খেচর খোঁচড়
পাখিদের কোনও সীমানা হয় না; কাঁটাতার, দেশ এসব শুধুই মানুষের জন্য; পাখিদের তো খোলা আকাশ– ইত্যাদি বলে যারা কাব্যি করেন, তারা নির্ঘাত এদের খবর রাখেন না।
এরা মানুষকে বলে বলে বুরবক বানিয়েছে। বাঘা বাঘা ইন্টেলিজেন্স ধোঁকা খেয়েছে এই ‘অবোলা’-দের কাছে। এই গেল বছরই তো মে মাসে শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনী এক পায়রাকে ‘পাকিস্তানি চর’ সন্দেহে পাকড়াও করেছিল। দোষের মধ্যে সে বর্ডার পেরিয়ে ভারতের আকাশসীমায় উড়ছিল, আর তার পায়ে একটা ছোট্ট চিরকুটে বাঁধা ছিল দশ ডিজিটের একটা নম্বর। পরে অবশ্য জানা যায় পাখিটা ‘পাকিস্তানি’ হলেও ‘চর’ নয়। ওই নম্বরটা তার মালিক হাবিবুল্লার নম্বর। হাবিবুল্লা পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের একজন মৎস্যজীবী। ওই নম্বরটা তাঁরই মোবাইল নম্বর। পাখিটা যাতে হারিয়ে গেলেও কেউ ফিরিয়ে দিতে পারে, সেজন্যই পাখির পায়ে নিজের ফোন নম্বর লিখে বেঁধে রাখেন তিনি।
এমনিতেই গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাস বহু প্রাচীন। এই কাজে মানবেতর প্রাণীদের ব্যবহার করার ইতিহাস সে তুলনায় অনেক অর্বাচীন হলেও তারও বয়েস নেহাত কম হল না। এ ব্যাপারে সবচেয়ে পরিচিত আর জনপ্রিয় হল পায়রা। পথ চেনার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য বহুকাল আগে থেকে খবর আদানপ্রদানের কাজে পায়রাকে ব্যবহার করা হয়ে এসেছে। সেই কোনকালে যুদ্ধক্ষেত্রে বা গুপ্তহত্যার কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে পায়রাকে। জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান থেকে শুরু করে ওয়াটারলুর যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটনও যোগাযোগের জন্য নির্ভর করেছেন পায়রার ওপর। ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সেন্ট ওলগা পাখি-বাহিনি দিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর হন্তারক ড্রেভলিয়ান উপজাতির গোটা গ্রাম। তাঁর সেই পাখি-বাহিনিতে শুধু পায়রা না, ছিল চড়ুইও। পাখিদের পায়ে একটুকরো সালফার আর কাপড় বেঁধে তাতে আগুন ধরিয়ে ড্রেভলিয়ানদের গ্রামের দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। একটা ঘরও রেহাই পায়নি।
ফরাসি ফটোগ্রাফার রেনে ডাগ্রন ১৮৫০ সালে মাইক্রোফিল্ম আবিষ্কার করেন। এর ফলে পায়রাদের দিয়ে একসঙ্গে অনেক তথ্য বা ছবি আদানপ্রদান করা সহজ হয়ে যায়। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে জার্মানরা প্যারিস অবরুদ্ধ করে দিলে ফরাসি সরকার ডাগ্রনের প্রস্তাবমতো পায়রা ব্যবহার করে। মাইক্রোফিল্মে করে প্যারিস থেকে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদানপ্রদান করতে থাকে পায়রার দল। পায়রা-বাহিনির মাধ্যমে সেসময় প্রায় দেড় লক্ষ মাইক্রোফিল্ম শিট পরিবহন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ফরাসি পায়রাদের রুখতে জার্মানরাও অবশ্য পাল্টা চিল আর বাজপাখির বাহিনি নামিয়েছিল।
এই যুদ্ধে পায়রা-বাহিনির দুর্দান্ত সাফল্যের পর জা দেবোরি নামে এক ফরাসি পক্ষীবিদ দাবি করেন, সোয়ালো পাখিদের ট্রেনিং দিয়ে মিলিটারি কার্যকলাপে আরও বেশি সাহায্য করা সম্ভব। সোয়ালো পাখিরা পায়রার চেয়ে অনেক দ্রুত উড়তে পারে। তিনি নিজেই নানারকম পাখিকে প্রশিক্ষণ দিতেন। তবে সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেও তাঁর কাজ তেমন সন্তোষজনক ফলাফল দিতে পারেনি।
