এবং দ্বিতীয়টি হল – RNA splicing, যে কাজটি কোশের কেন্দ্রে (nucleus) সংঘটিত হয়। অল্টম্যান এবং টমাসের আবিষ্কার থেকেই ‘RNA world’ মতবাদের প্রবর্তন হয়, অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির প্রথমে RNA-ই ছিল প্রথম অণু। বস্তুত, RNA-র এই ব্যতিক্রমী ক্ষমতার কথা বিজ্ঞানীদেরও সেসময় দারুণ অবাক করে তুলেছিল। বলতে গেলে, এই দিগদর্শী আবিষ্কারের পরে আধুনিক জীববিদ্যার সমস্ত পাঠ্যবইতে আবার নতুন করে সংশোধন করতে হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, ক্যাটালাইটিক আরএনএ-র এই যুগান্তকারী আবিষ্কার যেমন জীববিদ্যার কেন্দ্রবর্তী ধারণা বা ‘সেন্ট্রাল ডগমা’কে বদলে দিল, সেই সঙ্গে তা ‘জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং’ বিভাগের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে দিল অনেক দূর অবধি। এরই পাশাপাশি ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিরোধের নতুন দিশা দেখিয়েছে এই আবিষ্কার।
‘আরএনএ’ অণুর এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার কথা আণবিক জীববিদ্যার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্যে ১৯৮৯ সালে রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগে সিডনি অল্টম্যান পেয়েছেন নোবেল পুরষ্কার। নোবেল অ্যাকাডেমি এই অসাধারণ আবিষ্কারকে বিগত চল্লিশ বছরে জীববিদ্যায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিগত ৭ই মে ছিল তাঁর জন্মদিন (১৯৩৯-২০২২), আর তার মাত্র এক মাস আগে ৪ই এপ্রিল তিনি প্রয়াত হয়েছেন। জীববিজ্ঞানের ইতিহাস বই যতদিন অমলিন থাকবে, সিডনি অল্টম্যান সেখানে ততদিন ভাস্বর থাকবেন।
*******
Anjana Ghosh
জীববিদ্যা আর প্রাণ রসায়ন .. এই দু'য়ের এক অন্যতম মূল বিষয় ... জীবকোশের গঠণ ও কার্যকলাপ... জীবকোশে সংঘটিত নানান রাসায়নিক ক্রিয়া প্রক্রিয়া। আর এই প্রসঙ্গেই লেখক জানিয়েছেন...'RNA world' মতবাদ'এর প্রবর্তনের কথা, প্রাণ সৃষ্টির আদি অণু সম্পর্কে নতুন ধারনার কথা.... নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, মলিকিউলার বায়োলজিস্ট সিডনি অল্টম্যানের যুগান্তকারী আবিষ্কার ... RNAএর ক্যাটালাইটিক power, RNA splicing, রাইবোজোম আর রাইবোজাইম' এর functional activities ...ইত্যাদি জটিল বিষয়গুলো কি সহজ ভাষায় আর সরলীকৃত ব্যাখ্যায় বুঝিয়েছেন তাঁর এই প্রতিবেদনে। বাংলাভাষায় জটিল বিজ্ঞান চর্চার সপক্ষে এই লেখা' এক উজ্জ্বল সংযোজন ।
Siddhartha Majumdar
Dr.Samir Kumar Dutta খুব ভালো লাগল সমীর দা, তোমার মন্তব্য এবং value addition এর জন্যে। Thomas Cech এর কথা উল্লেখ করেছি আমার এই লেখায়। তবে ঠিকই বলেছ, যুগ্মভাবে যে উনিও নোবেল পেয়েছিলেন সেটা উল্লেখ করা হয়নি এখানে। যা দরকার ছিল। কোশ, কোষ দুটো বানান ই ঠিক। বাংলা আকাদেমি যেহেতু 'কোশ' বানানকে এগিয়ে রাখছে তাই এখন cell এর ক্ষেত্রে 'শ' ই ব্যবহার হচ্ছে বেশি। লেখাটি যত্ন করে পড়ে মতামত জানানোর জন্যে ধন্যবাদ জানাই। 🙏🏻❤️ সিদ্ধার্থ মজুমদার
Samir Kumar Dutta
I like to add two issues to make the write up more valuable/ respectful! First, Thomas Robert Cech, as an American chemist, shared the 1989 Nobel Prize in Chemistry with Sidney Altman, for their discovery of the catalytic properties of RNA. Cech discovered that RNA could itself cut strands of RNA, suggesting that life might have started as RNA. Although, it was a write up on Altman, it will be a major disregard to the Nobel Laurate cech. if we do not mention about Thomas Cech simultaneously with Altman. 2ndly, the spelling of cell in bengali, কোষ, has been written as কোশ। This may be checked and corrected as কোষ, what I feel.
Samir Kumar Dutta
I like to add two issues to make the write up more valuable/ respectful! First, Thomas Robert Cech, as an American chemist, shared the 1989 Nobel Prize in Chemistry with Sidney Altman, for their discovery of the catalytic properties of RNA. Cech discovered that RNA could itself cut strands of RNA, suggesting that life might have started as RNA. Although, it was a write up on Altman, it will be a major disregard to the Nobel Laurate cech. if we do not mention about Thomas Cech simultaneously with Altman. 2ndly, the spelling of cell in bengali, কোষ, has been written as কোশ। This may be checked and corrected as কোষ, what I feel.