মাস্টারদা
১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার কর্ণফুলী নদীর তীরে নোয়াপাড়া গ্রামে জন্ম নেন রাজমনি সেন ও শশীবালা দেবীর সন্তান সূর্যকুমার সেন, পরবর্তীতে ইতিহাস যাঁকে চিনবে 'মাস্টারদা' বলে। বিপ্লবী সূর্য সেন-এর মাইন দিয়ে জেল ওড়ানোর পরিকল্পনা, পটিয়ারে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ বা চট্টগ্রাম বিপ্লবের মতো বহুচর্চিত ঘটনাগুলো কমবেশি সকলেই জানেন। আজ আমরা এসব পরিচিত বহুচর্চিত ঘটনার বাইরে সূর্য সেনের ছোটোবেলা, ব্যক্তিজীবন, দেশসেবায় এগিয়ে আসার নেপথ্য কাহিনীর মতো আড়ালে থেকে যাওয়া ঘটনাগুলো শুনব।
বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সূর্য শৈশবে বাবা, মা দুজনকেই হারান। কাকা গৌরমণি সেন তাঁকে লালন-পালন করেন। সূর্যর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। এরপর তিনি পরপর বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। পাঠশালার পর ভর্তি হন দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তারপর নন্দনকাননে অবস্থিত হরিদশ দত্তের ন্যাশানাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি এফ.এ. পরীক্ষা পাশ করেন এবং এই কলেজেই বি.এ. পড়ার জন্য ভর্তি হন। বি.এ. ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষকদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে সূর্য বাধ্য হন কলেজ ছাড়তে এবং তারপর মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে বি.এ. পাশ করেন।
মুর্শিদাবাদে কলেজে পড়াকালীন প্রথম সূর্যের গায়ে সমসাময়িক রাজনীতির আঁচ লাগে। এই কলেজে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন তিনি। সতীশচন্দ্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবে তাঁর মনে তীব্র স্বদেশপ্রেম জন্ম নেয়। বলা ভালো, সতীশচন্দ্রের চোখ দিয়েই সূর্য সমকালীন দেশ-কালের প্রকৃত পরিস্থিতি চিনতে শুরু করেন; এই দৃষ্টিই একটি সাধারণ ছাত্রকে কালক্রমে পরিণত করবে বিপ্লবী নেতাতে।
বি.এ. পাশ করার পর চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন, কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার এলাকায় উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সুন্দর স্বভাব আর সকলের সাথে ভালো ব্যবহারের জন্য অচিরেই তিনি স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সবার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং ওই পরিমণ্ডলে পরিচিত হন 'মাস্টারদা' নামে। ক্রমে সূর্যর এই 'মাস্টারদা' নামই ছড়িয়ে পড়ে স্কুলের বাইরে, চট্টগ্রাম শহরে। এই সময়েই তিনি সরাসরি বিপ্লবী দলে যোগ দেন। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ ছিল বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি, এখানে পড়ার সময়ে বিপ্লবীদের সঙ্গে সূর্যর যোগাযোগ ছিল পরোক্ষে। বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার পরে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা দত্ত, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখের সঙ্গে বিপ্লবী দল সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
পড়াশোনা শেষ করে সূর্য চট্টগ্রামে ফেরার পর থেকেই বাড়ির লোকেরা চেষ্টা করছিলেন তাঁর বিয়ে দেওয়ার। সূর্য নিজে যদিও বিয়ে সংক্রান্ত কোনও চিন্তাভাবনাই করতেন না, দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকেই তিনি জীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে নিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল বিবাহিত জীবন তাঁকে আদর্শচ্যুত ও কর্তব্যভ্রষ্ট করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আত্মীয়দের অনুরোধে একপ্রকার বাধ্য হন তিনি বিয়ে করতে। ১৯১৯ সালে বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ার পুষ্পরানি দত্তকে বিয়ে করেন। কিন্তু নিজের বিশ্বাসে অবিচল থেকে দাম্পত্যজীবন তিনি পালন করেননি। বিয়ের দু'দিন পরেই তিনি স্ত্রী-কে নিজের আদর্শ, সংকল্পের