নন্দনকাননের গপ্পো
_1366x1366.jpg)
ইডেন গার্ডেনস - ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিকেট মাঠ। বাংলার তথা সারা দেশের গর্ব। সৌন্দর্য এবং আভিজাত্যে এ মাঠের তুলনা টানা হয় ইংল্যান্ডের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সঙ্গে। তবে প্রথম থেকেই কিন্তু খেলার মাঠ ছিল না ইডেন, এর বিবর্তনের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিচিত্র ইতিহাস।
১৮৩৬ সালে ভারতবর্ষের নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন জর্জ ইডেন, সঙ্গে আসেন তাঁর দুই বোন এমিলি ও ফ্রান্সেস (ফ্যানি)। দুই বোনই নেটিভদের সাহায্যার্থে বেশ কিছু কাজ করেছিলেন বলে শোনা যায়, এবং এমিলি এদেশে থাকাকালীন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়েছেন একাধিক বইতে। জলপথে ভাইবোনের সঙ্গে তাঁর ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কাহিনি আপ দ্য কান্ট্রি তো রীতিমতো জনপ্রিয়। বড়লাট হিসেবে দেশীয় বাবু সমাজের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন জর্জ নিজেও। শোনা যায়, তিন ভাইবোন একবার চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে দেন রানী রাসমণি ও বাবু রাজচন্দ্র দাসের গুরুতর অসুস্থ ছোট মেয়েকে। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রাজচন্দ্র ময়দানের উত্তর দিকে খানিকটা জমি তাঁর মালিকানা থেকে উপহার দেন ইডেন পরিবারকে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ময়দান অঞ্চলে মানুষজনের বসবাস ছিল নামমাত্র, পাকাপাকি বাসিন্দা বলতে কয়েক ঘর তাঁতি। ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপিও জাহাজ এসে লাগত চাঁদপাল ঘাটে, গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া এসে খেলত রাজচন্দ্রের জমিতে। দুই বোনের উদ্যোগে ক্রমশ জমিতে লাগান হয় নানারকম ফুলগাছ, পাম গাছের সারি, ফোয়ারা, হেঁটে বেড়াবার জন্য তৈরি করা হয় লন। প্রথম দিকে ‘লেডি গার্ডেন’ নাম থাকলেও পরে পালটে নাম রাখা হয় ‘অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন’। ইডেন বোনেরা ছাড়াও সেখানে হাঁটতে যেতেন অন্যান্য সাহেব মেমসাহেবরা, মৃদুমন্দ হাওয়ার সাথে সাজানো গোছানো বাগান তাদের মনে করিয়ে দিত সাগরপারে বিলেতের কথা। লন্ডনের হাইড পার্কের মতই এখানেও অভিজাত ইংরেজ পরিবারের নারী পুরুষেরা ঘুরতে যেতেন একে অপরের ‘দৃষ্টি আকর্ষণ’ করবার উদ্দেশ্যে, বাগানের দেখা সাক্ষাত থেকেই জন্ম নিত একাধিক সম্পর্ক। সেই আমলে তাই এই বাগানের আরেক নাম ছিল ‘প্রমেনেড’, হেঁটে বেড়াবার সাথে সাথে শুনতে পাওয়া যেত ফোরট উইলিয়ামে থাকা মিলিটারি ব্যান্ডের বাজনা। এই ব্যান্ডের বাজনার কথা পাওয়া যাবে সত্যজিত রায়, লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথাতেও। ১৮৫৬ সালে ইডেন উদ্যানে বসে বিখ্যাত সেই প্যাগোডা, যা দেখতে পাওয়া যায় আজও। এটি আদতে ১৮৫২ সালে বার্মার প্রম অঞ্চলের গভর্নরের স্ত্রীর তৈরি, পরে ১৮৫৪ সালে লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে স্থাপত্যটিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। প্রমোদ ভ্রমণের এই উদ্যান কীভাবে হয়ে উঠল বিশ্ববিখ্যাত ক্রিকেট মাঠ?
