পুরোনো অভ্যেস
বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সাদা চুড়িদারটা খুঁজে নিল অহনা। পর্দার পাশ দিয়ে একবার মুখ বাড়িয়ে আকাশটা দেখে নিল... "ইশ! দুপুরের পর থেকেই আকাশ কেমন মেঘলা হয়ে আছে!" ঠিক এমনটাই হত তাদের প্রথম সাক্ষাতের দিনগুলোয়। দু'মাস তাদের দেখা নেই। শেষের দিকে দুজনের কথাও কমে এসেছিল।
অহনার ভীষণ ভয় করত। বুঝতে পারত, মানুষের দুর্দিন শেষে হয়তো তার নিজের মানুষটাও দূরের হয়ে যাবে। তাই লকডাউন শেষ হতে না হতেই আজ বিকেলে সে নিজেই দেখা করার আবদার করেছে। এসব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই সে সময়ের থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেল। পুরোনো অভ্যেসে আজও তার দেরি হয়ে গেল। কিছু অভ্যেস হয়তো এমনই হয়।
অকারণ, চিরন্তন। যেমন এই শহর। অকারণ এক অভ্যেসে নিত্যদিন বয়ে চলেছে...
কোনোরকমে চুলের জট ছাড়িয়ে নেয় অহনা। ড্রয়ার থেকে কাজল পেন্সিলটা বের করেই বুঝতে পারে তার হাত কাঁপছে। কিছুতেই আঁকতে পারছে না। বারবার আঁকাবাঁকা দাগ পড়ছে। চোখের নীচে আঁকতে গিয়ে পেন্সিলটা কিছুটা ভেঙেই ফেলল সে। ভয় হচ্ছে অহনার। হাত কাঁপছে। তার দু'মাসের পুরোনো অভ্যেস সে হারিয়ে ফেলেছে। তার মানুষটাও কি তাহলে... আর শহরটা?
মেঘ দেখে ভেবেছিল বিকেলে আর অটো নিয়ে বেরোবে না। গত দু'মাস ধরে কোনো ইনকাম নেই, ঘরের টাকা উড়িয়ে বাপ এর মধ্যেই দিনরাত মদ গিলে চলেছে, লোকের বাড়ি কাজে যায় না মা অনেকদিন। বিরক্তি লাগে পল্টুর। নিজের ওপর রাগ হয়, জীবনের ওপর রাগ হয়। ঘরে থাকলে বাপ-মাকে গালাগালি করে। জীবনের কথা ভাবলে ঘেন্না করে এখন। বাড়ির কথা ভাবলে ঘেন্না করে। তাই মেঘ দেখেও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। দু'মাস গাড়ি চলেনি, তাই কিছুদূর এসেই বুঝতে পারল ব্রেক ঠিকঠাক লাগছে না। রাগ হচ্ছে পল্টুর। হাত কাঁপছে। কপাল বেয়ে ঘাম নামছে। কোথাকার কোন বিদেশি অসুখ এসে তার পেটে লাথি মেরে গেল। মুঠো শক্ত হচ্ছে। ব্রেক লাগছে না। বৃষ্টিতে রাস্তা ঢেকে যাচ্ছে। আজ সে থামবে না... আজ সে কারো কথা শুনবে না। দু'মাস পর আজ সে শুধুই গাড়ি নিয়ে ছুটবে...
বছরের প্রথম থেকে নতুন দুটো বইয়ের ড্রাফট তৈরি করছে প্রত্যুষ। কারো কথা ভাবেনি সে। পরিবারকে সময় দেয়নি। প্রেমিকাকে দিনের পর দিন অবজ্ঞা করেছে। প্রত্যুষ বোঝে, যে মানুষ অন্যের গল্প চোখ বুজে পড়ে নেয়, যে দিনের পর দিন শব্দদের নিয়ে ছক সাজানোর চেষ্টা করে, ব্যক্তিগত জীবনে সে মানুষ আসলে স্বার্থপর। শহরের সমস্ত প্রান্তে এক মানুষের গোপন কথা অন্যের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সে এক অমানবিক আদিম পুরুষে পরিণত হয়েছে। আজ তার নিজের বলতে কেবল সে একা। এখন আর দুঃখ হয় না প্রত্যুষের। নিজেকে সে বই, অক্ষর, পাঠক এসবের থেকে আর আলাদা করতে পারে না। তাই লকডাউনের দু'মাস সে দিনরাত লিখেছে আর লেখা কেটেছে। শেষের দিকে নিজের মানুষগুলোর সাথে দৈনন্দিন কথা বলতেও ভুলে যেত। তার আগামী বইয়ের জন্যই তার এই অমানবিক স্বার্থপরতা, নিঃশব্দ ত্যাগ...
দু'মাস পর আজ বিকেলে কিছুটা প্রয়োজনেই বেরিয়েছে প্রত্যুষ। প্রকাশনা সংস্থা দেখে নিতে চায় তার নতুন বইয়ের ড্রাফ্ট প্রকাশযোগ্য কি না। তার আগে একটা মিটিং আছে। বিকেল থেকেই হঠাৎ শহর কালো করে বৃষ্টি হচ্ছে আজ। বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতেই বাটার চটি চুপচুপে ভিজে গেল। মোড়ের মাথায় এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা অটো পেল প্রত্যুষ। ভেজা সিটে বসে কোনোরকমে ফোনটা পকেট থেকে বের করেই নিজের অজান্তে কার যেন একটা নাম্বার খুঁজতে শুরু করল প্রত্যুষ। ড্রাইভারটা ব্রেক নিয়ে কী যেন বলে চলেছে, কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না প্রত্যুষের। প্রত্যুষ অন্য কিছু ভাবছে, টাচস্ক্রিনের ওপর আঙুল দিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে... কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। চিন্তায় হাত কাঁপছে প্রত্যুষের...
রাসবিহারী মোড়ে পৌঁছে ভাড়া নেওয়ার পর পল্টুর পুরো রাস্তার বুক ধড়ফড়ানি থামল। কই কিছুই তো হল না! বেশ তো আগের মতোই গাড়িটা চালিয়ে আনল এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে। ফালতু চাপ নিচ্ছিল! খুচরো ফেরত দিতে দিতেই পল্টু মুখ ঘুরিয়ে বলল, "পুরোনো অভ্যেস, বুঝলে দাদা! সবই পুরোনো অভ্যেস!"
ড্রাইভারের কথা শুনে আলতো হেসে প্রত্যুষ মুখ ফিরিয়ে দেখল বন্ধ একটা ফুলের দোকানের ছাউনিতে অহনা সেই আগের মতো দাঁড়িয়ে, সেই আগের মতোই ঠিক উল্টোদিকের রাস্তায় প্রত্যুষকে খুঁজছে। জুতো কাত করে ভেজা পায়ে ধীরে এগিয়ে গেল প্রত্যুষ...
বিকেল শেষে বৃষ্টি ধরে আসছে আস্তে আস্তে। সন্ধের মুখে শহরের সেই পুরোনো অভ্যেসে...
অলংকরণ : মৌসুমী দত্ত
#গল্প