অনুবাদ

মাছ ধরতে যাওয়া যাক?

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী July 26, 2020 at 3:54 am অনুবাদ

[রাস্কিন বন্ডের ‘Gone Fishing’ গল্পের অনুবাদ]



বাড়িটার নাম ‘পাহাড়তলি’, কারণ তেমন একটা জায়গাতেই বাড়িটার ঠিকানা – একটা পাহাড়ের তলায়। বাড়ি ছেড়ে যে মানুষটি চলে গেছে – বাড়ির মালিক – রবার্ট আসেল। আর বাড়ি আগলে রয়ে গেছে যে – পরিবারের বুড়ো চাকর – প্রেম বাহাদুর।

রবার্ট গেছে, তা প্রায় অনেক বছর হল। বিয়ে-থা করেনি জীবনে; তিরিশের শেষ কোঠায় গিয়ে হঠাৎ শখ জাগল দূর-দূরান্তে ভ্রমণের, অ্যাডভেঞ্চারের; আর সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির চাবি প্রেম বাহাদুরের (সে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই পরিবারের কাজকর্ম সামলাচ্ছে) হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়া।

কেউ তাকে দেখেছে শ্রীলঙ্কায়। কেউ আবার শুনেছে, সে নাকি বার্মায়; মোগকের চুনির খনির আশেপাশে দেখা গেছে তাকে। তারপর সেখান থেকে জাভায় গেছিল নাকি, সুণ্ডা খাঁড়ির পথ ধরে। ব্যাস, আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বছরের পর বছর ঘুরে গেল। পাহাড়তলি পড়ে রইল একা।

অবশ্য প্রেম বাহাদুর সে বাড়িতে থাকে, একটা ছোটো আউটহাউজে।

প্রতিদিন সে ‘পাহাড়তলি’র দরজা খোলে, আসবাবের ধুলো ঝাড়ে সব ঘরে গিয়ে গিয়ে, বিছানার আর বালিশের চাদর সাফসুতরো রাখে, আর তার সাহেবের ড্রেসিং গাউন আর চপ্পলজোড়া বার করে রাখে।

আগে, যখনই রবার্ট বাড়ি ফিরত অনেক ঘোরাঘুরি বা পাহাড় চষে বেড়ানোর পর, এসেই স্নান সেরে ওই গাউন আর চটি পরে আরাম করে বসা নিয়ম ছিল তার, সে যত অবেলাই হোক না কেন। প্রেম বাহাদুর তাই এখনও সে-সব তৈরি রাখে। সে জানে, রবার্ট ফিরবে একদিন।

রবার্ট নিজেই বলেছে এ-কথা।

“সব গুছিয়ে গাছিয়ে তৈরি রেখো, বুড়ো! এক বছর বাদে ফিরি, কি দু-বছর, কি আরও বেশি, কিন্তু ফিরব তো বটেই! আর হ্যাঁ, প্রতি মাসের পয়লা তারিখে আমার উকিল – ওই কাপুর সাহেবের কাছে যাবে, বুঝেছ? তোমার মাইনে, আর এই বাড়িঘর সারাই-বাবদ যা খরচা লাগে, ও তোমায় দিয়ে দেবে। বাড়ি যেন একদম সাজানো গোছানো থাকে, দেখো কিন্তু।”

“আপনি কি এবার তাহলে বউমা নিয়ে ফিরবেন, সাহেব?”

“হা ঈশ্বর! না রে বাবা! এসব কে মাথায় ঢোকায় তোমার!”

“না, আমি ভাবলাম, হয়তো – এত সাজানো গোছানো রাখতে বলছেন...”

“আমার জন্য গুছিয়ে রাখতে বলছি, বুঝলে? ফিরে এলে যেন মাথার উপর বাড়িটা না ভেঙে পড়ে!”