ভারতবর্ষে ক্রিকেটের আগমন ইডেন উদ্যান সৃষ্টির অনেক আগেই, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্বে। ইংল্যান্ডের বাইরে প্রথম ক্রিকেট সংগঠন হিসেবে ১৭৯২ সালে স্থাপিত হয় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব, প্রথম ক্রিকেট ম্যাচটি খেলা হয় এর বার বছর পরে গভর্নমেন্ট হাউসের (বর্তমান রাজ ভবন) সামনে ১৮ এবং ১৯শে জানুয়ারি, খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন ইটন স্কুলের প্রাক্তনী, সরকারি আমলা ও কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীদের দল। ১৮২৫ সালে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব ময়দানে গভর্নমেন্ট হাউস এবং ফোর্ট উইলিয়ামের মাঝে একখণ্ড জমি পায় তাদের ব্যাক্তিগত ব্যবহারের জন্য, ১৮৪১ সালে তার চারধারে পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনি এইসব কার্যকলাপ মোটেই ভালো চোখে দেখেনি, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ময়দান নিয়ে ইংরেজ সেনাবাহিনি ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে রীতিমতো দড়ি টানাটানি চলছিল- সেনাবাহিনি চাইছিল ময়দানকে শুধুমাত্র ফোর্ট উইলিয়ামের আশেপাশে নজরদারির কাজে ব্যবহার করতে, অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকেরা চাইছিলেন অঞ্চলটিকে ক্রিকেট ফুটবল এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কাজে লাগাতে দেওয়া হোক। অবশেষে খেলাধুলোর জন্য সরকারি অনুমতি মেলে ১৮৬৪ সালে, ১৮৬৫ থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে ঢেলে সাজানো হয় ইডেন গার্ডেনকেও। শুরু হয় বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসের এক গৌরবজনক অধ্যায়।
ইডেনে বাঙালিদের ক্রিকেটের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম আসবে, তিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই সারদারঞ্জন রায়, যাকে বাংলার ক্রিকেটের জনক বা ভারতের ডব্লিউ জি গ্রেস বলা হয়ে থাকে। ঢাকায় পড়াশোনা করবার সময় সারদা ভাইদের সঙ্গে ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন, পরে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে অধ্যক্ষ থাকাকালীন তাঁর হাতেই জন্ম নেয় টাউন ক্লাব, কলকাতার নেটিভদের প্রথম ক্রিকেট সংগঠন। ১৮৯৫ সাল থেকে সারদারঞ্জনের উদ্যোগে টাউন ক্লাব ইডেনে বিভিন্ন ইউরোপিয়ান দলের সঙ্গে নিয়মিত ম্যাচ খেলতে থাকে। শোনা যায়, এই রকম একটি ম্যাচেই নাকি টাউন ক্লাবের হয়ে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে সাত উইকেট নিয়েছিলেন এক যুবক, যার নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত! যুবাবয়সে নরেন্দ্রনাথের খেলাধুলো ও শরীরচর্চা সম্বন্ধে আগ্রহের কথা সুবিদিত হলেও এই বিশেষ মুখরোচক গল্পটির কোন ঐতিহাসিক সত্যতা অবশ্য যাচাই করা যায়নি। লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’ নামক আত্মজীবনীতে সেই আমলে বাঙালি ও সাহেবদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার বিবরণ পাওয়া যায়।
ফুটবল যেভাবে ইটন ও হ্যারো স্কুলের আভিজাত্যের গণ্ডী ছাড়িয়ে ক্রমশ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের খেলা হয়ে উঠেছে, ক্রিকেট কিন্তু বহুদিন যাবত তা পারেনি। রাগবি স্কুল ও সাদা চামড়ার সিভিল সারভেনটদের একাধিপত্যের বাইরে এসেও তাই সে অনেকদিন পর্যন্ত রয়ে গেছে সারদারঞ্জন-প্রমদারঞ্জনের মত ভদ্রবিত্ত বাঙালি বা রণজিৎ সিংজি অথবা ইফতিখার আলি খান পতউদির মত স্থানীয় রাজা নবাবদের খেলা। ১৯৭১ সালে নির্মিত অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ধন্যি মেয়ে ছবিতে ফুটবলপ্রেমী উত্তম কুমার যখন তাঁর ভাই বগার বিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এসে লিলির ক্রিকেটপ্রেমী মাকে দেখতে পান, তখন এই শ্রেণিবিভাজন বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর মতি নন্দীর ননীদা নট আউট, বুড়ো ঘোড়া, অলৌকিক দিলু প্রভৃতি একের পর এক ক্রিকেট ভিত্তিক উপন্যাসে উঠে আসতে থাকে বাংলার ক্রিকেট এবং ইডেন গার্ডেনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর লড়াই। প্রচণ্ড দারিদ্র্যকে হারিয়ে উদীয়মান প্রতিভা তন্ময়ের ব্যাটিং বা প্রাক্তন আম্পায়ারের ছেলে সমরের চোখ ধাঁধানো ইনিংসের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে প্রবীণ জহরের স্থিতধী খেলা কে ভুলতে পারবে? তাঁর সৃষ্ট মহিলা ক্রিকেটার কলাবতী তো বাংলা কিশোর সাহিত্যের সর্বকালের সেরা চরিত্রগুলির একটি। তবে লক্ষণীয়, মহিলা এবং প্রথাগত ভাবে সুশ্রী না হলেও কলাবতী কিন্তু উঠে এসেছে বাংলার এক বনেদি জমিদার পরিবার থেকে।
