কলকাতার পানশালা

কলকাতার পানশালা বললেই ভেসে আসে হলুদ নিয়ন। আলো আঁধারি। পুরোনো লাল ছেঁড়া ভেলভেট । কেবিনও। কলকাতার পানশালা বললে কিছুতেই ভেসে আসে না ট্রাফিক গ্যাস্ট্রোপাব, ফাইভ ম্যাড ম্যান, বিয়ার রিপাবলিক, বর্ফ সোডা পানি অথবা হপিপলা। এরা বড্ড কসমোপলিটন। এদের চরিত্র কলকাতা হোক বা মুম্বাই, খুব কিছু আলাদা নয়। তবে তিন শতকের শহরে এই দুহাজার কুড়িতেও এমন কিছু পানশালা রয়ে গেছে, যাদের গায়ে পুরোনো কলকাতার গন্ধ।
সাহেবজাদাদের হাত ধরেই কলকাতায় শুরু হয়েছিল পান-সংস্কৃতি। ধীরে ধীরে পানশালাগুলো হয়ে উঠেছিল একধরনের সিম্পোজিয়াম। বাংলা কবিতার আঁতুড়ঘর। 'কলকাতার দিনরাত্রি'-তে সন্দীপন, 'কলকাতা শাসনের জার্নাল'-এ শরৎকুমার এবং আরও নানা গল্পে স্মৃতিকথায় কৃত্তিবাসীরা তার বিবরণ দিয়েছেন। সেই স্মৃতির পানশালায় আলো নিভে গেছে কবে। খালাসিটোলায় আর কমলকুমাররা যান না। হ্যাম দিয়ে বাংলা খেতে খেতে খুলে বসেন না কোনো ফরাসি কবিতার বই। বারদুয়ারির দরজায় আর পা দেন না কুখ্যাত ভবাদা। যাঁকে আম বাঙালি ঋত্বিক ঘটক নামে চেনে। মদকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বিস্ফার অথবা নষ্টমানুষের নস্টালজিয়াকে আঁকড়েই একধরনের রোমান্টিক অ্যাগোনি বাঙালির আশ্রয়। তবু সব কি অতীত? আমাদের যে দিন গেছে সত্যিই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?
সেই বাকি ইতিহাস খুঁজতেই এক ন্যালা খ্যাপা কৈশোর নেমে পড়েছিল কলকাতায়। স্কুল তাকে বাঁধেনি। রেসনিক হ্যালিডে অথবা এইচ সি ভার্মা তার কানে দিয়েছিল, না সমৃদ্ধির নয়, বরং পাতাললোকের মন্ত্র। যে সারাজীবন ধরে পালিয়ে বেড়াবে, তার প্রথম পালানো শুরু সেই ইস্কুলবয়সে। সে বিশ্বাস করত বাঙালি হয়ে না জন্মালে সে নিশ্চয় ফরাসি হত। প্যারিসের কোনো দরিদ্র চিত্রী। তাই পালাতে পালাতে সে এঁকে যাচ্ছিল কলকাতার ছবি। লাইফ স্টাডি। সামনে ছিল শমন। জয়েন্ট, আইআইটি। অথচ তার মনে পরম মন্ত্র- Qui vivra verra। যা হবে দেখা যাবে। সময় কিছু না কিছু বলবে তার কানে। সময় কথা বলছিল। না হলে কেন সে কারবালা ট্যাংক রোডে বাংলার কোচিং ক্লাসে যাওয়ার পথে আবিষ্কার করবে নিউ ক্যালকাটা বার। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর অন্য পারে!
সেই বাদামি কৈশোর ঢুকে গেছিল কলকাতা বার আর তার লাগোয়া বাংলার ঠেকে। না। মদ খাওয়া তখন তার স্বপ্নের অতীত। ঢোকার পাসওয়ার্ড হয়ে দেখা দেয় যে বয়স তা তার তখনও হয়নি। বার তার কাছে নিষিদ্ধ দরজার হাতছানি। কলকাতার তলায় যে অন্য কলকাতা আছে তার সন্ধান প্রথম সে পেয়েছিল, না, টিনের তলোয়ারে নয়। ওই কলকাতা বারের সামনে। ইস্কুলবেলায়। শখের শিল্পীর শখ বলিহারি। স্কুলের আঁকা প্রতিযোগিতায় সে এঁকেছিল পানশালার জীবনদর্শন। লাইফ স্টাডি অফ এ বার। রাস্তায় বিক্রি হওয়া সস্তা চাট আর সস্তা মদের খদ্দের। আর কলকাতা বারের দরজা।
অনেক পরে তার গবেষক জীবন যখন দিনের অনেকটা সময় কাটাতে শুরু করবে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ, তখন কিন্তু আর রাস্তা পেরিয়ে সে কলকাতা বারে যাবে না। তবে প্রতি সন্ধেয় বাড়ি ফেরার আগে সে মনের পানপাত্র উঁচিয়ে ধরবে নিজের ফেলে আসা বয়সের দিকে। উল্লাস বলে নেমে আসবে আলোর কলকাতায়।
