সারল ‘রাজার অসুখ’, বিনিময়ে ভারতের দখল পেল বিদেশিরা

রাজার অসুখ সারিয়ে হাতের মুঠোয় এল গোটা ভারতবর্ষ। পলাশির যুদ্ধ নয়, মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নয়, মুঘল সম্রাটদের অপদার্থতা নয়, শেষে কিনা ছক কষল একটা ছোট্ট অসুখ!
কী অসুখ? একটা ফোঁড়া!
সম্রাট ঔরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর থেকেই দিল্লির অবস্থাটা বেশ অগোছালো। দিল্লির মসনদে বসেছেন তাঁর নাতির ছেলে ফারুখশিয়র। রূপবান তিনি, তবে স্বাস্থ্যবান নন কোনও দিনই। অসুখবিসুখ লেগে থাকে মাঝেমধ্যেই। সময়টা ১৭১৫ সাল নাগাদ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একদল প্রতিনিধি তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। ব্যবসা সংক্রান্ত কীসব কথাবার্তা রয়েছে তাঁদের। কিন্তু লালমুখোদের সঙ্গে বাদশার দেখাটাই হয়ে উঠছে না! ঊরুসন্ধি আর পায়ুদ্বারে একখানা ফোঁড়া গজিয়েছিল কীভাবে কে জানে, তার ব্যথায় সম্রাট দিনরাত ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়ছেন। আর বিষফোঁড়ার ওপর গোদের মতো, এই ফোঁড়ার দৌলতে সম্রাটের দ্বিতীয় বিয়েটা প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছে! মনমেজাজ তিরিক্ষি না হয়ে উপায় আছে!
ইংরেজ দলের নেতা ক্যাপ্টেন জন সারমন দেখলেন, এ তো মহা বিপদ! অনন্ত কাল দিল্লিতে বসে থাকা সম্ভব নাকি! সম্রাটকে এতশত উপহার দিয়ে, আমির ওমরাদের ভালমতো ঘুষ খাইয়েও, উদ্দেশ্যের ধারেকাছে পৌঁছনো যায়নি এখনও। এরপর কোম্পানির মাথারা যে তাঁকে ছেড়ে কথা বলবেন না, সে জানতে বাকি নেই ক্যাপ্টেন সারমনের। এমন সময় ছপ্পর ফুঁড়ে তাঁর কানে এসে পৌঁছল সম্রাটের অসুস্থতার সংবাদ। ইংরেজ দলের সঙ্গে তখন রয়েছেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হ্যামিলটন, যিনি শল্যচিকিৎসায় ভালোই হাত পাকিয়েছেন ইতিমধ্যে। ক্যাপ্টেন সারমন ঠিক করে ফেললেন, তাঁর নামটা কোনও ভাবে পৌঁছে দিতে হবে শাহি দরবারে। আর তারপর, বাদশার সাক্ষাৎ পাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা।
খবর গেল বটে। কিন্তু বিশেষ আশা পাওয়া গেল না। প্রাচীন ভারতবর্ষে সুশ্রুত শল্যচিকিৎসা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন বটে, কিন্তু পরবর্তী কালে কাটাকুটির বদলে জড়িবুটির চলটাই বেশি ছিল। ফলে, সম্রাটের গায়ে হাত ছোঁয়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে কেউই তেমন সাহস পেলেন না। যদি কিছু গোলমাল হয়ে যায়, তাঁদের মাথাগুলোও আর ধড়ের ওপর থাকবে না। আর ভিনদেশের, ভিনজাতের লোকগুলোকে বিশ্বাস কী! ভারতবর্ষ গুপ্তহত্যা দেখে দেখে অভ্যস্ত। এও যে তেমন কোনও চাল নয়, কে বলবে! তা ছাড়া, ইতিমধ্যেই দরবারের খাস হাকিমরা হাত তুলে নিয়েছেন। এখন ভারতসম্রাটের অসুখ যদি সারিয়ে দেয় কোনও ভিনদেশি, তাঁদের মুখে চুনকালি পড়বে না?
