ফিচার

রবীন্দ্রনাথ ও যদুনাথ সরকারের মৈত্রী থেকে মনান্তর : কারণ বিশ্বভারতী

টিম সিলি পয়েন্ট Sep 19, 2021 at 5:14 am ফিচার

সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল ১৮৯৪ সালে ‘সুহৃদ’ পত্রিকায় একটি ইংরেজি নিবন্ধের মাধ্যমে। নিবন্ধের নাম ‘The New leaven in Bengal (An Appreciation of Baboo Rabindranath Tagore’s Short Stories)’। লেখক যদুনাথ সরকার। যদুনাথের বয়স তখন চব্বিশ। রবীন্দ্রনাথ চৌত্রিশ।

বিশ্বকবি আর ঔপনিবেশিক ভারতের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদের বয়সের তফাৎ ছিল দশ বছর। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘রবীন্দ্রনাথ’ হননি, তার অনেক আগে থেকেই যদুনাথ তাঁর বিশেষ গুণগ্রাহী। মুঘল সম্রাটদের নিয়ে যে অসামান্য গবেষণা যদুনাথকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেবে, তা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। এই সময় থেকেই তাঁর রবীন্দ্র-মুগ্ধতা শুরু। কবিতা নয়, তিনি বেশি আপ্লুত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়ে। নিবন্ধটিতে অকুণ্ঠ প্রশংসা করে লিখেছিলেন – “...Such a rendering of life. esp. with a degree of success unequalled by any other of our writers.” শুধু তাই নয়, ১৯১১ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে যদুনাথ বেশ কয়েকটি রবীন্দ্র-ছোটগল্প ও প্রবন্ধ ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, যেগুলি ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া এই সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে লিখিত বেশ কিছু বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনার উত্তর দিতে কলম ধরেছিলেন তিনি। ইতোমধ্যে তাঁদের পত্রালাপ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধগয়া যাত্রায় জগদীশচন্দ্র বসু, অবলা বসু, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখের সঙ্গে যদুনাথও সঙ্গী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অচলায়তন’ নাটকটি যদুনাথকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে কবিগুরু লিখেছিলেন, “আন্তরিক শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ এই অচলায়তন নাটকখানি শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার মহাশয়ের নামে উৎসর্গ করিলাম।” এখান থেকেই বোঝা যায় যে শ্রদ্ধা, গুণগ্রাহীতা দু তরফেই ছিল। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে যদুনাথ শান্তিনিকেতনে ‘শারদোৎসব’ নাটকের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন। 

কিন্তু এই সৌহার্দ্যে ভাঁটা পড়তে শুরু করে বিশ্বভারতীর শিক্ষাদর্শকে কেন্দ্র করে। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ যদুনাথকে গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। যদুনাথ তখন কটকের র‍্যাভেনশ কলেজের অধ্যাপক। ততদিনে তাঁর বিখ্যাত ‘History of Aorangzeb’ গ্রন্থের বেশ কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত। এছাড়াও ‘Shibaji and his Times’ বা ‘Later Mughals’-এর মতো কাজও প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তখন পণ্ডিত মহলে রীতিমতো সাড়া জাগানো নাম। অন্যদিকে নোবেল প্রাপ্তির সাত বছর পেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ তখন সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও চিন্তকদের সঙ্গে এক আসনে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬১, যদুনাথ ৫১। কবি ও ইতিহাসবিদের সুসম্পর্কের তাল কেটে দিল বিশ্বভারতী। রবীন্দ্রনাথের আবেদনে অসম্মতি জানিয়ে যদুনাথ যে চিঠিটি লিখলেন তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ২১ মে রবীন্দ্রনাথের পাঠানো চিঠির উত্তরে ৩১ মে যদুনাথ জানালেন, শান্তিনিকেতনের মতাদর্শ স্কুলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একেবারেই নয়। তিনি স্পষ্ট লিখলেন, “বোলপুরের ছাত্রগণ intellectual discipline-কে ঘৃণা করিতে এবং উহার শিক্ষক ও সেবকগণকে হৃদয়হীন, শুষ্কমস্তিষ্ক ‘বিশ্ব-মানবের শত্রু’, মেকি পণ্ডিত বলিয়া উপহাস করিতে শেখে।” যদুনাথের এই জবাব রবীন্দ্রনাথকে বেশ আহত করেছিল। কারণ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিকেই কার্যত সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন তিনি। দিনকয়েক পর রবীন্দ্রনাথ এই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর বেদনা গোপন করেননি – “আমাদের দেশে অল্প যে-কয়েকজন সাধকের প্রতি আমার গভীরতর শ্রদ্ধা আছে, আপনি তাঁহাদের মধ্যে একজন। এই কারণে আমার কর্ম্মের প্রতি আপনার এমন অবজ্ঞা মিশ্রিত অশ্রদ্ধার তীব্রতায় আমি নিরতিশয় ব্যথিত হইয়াছি। আমাদের এখানে ত্রুটির অভাব নাই, ত্রুটি অন্যত্রও আছে, কিন্তু যথাবিহিত রূপে আপনি কি তাদের সন্ধান ও যথোচিতভাবে তাহা নির্দেশ করিয়াছেন? বিশ্বভারতীর সংকল্প লইয়া ভারতবর্ষে যখন ফিরিলাম তখন সহায়তার জন্য সর্বপ্রথমে আপনাকেই সন্ধান করিয়াছিলাম। কিন্তু যখন বিশ্বভারতীর সহিত আপনার নাম সংযুক্ত রাখিতে চান না তখন তাহা প্রত্যাখ্যান করিব; তৎসত্ত্বেও ভাবুক বলিয়া আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান  করিলেও সত্যসাধক বলিয়া শেষ পর্যন্ত আপনার প্রতীক্ষা করিব।”