তা বলে সে কি যায়নি অন্য কোনও পানশালায়! গায়ে মেখে নেয়নি ক্লেদ ও কুসুম! মেখেছে নিশ্চয়ই। প্রত্যেক মানুষের একটা ভাঙার সময় থাকে। মেঘ ভাঙার মতো। পাহাড়ের মতো শক্ত বুকে নেমে আসে দুঃখের জোয়ার। মানুষ ভেসে যায়। নিজের ভেসে যাওয়ার দিনগুলোতে, অথবা বলা ভালো সন্ধেগুলোতে সে নিজেকে সাজিয়ে রাখত সেন্ট্রাল বারে। পুরোনো ছেঁড়া ভেলভেট মোড়া চেয়ার। আর এক পেগ রাম। সঙ্গে ঠাকুরপুজোর মতো ছোটো স্টিলের মরচে ধরা থালায় চাট মশলা দেওয়া আদা। আর ছোলা সেদ্ধ। এই বারে তার সহযাত্রীদের অনেকেই নিয়মিত খদ্দের। ভেঙে আসা অফিস-প্রৌঢ়। সেখানে সে নবীন কিশোর। ভুবনডাঙার দাবি নিয়ে এসেছে। এখানে বসেই সে লিখে ফেলেছিল এক নিজস্ব কলকাতা ক্রনিক্যাল। তার প্রথম বই। লেখার সময় অবশ্য জানত না বই হবে। ফেসবুকের ধারাবাহিক। একটা করে লেখা। পোস্ট। পরে বন্ধুরা মিলে সেটা বই করে দেয়। পুরোনো হলুদ আলো লাল টেবিল আর ক্ষয়ে আসা কেবিন। এসব কখন যেন নিজস্ব মৌতাতে ঘিরে ধরে তাকে। ফেলে আসা সময় নিয়ে মুচকি হাসে কলকাতা।
সেন্ট্রাল বারের আরেকটু দক্ষিণে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে আছে আরেক বিখ্যাত ঠেক। ব্রডওয়ে। উঁচু সিলিং, বড়ো বড়ো কাঠের জানলা, ঝোলানো ফ্যান, কাঠের টেবিল চেয়ার, লাল রঙের পুরোনো গদি, হলুদ টেবিলক্লথ… ব্রডওয়ের ভেতরে ঢুকলে একধাক্কায় চলে যাওয়া যায় বেশ কয়েকটা দশক পেছনে। আজ আসলে যে বৃদ্ধ পানশালাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের কাছে জমা আছে একটুকরো পুরোনো কলকাতা। সেই যে ছন্ন কৈশোর এক অবাক চোখে এঁকে নিয়েছিল পানশালার পৃথিবী, যৌবন তাকে দিয়েছে এক অন্য জাদুকাঠি। অদৃশ্য ডানা। কোনো উষ্ণ রোদেলা দুপুরে সে উড়ে আসে এই অলীক পানশালায়। ব্রডওয়ে বস্তুত এক আশ্চর্য সময়যান। এখানে মাছভাজা দিয়ে মদ খাওয়া যায়। পমফ্রেট, মৌরলা অথবা তোপসে। তার সঙ্গে অবশ্যই ড্রট বিয়ার। আর যেদিন কেউ কোনও আশ্চর্য কপালগুণে পেয়ে যায় জানলার পাশের চেয়ার, সেই দিনটার জন্য সে রাজা। একলা দুপুর কপালে আঙুল বোলায়। বিয়ার খেতে খেতে ব্যাগ থেকে বের করে নিতে হয় মায়াকোভস্কি। কোনও দিন বা পাবলো নেরুদা। ব্রডওয়ের কাসুন্দি দেওয়া চিলি চিকেনের জাত আলাদা। Inutile de discuter। যে খেয়েছে সে জানে।
ই মলের উল্টো দিকে আরেক প্রাচীন এবং বিখ্যাত ঠেক হল চাংওয়া। চন্দ্রবিন্দু তাদের গানে হেদুয়া, আমিনিয়া, চাংওয়াকে এক সারিতে বসিয়ে দিয়ে খুব একটা ঠিক কাজ করেনি। একতলা দোতলা জুড়ে ছোটো ছোটো অনেক কেবিন। পর্দা দিয়ে ঘেরা একচিলতে ব্যক্তিগত। হঠাৎ করে দেখা যাবে কোনও কেবিনের নাম হঠাৎ নীরার জন্য। কোনোটার নাম স্মৃতিটুকু থাক। অবশ্য খোলা জায়গাও আছে বসার। এখানকার রোস্টেড চিলি পর্ক আর চাংওয়া স্পেশাল চাউমিন স্বর্গের অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে চলে যায়। তার সঙ্গে তো রয়েছেই বিষণ্ণ পানপাত্র। গলন্ত সূর্যকে ধরে রাখা হাতের মুঠোয়। চাইনিজ খাওয়ার পুরোনো দোকান হিসেবে চাংওয়া যতটা বিখ্যাত, পানশালা হিসেবে ততটা নয়। চাংওয়া ততটা পানশালা নয়ও। মদ থাকলেই কি আর পানশালা হয়!
