গল্প

মা

সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায় Sep 13, 2020 at 7:09 am গল্প

কোন কাজটা করে না চান্দেরি? রাত থাকতে উঠে গোয়াল সাফ করে, উঠোন লেপে নেয়, হাঁড়িতে সোডা ফুটিয়ে কাচে, রাঁধে বাড়ে, আরও কী কী করে তার হিসেবে দিলে লোকে ভাববে চান্দেরি মানুষ না, মেশিন। অবশ্য তাতেও খুশি না নির্মলা। নির্মলা চান্দেরির তিন নম্বর মা। চান্দেরির বাপের ছোট বউ। বড় বউ অনেকদিন মরেছে। মেজ বউ মুনিয়ার তিনটি মেয়ে। চান্দেরি, গীতা আর মালা। ছোট দুটোও এটা ওটা কাজ করে সারাদিন। বসে খাবার ঘরে তো জন্মায়নি। তাও এইরকম, একটা রুটি চায়ে ভিজিয়ে খেতে বসলেও নির্মলা চেঁচায়, “সারাদিন আরাম কর চুড়েইল। ওদিকে গামলায় সোডা ফুটতে ফুটতে শুকিয়ে গেল।”
এটা একদম বাজে কথা। কাপড় ফুটিয়ে গামলাটা উনুনের ঝিঁকে বসিয়ে এসেছে চান্দেরি ঠিকই, কিন্ত আঁচ নামিয়েই এসেছে। একটু পরে গামলা সরিয়ে ঢিমে আঁচে গমের খোসা আর আখ মজানি রস বসিয়ে ঠররা বানাবে ওর বাপ, অবিনাশ। আশেপাশের পাঁচটা গাঁয়ে অবিনাশের দিশি দারু, ঠররা, খুব চলে।

চান্দেরির মা মুনিয়ার কানে সতিনের চেঁচানি যায় কি না বোঝা যায় না। তার যেন গলায় আওয়াজটুকুও নেই। শুয়ে থাকে চুপ করে। যদি উঠে বসে তো রুগি মুরগির মতো ঝিমোয়। খেতে দিলে খায়, না দিলে চায় না। আগে এমন ছিল না। কিন্তু কী যে হল! তিনটে মেয়ে হওয়ার পরে মুনিয়া আর বাচ্চা নিতে পারছিল না। কিন্তু অবিনাশ ছাড়বে কেন? ছেলে চাই তার। এদিকে মুনিয়ার পেটে বাচ্চা আসে, খসে যায়। সেসব রক্ত ময়লাও চান্দেরিই সাফ করেছে বার বার। 

নির্মলা মাঝেমাঝে ভাবে এইটুকু মেয়ে, কত যে দেখেছে তার ঠিক নেই। 

ওই বারবার বাচ্চা খসতে খসতেই মুনিয়া একদম ঝিমিয়ে গেল। ওদিকে অবিনাশের তখন মাথায় হাত। ঘরের মেয়েমানুষ না রাঁধে, না বিয়োয়। এভাবে চলে? এর মধ্যে পরতাপ খবরটা এনেছিল। ওরই শালি নির্মলা। পরতাপ বলেছিল বয়স বিশ বাইশ হবে। বাপ হাভাতে। বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। ছেলে চুরির দায়ে জেলে। নির্মলা দেখতে শুনতে ভালো। তবে দহেজ দেওয়ার ক্ষমতা নেই বাপের। 

হেসেছিল অবিনাশ। টাকা নিয়ে বিয়ে করেছে দুবার, একবার নাহয় ছাড় দিল। আসলে শরীরটা আনচান তো করে। দেখে এলেই হয়। তা দেখতে যে গেল তো এক্কেবারে জখম হয়ে ফিরল। ফিলিমইস্টারও হার মেনে যাবে এমন জান লেওয়া গড়ন নির্মলার। মুখ চোখও মন্দ না। অবিনাশ নির্মলার বাপকে বলেছিল ঘরে আমার আর এক বউ আর মেয়েরা আছে। তবে ভেবো না। মেয়ে তোমার রানি হয়ে থাকবে। 

নির্মলা মাথা নিচু করে শুনেছিল। নিরুপায়, কায়েতের মেয়ে সে। দলিতদের ছেলে পিতমকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সেসব ভালোবাসা মিছে হয়ে গেছে। শয়তান ভাইটা যেদিন জেনেছিল সেদিন চোরের মার খাইয়েছিল পিতমকে। পিতমটা যেমন গরিব তেমন ভিতু। নির্মলার পায়ে দস্তার পাঁয়জোর পরিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, “এই তোর পায়ে রইলাম আমি। বাপ দাদার কিরা, তোকে ছাড়া কাউকে মনে নেব না। কিন্তু বিয়ে করতে পারব না নিমি। আমার মা-টা না খেতে পেয়ে মরবে। ঘর দোর জ্বালিয়ে মেরে দেবে ওরা আমাকে।”