তবে ইংরেজদের ভাগ্য ভালো। সম্রাটের যা হাল, শেষমেশ আপত্তিগুলো আর ধোপে টিকল না। কেবল বাদশার খানসামাকে আগে হ্যামিলটনের ওষুধ খাইয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া হল বিষ মেশানো আছে কি না। পরীক্ষায় পাশ করে বাদশার দিকে হাত বাড়ালেন সাহেব ডাক্তার। ফারুখশিয়রের আসলে যা হয়েছিল, আজকের ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে বলা হয় ফিশচুলা। হ্যামিলটনের চিকিৎসায় ক্রমশ সেরে উঠলেন সম্রাট। দিল্লি জুড়ে শুরু হল উৎসব। একে তো সম্রাটের রোগমুক্তি, তার ওপর তাঁর থমকে থাকা বিয়েটাও হয়ে গেল যোধপুরের রাজকন্যা ইন্দিরা কানোয়ারের সঙ্গে।
হ্যামিলটন সত্যি সত্যিই সম্রাটের শরীরে অস্ত্রোপচার করেছিলেন কি না, তার স্পষ্ট কোনও নথি অবশ্য পাওয়া যায় না। তবে এ কথা জানা যায়, রোগ সারানোর পুরস্কার হিসেবে তাঁর অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামগুলি সোনায় বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাট! সম্রাটের রোগ সারিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন সাধারণ ডাক্তার উইলিয়াম হ্যামিলটন। কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চে তাঁর সমাধিফলকেও লেখা আছে সেকথা। তবে জোর বরাত কেবল ডাক্তারের নয়, বরাত খুলে গেল তাঁর সঙ্গের ইংরেজ দল তথা সমগ্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরই। তাদের ভাগ্যেও যে জুটেছিল মহামূল্য বকশিস! ফারুখশিয়রের দেওয়া ফরমানের দৌলতে বাংলা-বিহার-ওড়িশায় নিঃশুল্ক ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বছরে মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে।
ব্যস, ইংরেজদের আর পায় কে! প্রতিপক্ষ বণিকদের লাভের একটা বড় অংশ যখন চলে যাচ্ছে বাদশাকে ট্যাক্স দিতে, ইংরেজরা তখন লাভের কড়ি পুরোটাই ঘরে তুলছে। আস্তে আস্তে গোটা ভারত জুড়ে একচেটিয়া ব্যবসা জাঁকিয়ে বসল তারা। ফারুখশিয়রের ফরমান বিনাশুল্কে বাণিজ্য ছাড়াও আরও সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল তাদের। সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা নামের তিনটি গ্রামের পাশাপাশি আরও আটত্রিশটি গ্রাম কেনা, নিজেদের টাঁকশাল খোলা, ইচ্ছেমতো পণ্য আমদানি-রপ্তানির দস্তক দেওয়ার অনুমতি পেয়ে গিয়েছিল তারা। এমনকী, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গেরও সীমারেখা বাড়াতে আর সমস্যা ছিল না। তা নিয়েই পরবর্তী কালে তাদের বিবাদ বাধে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে।
পুঁজি যার হাতে, রাজনীতির চাল তো সে দেবেই। বণিকের মানদণ্ড কীভাবে বদলে গেল রাজদণ্ডে, সেকথা আমরা সবাই জানি। আর এই গোটা পালাবদলের গোড়ায় ছিল সম্রাট ফারুখশিয়রের সেই ফোঁড়া!
******
#মুঘল #ফারুখশিয়র #ভারত #ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি #ইংরেজ #কলকাতা #চিকিৎসা #উইলিয়াম হ্যামিলটন #ফিচার #তোড়ি সেন #সিলি পয়েন্ট #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #web portal