পায়রাদের গুপ্তচরবৃত্তির আধুনিক অধ্যায় শুরু হয় জুলিয়াস নিউব্রনার নামে এক জার্মান ভদ্রলোকের তৈরি করা একটি ছোট্ট স্বয়ংক্রিয় মাইক্রোক্যামেরার হাত ধরে। ১৯০৭ সালের কথা। নিউব্রনারের নেশা ছিল ফটোগ্রাফি আর পায়রা। তিনি কৌতূহলবশত তাঁর নতুন মাইক্রোক্যামেরা তাঁর পোষা পায়রাদের শরীরে জুড়ে দিয়ে দেখতেন যে তারা কোন পথে যাচ্ছে। এই ক্যামেরা টাইমারের সাহায্যে কিছুক্ষণ পর পর ছবি তুলত। নিউব্রনারের এই আবিষ্কার থেকেই এরিয়াল ফটোগ্রাফির ধারণা আসে। পায়রার শরীরে স্ট্র্যাপ দিয়ে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা জুড়ে দেওয়ার বিষয়টা জনগোচরে আসা মাত্র জার্মান সেনাবাহিনীর মনে ধরে যায়। কিন্তু নিউব্রনারের ক্যামেরা তখন তারা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেনি। কয়েক বছর পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবশ্য জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা অনেক দেশই পায়রা-ক্যামেরা ব্যবহার করেছিল। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই পায়রাদের চর হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। শুধু ক্যামেরা না, গোপন তথ্য আদানপ্রদানের জন্যও। ব্রিটেন আর আমেরিকা থেকে মিত্রশক্তিকে প্রচুর Homing Pegion যোগান দেওয়া হয়েছিল। পায়রা অনেক নীচ দিয়ে ওড়ে। ফলে তাদের শরীরে যুক্ত ক্যামেরায় অনেক বিশদে সমস্ত ছবি পাওয়া সম্ভব হয়। ‘শে আমি’ (Cher Ami, ফরাসি ভাষায় যার অর্থ ‘প্রিয় বন্ধু’) নামের চর-পায়রার গল্প অনেকেই জানেন। ফ্রান্সের ভেরদুন শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করত সে। আকস্মিকভাবেই তাকে জড়িয়ে পড়তে হয় যুদ্ধসংক্রান্ত কাজে। ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসের কথা। আমেরিকান ৭৭ ইনফ্যানট্রি ডিভিশনের প্রায় ২০০ জন সৈনিক বড়ো বিপদের মুখে পড়েছিলেন। যুদ্ধ করতে করতে এমন একটা জায়গায় তাঁরা আটকে পড়েছিলেন, যেখান থেকে আর বেরোনোর রাস্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। যোগাযোগ মাধ্যম অকেজো হয়ে পড়ায় বাকি ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগও করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে বাকিদের থেকেও ক্রমাগত যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আমেরিকান মেজর চার্লস এস উইটলস নিজেদের বার্তাবহ পায়রাদের সাহায্য নেওয়ার বন্দোবস্ত শুরু করলেন। দুবার দুটি পায়রাকে বিপদবার্তা দিয়ে পাঠানো হল। কিন্তু গুলি খেয়ে তাদের মৃত্যু হল। খবর পৌঁছল না। এদিকে যুদ্ধের তেজ বাড়ছে। কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেন মার্কিন সেনারা। শেষ চেষ্টা হিসেবে আনা হল শে আমিকে। পায়ে বার্তা বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হল তাকে। ওড়ামাত্র শত্রুপক্ষের বুলেট ছুটে এল শে-র দিকে। যে পায়ে সংবাদ লেখা কাগজটি ছিল, সেখানেই লাগল একটি গুলি। গুলিবিদ্ধ পা-টি দেহ থেকে ঝুলছিল। সেই অবস্থায় উড়ে চলল শে আমি। এরপর আর-একটা গুলি এসে লাগল বুকে। রক্তের বন্যা বয়ে যেতে লাগল। কিন্তু এতেও শে হার মানল না। যতটুকু শক্তি বাকি ছিল, সবটুকু দিয়ে উড়ে গিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছতে পারল। রক্তাক্ত পাখির থেকে সংবাদ পেয়ে বাকি সেনাদল উদ্ধার করলেন সেই বন্দি সৈনিকদের। অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর হলেও অনেক চেষ্টায় সে যাত্রা শে আমি-কে বাঁচানো গেছিল। আমেরিকার স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের মিউজিয়ামে তার শরীর সংরক্ষণ করে রাখা আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শে আমি-র মতোই বীরত্বের নজির গড়েছিল আর-এক পায়রা জি আই জো। সে-ও মার্কিন সেনার হয়ে কাজ করেছিল। তার তৎপরতায় ইতালির ক্যালভি ভেকিয়া শহরের বাসিন্দারা রেহাই পান বিমান হানা থেকে। মাত্র ২০ মিনিটে ২০ মাইল উড়ে গিয়ে মিত্রশক্তির প্রধান দপ্তরে জরুরি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল জো। সেদিন ধ্বংসলীলার হাত থেকে কান ঘেঁষে রেহাই পেয়েছিলেন শতাধিক মানুষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স প্যারাসুটে করে কৌটোবন্দি পায়রাদের নামিয়ে দিত জার্মান-অধিকৃত ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়। কৌটোয় পায়রার সঙ্গে থাকত বিরোধীপক্ষের হাঁড়ির খবর নিয়ে নানারকম প্রশ্ন সংবলিত একটি করে কাগজ। জানা যায়, প্রায় ১০০০টি পায়রা ব্রিটেনে ফিরে এসেছিল পায়ে উত্তরপত্র বেঁধে নিয়ে। জার্মানির সেনা ঘাঁটি, রাডার স্টেশনের অবস্থান, এমনকি V-1 রকেট লঞ্চের খবরও নাকি এই পায়রাদের মারফত জানতে পেরেছিল ব্রিটিশরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ পায়রা-বাহিনী। ৩২টি পায়রাকে ডিকিনস মেডেল দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল।