আগুন জ্বলেছিল চোখে নির্মলার, একসময় নিভেও গেছিল। বরং বিয়ের খরচের নামে বাপ যখন তিনহাজার টাকা নিয়েছিল হাত পেতে নিয়েছিল অবিনাশের থেকে, একটু মায়াই হয়েছিল যেন। মানুষটা কটা দিন খেতে পাবে ওই টাকায়।


নজরে থাকুক

মাংস 


তবে এ কথা সত্যি যে রানির মতোই থাকে নির্মলা। বাড়ির বেশিরভাগ কাজ চান্দেরিই সেরে নেয়। এই যেমন এখন, গরম চা-টা গলায় ঢেলে পিছদুয়োরে গেল চান্দেরি। রাজু এসে গেছে। হাঁড়ির তলায় কাদামাটি লাগিয়ে উল্টে রাখছে। চান্দেরি কাছে গিয়ে উনুনে আবার কাঠ গুঁজে দেয়। রাজু হাঁড়িগুলো গরম করতে থাকে। একটু পরে অবিনাশ হাত লাগাবে, গরম হাঁড়িতে ঠররা মজাবে মশলা মিশিয়ে। তারপর জলের নিচে লুকিয়ে রাখবে মুখ বন্ধ হাঁড়ি।

চান্দেরি নিচু গলায় বলে, “ভয় করে না তোর?”

“ঘেন্না করে”, রাজু বলে। তারপর বলে, একদিন মরবে সবকটা বিষ গিলে, বুঝবে তোর বাপ।

মরুক, সব মরুক, দাঁতে দাঁত ঘষে চান্দেরি। তারপর হঠাৎ ভূতনির মতো হেসে বলে, “মরলে তোকে দারোগা ধরবে। আমাকেও। ভালো হবে। দুজনে জেলে খাটব, একসাথে খাব শোব…”

“জেলের মধ্যে মেয়ে মদ্দ একসাথে থাকতে দেয় না।” নির্মলা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল কে জানে। কথাটা ছুড়ে চলে গেল যখন তখন কটা শুকনো পাতা পায়ের চাপে জোর আওয়াজে মাড়িয়ে দিয়ে গেল। 


সন্ধেবেলায় অবিনাশ চিন্তিত মুখে বসে ছিল ঘরে। 

“কী বলেছে দারোগা? ও নিজে খায় না নাকি দারু?” নির্মলা বলছিল। 

“খায় কি না কী করে জানব?” খিঁচিয়ে উঠল অবিনাশ। তারপর বলল, “আদিনাথ খবর দিয়েছে। কাল সকালে রেড হবে যদি না…”

“যদি না?” নির্মলা সজাগ হয়।

“যদি না আজ রাতের মধ্যে আর কোনো ভাবে খুশ করা যায়।”

“খুশ কীভাবে? টাকা?”

“টাকা না। মেয়েমানুষ…”

এতটা বোধহয় নির্মলাও ভাবেনি। আকাশ থেকে পড়ল, “মেয়েমানুষ? কী বলছ?”

অবিনাশ মাথাটা টিপে ধরে বসেছিল। হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, “চান্দেরিকে পাঠাব। ছেলে থাকলে আমার রোজগার বাড়াত না? মেয়ে হয়ে বাপের কোন কাজে লাগে?” 

ঘাড় শক্ত হয়ে ওঠে নির্মলার, “মেয়েটা তারপর কোথায় যাবে ভেবেছ? মরে যাবে তো!”

“যাবে যাবে! আমি কী জানি! আমার ভাটি বাঁচাতে হবে।” 

নির্মলা নিজের পেটে হাত দেয়। এ মাসের দিন পেরিয়ে গেছে দু হপ্তা হল। অবিনাশকে আজই বলবে ভেবেছিল। হঠাৎ যেন শীত করে ওঠে। বাচ্চাটা যদি মেয়ে হয়? পনেরো বছর পর সেই মেয়েকেও কি অবিনাশ ভাটি বাঁচাতে এভাবেই… ভাবতে পারে না নির্মলা।

অবিনাশ কঠিন গলায় বলে, “ওকে একটা ভালো শাড়ি পরিয়ে দে। সাজিয়ে দে একটু। নিয়ে যেতে হবে রাত বাড়লে।”

নির্মলার কেন জানি মনে পড়ে পিতমের কথা। সেই পাঁয়জোরখানা তুলে রেখেছে। জীবনে যে কটা মরদ দেখল সবাই জান বাঁচানো বোঝে, খিদে বোঝে, শরীর বোঝে, ভালোবাসা বোঝে না?  

বারান্দায় মুনিয়া মুড়ি দিয়ে শুয়ে। গা জ্বলে যায়। মা হয়ে মেয়েগুলোর খোয়ার দ‍্যাখে কী করে কে জানে। চান্দেরি কমলা ওড়না গায়ে রান্নাঘরে রুটি বানাচ্ছে। রাজু দলিত নয়। কিন্তু দারোগার এঁটো মেয়েকে বিয়ে করবে কি সে? মেয়েটা নিজেই কি মুখ পুড়িয়ে ফিরতে পারবে নাকি? 

 দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে নির্মলা। চান্দেরিকে ডাকে, তারপর বাড়ির পিছনদিকে যায়। ছোট অল্প জলের ডোবা। সেটা এত গাছ দিয়ে ঘেরা যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না ওই ডোবার নিচে মুখবন্ধ সারি সারি মাটির হাঁড়িতে দিশি দারু পচছে। হাঁটুজলে নেমে হাঁড়ি তুলে তুলে গাছের গোড়ায় বসায় নির্মলা। চান্দেরির গা থেকে ওড়নাটা টেনে নিয়ে বলে, আরও ওড়না কাপড় নিয়ে আয় দৌড়ে। আর শোন, মুখ বন্ধ রাখবি একদম।   

মিনিট পনেরোর মধ্যে ঘুমন্ত গাঁ জেগে উঠে দ‍্যাখে অবিনাশের আটচালার পিছন থেকে লকলকে আগুন উঠে ঘিরে ফেলছে পিছনের জঙ্গল। একের পর হাঁড়ি ফাটছে, গাছ পুড়ছে, যেন হোলিকাদহন। গোয়ালের গাইদুটো ছটফট করে বাঁধন ছিঁড়তে চাইছে আর অবিনাশ পাগলের মতো দৌড়োচ্ছে বালতি ভরা জল নিয়ে আগুন নেভাতে। 

ধীরে ধীরে একসময় আগুন নিভেও আসে। উদ্ভ্রান্ত অবিনাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দ‍্যাখে ধিকিধিকি পুড়তে থাকা তরল সম্পদের ধোঁয়া। কী করে এমন আগুন লাগল তা কিছুতেই ওর মাথায় ঢোকে না। 

 ভোরের দিকে ভিড় হালকা হয়। ক্লান্ত প্রতিবেশীরা আগুনের আলোচনা করতে করতে বাড়ি ফেরে। অবিনাশ বুকে হাত রেখে শুয়ে শুয়ে লোকসান হিসেব করতে থাকে। শুধু রাতজাগা চোখে নির্মলা চান্দেরিকে বলে, আজ ছাতু আর আচার খাব সবাই। যা,  গোয়াল সাফ করে একটু ঘুমিয়ে নে ঘরে। আর শোন, রাজুকে বলবি ভদ্দর কোনো কাজ দেখতে। তোর বিয়েতে আমার পাঁয়জোরটা পরতে দেব তোকে।


অলঙ্করণঃ তিস্তা দাশগুপ্ত

#bengali #story #maa #sangita dasgupta roy #বাংলা #গল্প #মা #সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

  • ananya dutta
    Oct 1, 2020 at 12:06 pm

    তোমার সব ছোটো গল্প খুব আলাদা হই। ভালো লাগল।

  • Soumya
    Sep 19, 2020 at 2:57 pm

    আপনার দু-একটি লেখা আগে পড়েছি, এই লেখাটিও খুবই সুন্দর লাগল। ভাল ছোটোগল্প লেখা একটা শিল্প, আর আপনি একজন প্রকৃত শিল্পী।

  • Keka
    Sep 18, 2020 at 0:59 am

    Ma

  • ppsonali
    Sep 14, 2020 at 3:19 pm

    As good as a O Henry story

  • Sikta Das
    Sep 14, 2020 at 1:45 am

    দারুণ টার্ণিং। খুব ভাল লেগেছে।

  • Sumita
    Sep 14, 2020 at 0:41 am

    অসহায় মেয়েদের জিতে যাওয়ার গল্প সবসময় ভালো লাগে। সুন্দর গল্প ❤️

  • Aditi SenChattopadhyay
    Sep 13, 2020 at 9:04 pm

    অনায়াস, সাবলীল, জীবন থেকে উঠে আসা এই আখ্যান। লেখিকার কলমে অপার শ্রদ্ধা রইল।

  • পিয়ালী
    Sep 13, 2020 at 7:42 pm

    মন ভালো করা

  • Sutapa Sengupta
    Sep 13, 2020 at 7:19 pm

    সই , অসাধারণ লাগলো۔ পড়তে পড়তে ভাবছিলাম কি হয় কি হয়۔ কিন্তু তারপর শেষ টা পড়ে আলোর সন্ধান পেলাম۔۔ মেয়েরা মেয়েদের বন্ধু ই হয়۔ ۔ভীষণ ভালো লাগলো۔

  • মনটা ভালো করে দিলে ❤❤❤
    Sep 13, 2020 at 5:10 pm

    মনটা ভালো হয়ে গেল ❤

  • ANURADHA KUNDA
    Sep 13, 2020 at 4:18 pm

    খুব ভালো লাগল

  • Madhuchhanda paul
    Sep 13, 2020 at 4:07 pm

    খুব খুব ভালো লাগলো

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

45

Unique Visitors

225541