তাই, প্রেম বাহাদুর বেশ খেয়াল রেখেছে এ বাড়ির – যদিও রবার্টের তরফ থেকে কোনও খবরই আসেনি আর। কী যে হল ওঁর! খবর না আসা ব্যাপারটা বেশ রহস্যের মতো ঘনিয়ে রাস্তায়, বাজারে লোকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। দোকানদারেরাও রবার্টের বিরহে কাতর; বড় হাত-খোলা, দিলদরাজ খদ্দের ছিল সে।

আত্মীয়স্বজনেরা অবশ্য মনে করে, সে বেঁচে আছে ঠিকই। ক-মাস আগেই রবার্টের এক ভাই এসেছিল – এমনিতে কানাডায় তার ব্যবসা, এ-দেশে বেশিদিন থাকতে পারে না। সে এসে উকিলের হাতে আরও বেশ কিছু টাকা দিয়ে প্রেমকে বলেছিল, আগের মতোই বাড়ি দেখভালের কাজ চালিয়ে যেতে। প্রেম বাহাদুরের চাহিদা অল্পই, কুলিয়ে যায় ওই মাইনেতে। আর তা ছাড়া, সে জানে, রবার্ট ঠিকই ফিরবে।

অন্য কেউ হলে এতদিনে বাড়ি, বাগান – সবই গোল্লায় যেত। কিন্তু প্রেম বাহাদুর থাকতে সে ভয় নেই। মালিকের প্রতি তার শ্রদ্ধা অসীম। যদিও সে বয়সে অনেকটাই বড় রবার্টের চেয়ে – এখন প্রায় ষাট ছুঁইছুঁই, আর খুব যে সুস্থ-সবল, তা-ও নয়। প্লুরিসি, আর বুকের আরও হাজারটা সমস্যায় কাবু। কিন্তু রবার্টকে সে ছোটবেলায় দেখেছে, ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। একসঙ্গে তারা কতবার শিকারে গেছে পাহাড়ে, মাছ ধরতে গেছে। খোলা আকাশের তারার নিচে তারা ঘুমিয়েছে পাশাপাশি, একই থালা থেকে খাবার ভাগ করে খেয়েছে। একবার তো একটা ছোটো নদী পেরোতে গিয়ে হড়পা বানে বেশ কিছুটা নিচে ভেসে গেছিল দুজনেই; বর্ষাকালে যেমন হয় আর কি, হঠাৎ করে নদীখাতে জলের ভারী স্রোত নেমে আসে কোনও ভূমিকা ছাড়াই। অনেক কষ্টে সেবার বেঁচেছিল ওরা। হিল স্টেশনে ফিরে এসে রবার্ট সবাইকে বলেছিল, প্রেম বাহাদুরই বাঁচিয়েছে তাকে; অন্যদিকে প্রেমও একইভাবে বলেছিল, এ যাত্রা বেঁচে যাওয়ার জন্য সে রবার্টের কাছেই ঋণী।

এ বছর বর্ষা শুরু হয়েছিল আগেভাগে, আর চললও বেশ অনেকদিন। সেপ্টেম্বরের প্রায় পুরোটা জুড়েই বৃষ্টি; পাল্লা দিয়ে বাড়ল প্রেম বাহাদুরের কাশি আর শ্বাসকষ্ট।

বাড়ির বারান্দায় নিজের চারপায়ায় শুয়ে শুয়ে প্রেম বাগানটাকে দেখে, আস্তে আস্তে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। ডালিয়া, লিলি, কনভালভাস, সব জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে। অবশেষে সূর্য উঠেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমের বাতাসের ভার দিক পাল্টে এখন উত্তর-পশ্চিম থেকে এসে তাড়িয়ে দিচ্ছে মেঘগুলোকে।

বাগানে চারপায়াটা নিয়ে গিয়েছিল প্রেম। শুয়ে একটু রোদ পোহাচ্ছিল, ছোট হুঁকোতে টান দিচ্ছিল অল্প, এমন সময় সে দেখল, গেটে এসে দাঁড়িয়েছে রবার্ট।