আঘাত এতটাই গভীর ছিল যে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লেখা একটি চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথ সে কথা ব্যক্ত করেছিলেন – “যদুবাবুর মধ্যে খুব একটা সত্য আছে - তিনি আমাকে অনাদর করলেও আমি তাঁকে করতে পারিনে সেইজন্যই তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে আমি এমন ব্যথা বোধ করছি। যাই হোক, ওঁর নামটা কেটে দিতে হবে।” অবশ্য এর আগেই বিশ্বভারতীর সংবিধান ছাপানোর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং অন্যান্যদের সঙ্গে যদুনাথের নাম মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল। সেটা জানার পর যদুনাথ ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৩ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে গভর্নিং বডির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। 

এরপর স্বাভাবিকভাবেই  দুজনের সম্পর্কের পুরনো অন্তরঙ্গতা আর ফিরে আসেনি, যদিও দৃশ্যত পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব ঘটেনি এরপরেও। ১৯২৭ সালে  কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের একটি সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন যদুনাথ। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আসলে দুজনের মনোভঙ্গির অনেকটাই ব্যবধান ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শের সঙ্গে যদুনাথের কঠোর নিয়মতান্ত্রিক বাস্তববাদী জীবনাদর্শের মৌলিক পার্থক্য ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুণগ্রাহীতা ছাপিয়ে সেগুলোও যে প্রকট হতে পারে, তা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি। তাই তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান তাঁর একদা ঘনিষ্ঠ, সে সময়ের শ্রেষ্ঠ এক ইতিহাসবিদের সঙ্গে তাঁর মানসিক ব্যবধানের কারণ হয়ে দাঁড়াল।   


****************************************

ঋণ: কবি এবং ঐতিহাসিক : না দেখাই ছিল ভালো, চিন্ময়ী মুখোপাধ্যায়, কোরক, প্রাক শারদ সংখ্যা ২০১৬ 

# ভারতের ইতিহাস # ইতিহাসবিদ # সাহিত্যিক # কবিতা # অচলায়তন # বিশ্বভারতী #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর # যদুনাথ সরকার # টিম সিলি পয়েন্ট # ফিচার # সিলি পয়েন্ট # বাংলা পোর্টাল # ওয়েবজিন #web portal

  • SUBIR KUMAR LAHIRI
    Oct 15, 2021 at 1:46 pm

    Felt very sad knowing ABOUT this story. I as an Indian, am so proud as I should be of both of them. But one thing today's Bengalee population especially the politicians should notice about the strength that the then Bengali intellectuals possesed BECAUSE OF THEIR TRUE EDUCATION AND KNOELEDGE , AND ABOVE ALL, FOR THEIR UNPARACITIC HONESTY THAT TWO STRONG PERSONALITIES DID NOT HESITATE TO DIFFER FROM THEIR CONSUDERED DTAND POINT. CAN YOU IMAGINE THAT IS HAPPENING IN TODAYS BENGAL WHERE CHAMCHAS OF THE LEADER ARE ALL SUFFERING FROM SPINAL PROBLEMS!

  • SUBIR KUMAR LAHIRI
    Oct 15, 2021 at 1:45 pm

    Felt very sad knowing ABOUT this story. I as an Indian, am so proud as I should be of both of them. But one thing today's Bengalee population especially the politicians should notice about the strength that the then Bengali intellectuals possesed BECAUSE OF THEIR TRUE EDUCATION AND KNOELEDGE , AND ABOVE ALL, FOR THEIR UNPARACITIC HONESTY THAT TWO STRONG PERSONALITIES DID NOT HESITATE TO DIFFER FROM THEIR CONSUDERED DTAND POINT. CAN YOU IMAGINE THAT IS HAPPENING IN TODAYS BENGAL WHERE CHAMCHAS OF THE LEADER ARE ALL SUFFERING FROM SPINAL PROBLEMS!

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

22

Unique Visitors

225518