কথা বলে গার্হস্থ্যজীবন যাপনে তাঁর অপারগতার কথা জানান এবং সেদিনই গৃহত্যাগ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি যখন বোম্বাইয়ের রত্নগিরি জেলে বন্দী, তখন তাঁর স্ত্রী কঠিন টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। সেই সময়ে অনেক চেষ্টা করে, দরখাস্ত দিয়ে দেওয়ানবাজারের বাড়িতে সূর্যকে আনানো হয়; তিনি যখন এসে পৌঁছন, তার আগেই পুষ্প দত্ত প্রাণবায়ু ত্যাগ করেছেন। পুষ্প দত্তের কিছু চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, স্বামীর আদর্শ এবং কার্যকলাপের প্রতি তিনক যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সূর্যের গৃহত্যাগের পর কয়েকবার পুষ্পর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল, কিন্তু তিনি নিজে কখনও পুষ্পর খোঁজ নেননি। তবে চট্টগ্রামের বাইরে থাকাকালীন দীর্ঘ চার বছরের অদর্শন হয়তো সূর্যর মনে পুষ্পর প্রতি কিছুটা দুর্বলতা তৈরি করেছিলো। পুষ্পর সঙ্গে তিনি চিঠি এবং বইপত্র বিনিময় করতেন। একটি চিঠিতে পুষ্প সূর্যকে লিখছেন, "তোমার দেওয়া দেবী চৌধুরাণী বইটা কাল রাতে শেষ করেছি।" আরেকটি চিঠিতে সূর্যকে প্রশ্নও করেছেন, “স্ত্রী কি ছাত্রী হতে পারে না? স্বামীর আদর্শের অংশীদার হতে বাধা কীসে?” সূর্যর বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা বহুবার জানিয়েছেন পুষ্প, আর প্রতিবারই তা নাকচ করেছেন সূর্য।
উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড কীভাবে চলছে তা চাক্ষুষ করার জন্য তিনি গুয়াহাটির দিকে রওনা দেন। অসমে কয়েকমাস কাটিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝে তারপর লখনউ এসে পৌঁছন। উত্তর ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন তখন খানিক স্তিমিত। সেখান থেকে চলে আসেন কলকাতা, ওঠেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বিপ্লবীদের গোপন ডেরায়। সেখান থেকেই সূর্য গ্রেফতার হন এবং তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোম্বাইয়ের রত্নগিরি জেলে। জেলজীবনে তাঁর সঙ্গী ছিল শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' আর প্রতি মাসের 'ভারতী' পত্রিকা।
এই দফায় জেলমুক্তির পর সূর্য আসেন কলকাতায়। পার্ক সার্কাস ময়দানে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দেন সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে। এরপর চট্টগ্রামে ফিরে যান সূর্য। এরপর ঘটবে সেই ঘটনাগুলো যা ইতিহাস আমাদের শুনিয়েছে বারবার। ১৯৩১ সালে মাইন দিয়ে জেলে বিস্ফোরণ ঘটানো, পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে সসৈন্য ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে পরাজিত ও নিহত করা ইত্যাদি কার্যকলাপের অভিযোগে সূর্য সেনকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপরই ১৯৩২ সালের চট্টগ্রাম বিপ্লব, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ এবং প্রীতিলতার আত্মাহুতি৷ এই ঘটনার পর সূর্য পালিয়ে আশ্রয় নেন গৈরালা গ্রামে ব্রজেন সেন-এর বাড়িতে। ১৯৩৩ সালে ব্রজেন সেন-এর ভাই নেত্র সেন-এর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন সূর্য। শাস্তিতে তাঁর কারাদণ্ড এবং ফাঁসি হয়।
কারাবাসের সময়, এমনকী ফাঁসির দিন সকালেও সূর্য ভেবেছেন শুধু দেশের কথা, দেশকে স্বাধীন করার কথা। তখনও সঙ্গীদের উদ্বুদ্ধ করে গেছেন সংগঠিত থাকার জন্য, লক্ষ্যচ্যুত না হওয়ার জন্য। ফাঁসির দিন সকালে সূর্য সঙ্গীদের একটি চিঠি লেখেন, যার মর্মার্থ - "আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে। এই তো আমার সাধনার সময়।...এগিয়ে চল- কখনও পিছিয়ে যেও না। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ।... আমাদের সংগঠনে যেন বিভেদ না আসে।"
#Surya Sen #Masterda #Freedom Fighter #Indian Struggle for Freedom #Movement #মাস্টারদা #সূর্য সেন #চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন #ফাঁসি #মৃত্যুদিন #শ্রদ্ধা #মন্দিরা চৌধুরী #সিলি পয়েন্ট