তবে জাতে আর ধাতে এক আদ্যন্ত পানশালায় যাওয়া যাক এবার। এসপ্ল্যানেডে মেট্রো গলি দিয়ে ঢুকে সাউ ব্রাদার্স জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে যে কেউ। তবে এর একটা পান্টার প্রদত্ত নাম আছে। ছোটা ব্রিস্টল। এই পানশালার জন্ম ১৮৭২ সালে। সন্দীপন থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের মুখে-মদ হয় এইখানে। এ এক আশ্চর্য জায়গা। প্রায় শ দেড়-দুই মানুষ একসঙ্গে মদ খাচ্ছে। প্রায় চায়ের দোকানের মতোই আড্ডা গল্প গুজব। হাইকোর্টের উকিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, দালাল, ট্যাক্সি ড্রাইভার একইসঙ্গে একই টেবিলে বসে। কেউ কাউকে চেনে না। তবু গল্পের বিরাম নেই। এ বিশুদ্ধ পানশালা। একটা ছোটো বাটি ছোলা ছাড়া অন্য কোনো খাবার এখানে মেলে না। তবে মদের সঙ্গ আসঙ্গের কী হবে! সেসব নিয়ে আসে পরিযায়ী হকার। রাস্তা থেকে। আশি টাকায় আট পিস অসাধারণ চিলি চিকেন। ফিশ ফিঙ্গারের দামও ওইরকমই। কারও কাছে মিলবে পাঁচ টাকার বাদাম চানাচুর,কারও কাছে পেয়ারা শসা কুচি। চাইলে তারাই পকেট থেকে বের করে দেবে আস্ত কাঁচা লংকা। তাদের ছাড়া ছোটা ব্রিস্টল হয় না। কিন্তু তারা ছোটা ব্রিস্টলের কেউ নয়। ঢুকে ডানদিকে অ্যাকোয়ারিয়াম। বাঁদিকে টানা বেঞ্চ। ছয়টা থেকে মিনিট পনেরো পুজো। ধুনোর ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে মাতাল তরণী। সাউ ব্রাদার্স নাকি জন্মের পর থেকে একদমই বদলায়নি। বছর পঞ্চাশ পঞ্চান্ন আগে শুধু লাগানো হয়েছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রক। তবে তার প্রভাব খুব বোঝা যায় না এখানে। প্রবেশদ্বারের দুপাশে দুটো সিগারেটের পসরা। কলকাতায় পাওয়া যায় এমন কোনও সিগারেট বাকি নেই এখানে। দেশি বিদেশি। তবে সাউ ব্রাদার্সে ঢুকলে ধূমপান নিষেধ। তার জন্য যেতে হবে বাথরুমে। এখানে মদ খেতে হয় জলের কাচগ্লাসে। আর মদের দাম? লকডাউনের আগে ষাট এম এল লার্জ পেগ অ্যান্টিকুইটি ব্লু ছিল ১২০ টাকা। সিগনেচার প্রিমিয়াম ১১০। স্মারনফ ভদকাও ১১০। বাকি আর বলা বাহুল্য। এই দামে কলকাতা শহরেও খুব কম জায়গায় মদ মিলবে।
সাউ ব্রাদার্স থেকে বেরিয়ে হাঁটা পথে তিন মিনিট ১৮৭১ সালের সাকী বার। সে অবশ্য সাউয়ের মতো বহুজনহিতায় নয়। নামে হলেও দামে নয়।
অলিম্পিয়া বারের কথা না বললে কলকাতার পানশালার কথা শেষ হয় না। স্বাধীনতার সময় প্রতিষ্ঠিত এই বারের নাম পরে হয়ে যায় অলি পাব। এখানকার বিফ স্টেকের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দূরদূরান্তে। এ ছাড়াও আছে রক্সি। শিয়ালদার টাওয়ার। এবং আরও অনেক। আসলে গোটা কলকাতাটাই এক বিস্তীর্ণ পানশালা। ইতিহাস মদের গন্ধের মতোই জমাট বেঁধে আছে এর আনাচেকানাচে। নিভু আলোয় ঝিমিয়ে পড়া বিষণ্ণ পানশালাদের কথাটি ফুরিয়েও ফুরায় না। নিশ্চয়ই আরও আছে এইরকম পানশালা। যেখানে সময় নিজে আসে একপাত্র খেতে। হয়তো তত বিখ্যাত নয় সে হৃদয়পুর। তাদের সন্ধান?
হেঁটে দেখতে শিখুন!
Nabajyoti
Bhalo. Tobe mach bhaja specially mourolla fry and chilli mutton ta Monte Carlo two chomotkar Kore.
Dwijit
অসাধারণ! চাংওয়া আর অলি পাবে গিয়েছি। বাকিগুলো বাকেট লিস্টে রইল।
Soumya
শুধু অলিপাব নিয়েই তো একটা রচনা নেমে যায়, এতকিছু তো জানাই ছিল না। তবে, সেক্টর ফাইভের Go Where জাতে কুলীন নয় বলে বাদ গেল দেখে দুঃখ পেলাম।