আমাদের মিছিল
মেয়েদের ‘রাগ’ চিরকাল পুরুষতন্ত্রকে উদ্বিগ্ন করেছে। তাদের নিশ্চিন্তির রাজত্বে থাবা বসাতে পারে ক্রোধী মেয়েরা। যাঁরা প্রশ্ন করে, প্রতিপক্ষে সাজিয়ে দেন যুক্তির পালটা ঘুঁটি, মেনে না নিয়ে তর্কে দেন ধার, অন্যায়ে শুধু কাঁদেন না, চিৎকারও করেন! এমন অনেক কিছু দেখতে চায় ও দেখিয়ে দেয়, যা দেখতে নেই বলে ‘ফতোয়া’ দিয়ে রেখেছিল আবহমান কালের নিয়ন্ত্রক শক্তি। সেই মেয়েদের নিয়ে চিরকাল অস্বস্তি পিতৃতান্ত্রিক এজেন্সির। এঁদেরকেই ডাইনি বলে পুড়িয়ে মেরেছিল মধ্যযুগের ইউরোপ। মেয়েদের সেই হত্যাযজ্ঞে হাত মিলিয়েছিল ধর্ম আর রাজনীতি। সেই আগুন শুধু পোড়াতে পেরেছিল মেয়েদের শরীর। পুড়ে যাওয়া ছাই থেকে জন্ম হয়েছিল নতুন স্পর্ধার। অঙ্গীকার ছিল সব শক্তির চোখে চোখ রেখে বলার—
Still I rise
ইতিহাসের বাঁক বদলায়, মেয়েদের জীবনকে ছুঁতে পারে না সেই পরিবর্তন। মেয়েদের জীবনের বৃত্ত নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতরেই থেকে যায়। বাইরে রাক্ষুসে রাবণের মতো চলমান থ্রেট। তবুও একদল সাহসী মেয়ে, মেয়েদের জীবনের নানা সমস্যার যে রোজনামচা, তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। সমান শিক্ষা ও কাজের অধিকার, ভোটাধিকার, প্রজনন ও নিজের শরীরের ওপর কর্তৃত্ব চেয়ে গর্জে উঠেছিল পশ্চিমের একদল রাগী মেয়ে। সেই রাগের তাপ ছড়িয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে। সেই ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। সেই ক্রোধী মেয়েদের রাগী স্বর, আধুনিক মেয়েদের জীবনে এক নতুন উৎস খুঁজে দিয়েছিল।
মেয়েদের রাগ পিতৃতন্ত্রকে ভয় দেখায়। প্রতিক্রিয়ায় রাগী মেয়েদের সব ক্রুদ্ধ উচ্চারণকে মুছে ফেলার এক চতুর রাজনীতি চালায় আবহমানকালের ক্ষমতাশীল পুরুষতন্ত্র। মেয়েদের ক্রমাগত ভীতু, সহনশীল, লাজ নম্র আর ক্রোধহীন হতে শেখায় পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে প্রতিষ্ঠান। সবাই। মেয়েদের রাগকে, উঁচু গলাকে, সোচ্চার ‘বলা’কে আঘাত করা হয় নিন্দে দিয়ে। বইতে পড়ি নারীর সমার্থক শব্দ ‘অবলা’। কারণ তাদের শাসন করা সহজ। ‘শিষ্ট’, ‘ভব্য’, ‘সুবোধ’ করে তোলার চক্রান্তে পিতৃতন্ত্র কেড়ে নেয় আমাদের ভাষা। পিতৃতন্ত্রের চোখে রাগী মেয়েরা তাই অসুন্দর। বিশ্রী। কাঙ্ক্ষিত নয়। আর সেই দৃষ্টির তলায় আমরা ক্রমাগত চাপা দিতে থাকি আমাদের জমে থাকা সব চিৎকার, ঘেন্না, অবিচার, অপমান, অসম্মান, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের অধ্যায়। নিঃশব্দে বয়ে যাই ভারবাহী এক অস্তিত্বকে।
এক মৃত ধর্ষিত ডাক্তার মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ আচমকা ভেঙে দেয় সেই ছদ্ম আয়না। সেই নিপীড়িত শরীর কি শুধু তার একার? আমাদের নয়? নিজেকে দেখি, মেয়েরা দেখি পরস্পরকে। ছদ্মবেশ সরে যায়। মরচে ধরা ক্রোধে তাত দিই। আগুন জ্বালি ঘুমন্ত প্রেতগুহায়। মন্ত্র শেখাই একে অপরকে—‘She is beautiful when she is angry’!
এতদিনের ঘিরে থাকা পর্দাগুলো সরে যাক। পাথরগুলো সরিয়ে দিই বুক থেকে। নিজেরাই। তারপর রাগী মেয়েদের এক চলমান মিছিল অন্ধকারের মুখোমুখি হয়ে বহু শতকের শেকল ভেঙে মুক্ত করুক নিজের প্রশমিত রাগকে, অপমানকে, অত্যাচারের অভিজ্ঞতাদের। সেই একের মধ্যে মিশে যাক বহু। ক্ষমতার কানে তালা লাগিয়ে বেজে উঠুক মেয়েদের রাগী শব্দরা।
‘ধর্ষিত যোনির চিৎকারে ফেটে পড়ুক ব্রহ্মাণ্ড’*
[*বন্ধু পুরুষোত্তম সিংহের লেখা এই লাইনটি পোস্টারের জন্য লেখা।]
..................
#স্পর্ধা #series #protest #silly পয়েন্ট