মার্কিন মনোবিদ বারহাস ফ্রেডরিখ স্কিনারের ‘প্রজেক্ট পিজিয়ন’ এ সময়ের একটি দুঃসাহসিক ও বিতর্কিত প্রয়াস। পায়রা-নিয়ন্ত্রিত গ্লাইডার বোমের সেই পরিকল্পনা অবশ্য শেষমেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি। কিন্তু স্কিনারের দেখানো পথ মানবেতর প্রাণীদের গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহারের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল, যা শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল Cold War বা ঠান্ডা যুদ্ধের সৌজন্যে। ১৯৪৭ সালে তৈরি হওয়া আমেরিকার Central Intelligence Agency (C.I.A.) পাঁচ-ছয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের খবর সংগ্রহের জন্য প্রচুর ‘Pegion Mission’ আয়োজন করেছিল। দু বছর আগে, ২০১৯ সালে C.I.A. তাদের সেই সময়ের একটি ‘ক্লাসিফায়েড’ ফাইল প্রকাশ করে জানিয়েছে কীভাবে ভার্জিনিয়ায় তাদের হেডকোয়ার্টার্সের মধ্যে একটি মিউজিয়ামে পায়রাদের ট্রেনিং হত। স্কিনারের দুই ছাত্র কেলার ব্রেল্যান্ড আর মারিয়ান ব্রেল্যান্ডের নেতৃত্বে আরকান্সাস প্রদেশের হট স্প্রিং-এ গড়ে ওঠে ‘IQ Zoo’ নামে পশুপাখিদের জন্য এক প্রশিক্ষণ শিবির। নানা ধরনের পশুদের স্বভাব ও ব্যবহার নিয়ে এখানে গবেষণা হত। C.I.A-র প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই প্রাণীদের যে আসলে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তৈরি করা হত সে কথা গোপন থাকেনি।
পায়রা ছাড়াও এ সময় আর-এক প্রজাতির পাখি এ কাজে বিশেষ ব্যুৎপত্তি দেখিয়েছিল। কাক। Corvidae (করভিড) বংশের পাখিদের সহজাত ধূর্ততাকে C.I.A. কাজে লাগাতে চেয়েছিল। তাদের তত্ত্বাবধানে পেশাদার পাখি-প্রশিক্ষকরা কিছু দাঁড়কাক ও সাধারণ কাককে কোনও বাড়ির নিরাপদ অথচ যথাযথ জায়গায় ক্যামেরা বা টেপরেকর্ডার রেখে আসার ট্রেনিং দিত। এমনকি এই কাকেদের ঠোঁটে ক্যামেরা নিয়ে জানলার শার্সির বাইরে থেকে ঘরের ভিতরের ছবি তোলার ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছিল। প্রাণী-বিশেষজ্ঞদের মতে, দাঁড়কাক অনেকরকম প্যাটার্ন চিনতে পারে, এবং আরও আশ্চর্য কথা, আলাদা করে মানুষের মুখ চেনার এবং মনে রাখার ক্ষমতা রাখে। ১৯৬২ সালে মার্কিন নেভির যে প্রাণী-প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়, তার প্রধান বব বেইলি অনেক পরে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “কাকেরা কিছুটা ভার অনায়াসে বহন করতে পারে। ফাইল-ফোল্ডার জাতীয় জিনিসও ঠোঁটে করে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কাকেদের ফাইলের দেরাজ খোলার ট্রেনিং-ও দেওয়া সম্ভব।” এই বব বেইলির নেতৃত্বে C.I.A-র উদ্যোগে জলপথে গোয়েন্দাগিরির জন্য ডলফিনদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। পরে তিনি IQ Zoo সহ অন্যান্য প্রজেক্টেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে বেইলি সাফ জানিয়েছিলেন, “এমন কোনও প্রাণী নেই, যাকে ট্রেনিং দেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।”
বিড়াল, মুরগি, পিনিপিগ, রাকুন, হরিণ, ছাগল, শুয়োর সহ আরও অনেক প্রাণী ছিল তাঁদের তালিকায়। তাদের দিয়ে যা যা করানো হয়েছে, সেসব আমাদের সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত।
রোমহর্ষক সেইসব গল্প নিয়ে ফিরব পরের সপ্তাহে।