ইডেন গার্ডেনে প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় ক্রিকেটের একেবারে প্রথম লগ্নেই, সেই ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বে চার দিনেই সেই খেলা জিতে নেয় ইংল্যান্ড। দেশ বিদেশের একের পর এক ক্রিকেটার যেমন খেলতে এসে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন ইডেনের পরিবেশ এবং দর্শকদের উৎসাহকে, তেমনি বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনারও সাক্ষী থেকেছে এই মাঠ। ১৯৬৬-৬৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ১৯৬৯-৭০ সালে অস্ট্রেলিয়া দলের সফরের সময় দর্শকদের অভব্য আচরণের জন্য খেলা বন্ধ রাখতে হয়। ১৯৯৯ সালে শোয়েব আখতারের বলে শচীন তেণ্ডুলকরের বিতর্কিত রান আউটকে কেন্দ্র করে এতটাই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে দর্শকদের মধ্যে যে শচীনকে নিজে এসে তাদের শান্ত করতে হয়। তবে ক্রিকেটে সবচেয়ে কুৎসিত পরিস্থিতি তৈরি হয় ১৯৯৬ সালের ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ম্যাচের সময়ে, হতাশ দর্শকদের গণ্ডগোলে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। বিনোদ কাম্বলির কাঁদতে কাঁদতে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাবার ছবি ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে গেছে। তবে ইডেনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় জড়িয়ে রয়েছে ক্রিকেট নয়, ফুটবলের সঙ্গে। হ্যাঁ, এককালে নিয়মিত ফুটবলও খেলা হত এই মাঠে। দিনটা ছিল ১৬ই অগস্ট, ১৯৮০- কলকাতা ফুটবল লিগের ডার্বি ম্যাচে মুখোমুখি হয় চিরপ্রতিদ্বন্দী মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানের নেতৃত্বে ছিলেন কম্পটন দত্ত এবং ইস্টবেঙ্গলের সত্যজিৎ মিত্র। রেফারির কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দুই ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে বিবাদ এমন পর্যায়ে গড়ায় যে পরিস্থিতি একেবারেই হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়, শেষ অবধি পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় অন্তত ষোল জনের। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এ এক অন্ধকার দিন।

আবার এই ষোল সংখ্যাটিই জড়িয়ে আছে ইডেনের এক গৌরবজনক অধ্যায়ের সাথে। দেশের মাটিতে ভারতের সবচেয়ে স্মরণীয় টেস্ট জয় এই মাঠেই, ২০১১ সালের ১৫ই মার্চ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ অস্ট্রেলিয়ার টানা ষোলোটি টেস্ট জয়ের অশ্বমেধের ঘোড়া থামিয়ে প্রথম ইনিংসে ফলো অন খাবার পরেও ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটে ভর দিয়ে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় ছিনিয়ে নেয় ঘরের ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় ক্রিকেট দল, হ্যাট্রিক করেন হরভজন সিংহ। বলা হয়, গড়াপেটা বিধ্বস্ত ভারতীয় ক্রিকেটের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু এই টেস্ট জয় থেকেই। পঙ্কজ রায়- প্রবীর সেনের ঐতিহ্য, শীতের দুপুরে অজয় বসু-পুষ্পেন সরকারের ধারাভাষ্য, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অধিনায়কত্ব পেরিয়ে মনোজ তিওয়ারি-ঋদ্ধিমান সাহা-অভিমন্যু ঈশ্বরনের মতো তরুণ প্রতিভার উত্থান, অধুনা আইপিএলে শাহরুখ খানের ফ্র্যাঞ্চাইজি দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের ঘরের মাঠ হওয়া অবধি বহু পালাবদলের সাক্ষী থেকেছে ইডেন। আজকের ছেলেমেয়েরা যাতে এই মাঠের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অতীতকে ঠিকঠাক জানতে পারে, সে দায়িত্ব বাংলার ক্রীড়া ও ইতিহাসপ্রেমীদের।

..................
[কভার ছবিতে বাঁদিকে উনিশ শতকের ইডেন, ডানদিকে ইডেনের বর্তমান প্রবেশপথ]
#Eden Gardens #cricket ground #ইডেন গার্ডেন #silly পয়েন্ট
Suraj Paul
দারুন লেগেছে, কথা গুলো জানায় ছিল না। এই টুকু কথা লেখার জন্য কত বই যে পড়তে হয়েছে, বলাবাহুল্য। প্রত্যেক বাঙালির এটা পড়া দরকার আর জানা দরকার ইডেনের ঐতিহ্য।