উঠে বসতে চেষ্টা করল প্রেম, কিন্তু পায়ে জোর নেই মোটে। হুঁকোটাও পড়ে গেল হাত থেকে।

রবার্ট বাগানের পথটা ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল, এসে দাঁড়াল তার বুড়ো চাকরের সামনে, হাসি হাসি মুখে। একদম একইরকম আছে সে এতদিন বাদেও, প্রেম বাহাদুর শেষবার তাকে যেমন দেখেছিল, তেমনই। বয়সের ছাপ পড়েনি।

“এলেন শেষ পর্যন্ত!”, প্রেম বলে।

“বলেছিলাম তো, ফিরব।”

“কত বছর… ! আপনি বদলাননি কিন্তু একটুও।”

“সে তো তুমিও বদলাওনি, বুড়ো।”

“কী যে বলেন! বুড়ো হয়ে গেছি, রোগে ধরেছে, গায়ে জোর নেই।”

“এবার একদম ঠিক হয়ে যাবে। তাই তো এসেছি আমি।”

“যাই, ঘরটা খুলি”, বলে প্রেম উঠে বসে। এবার অবশ্য একবারেই, বেশ সহজেই উঠতে পারল সে চারপায়া থেকে।

“তেমন একটা দরকার নেই”, রবার্ট বলে।

“না না, সব তৈরিই আছে আপনার জন্য!”

“জানি। আমি শুনেছি, তুমি কেমন যত্ন করে দেখাশোনা করেছ সবকিছুর। চলো তাহলে, শেষ একবার ঘুরে, দেখে নিই। থাকা তো আর যাবে না, বুঝতেই পারছ।”

প্রেমের ভারি অদ্ভুত লাগল এমন কথা, তবু সে সদর দরজা খুলে রবার্টকে নিয়ে গেল ভেতরে, বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে শোয়ার ঘরে। তার জন্য সযত্নে রাখা আছে তার গাউন আর চপ্পলজোড়া। সে দেখে রবার্ট স্নেহে, আদরে তার বুড়োর কাঁধে হাত রাখল।

নিচে নেমে আবার যখন ওরা বাগানে সূর্যের আলোয় এল, প্রেম সাংঘাতিক অবাক হয়ে দেখে – নিজেকে, বা বলা ভালো নিজের হাড়-জিরজিরে শরীরটাকে – চারপায়ায় পড়ে থাকতে। হুঁকোটা মাটিতেই পড়ে আছে, সেই যে পড়েছিল।

হতবাক হয়ে প্রেম তাকায় রবার্টের দিকে।

“কে – ওখানে শুয়ে আছে?”

“তুমিই – ছিলে। এখন শুধুই খোলস বলতে পারো। সত্যিকারের তুমি তো এই যে, আমার পাশে দাঁড়িয়ে।”

“আপনি আমার জন্য এলেন?”

“তুমি তৈরি না হওয়া অবধি আসতে পারছিলাম না যে। আমি আমার খোলস ছেড়ে পালিয়েছি অনেকদিন আগেই। কিন্তু তুমি তো নাছোড়বান্দা, বাড়ি আগলে রেখেছিলে। এবার যাবে তো, নাকি?”

“কিন্তু, এই বাড়িটা ...”

“আর কেউ থাকবে এখানে। কিছুই হারায় না, সবই শুরু হয় আবার, নতুন করে ... চলো, এবার বরং মাছ ধরতে যাওয়া যাক।”

রবার্ট তার বুড়ো প্রেম বাহাদুরের হাত ধরে। দেবদারুর নিচে এসে পড়া ঝিরিঝিরি রোদের মধ্যে দিয়ে ওরা শেষবারের মতো এই জায়গা ছেড়ে হাঁটা দেয়, আরেক দিকে।

#অনুবাদ #রাস্কিন বন্ড #শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

  • Suvankar
    July 27, 2020 at 3:04 pm

    সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। মতামত পেয়ে খুব ভালো লাগলো।আনন্দের ভাগ আনন্দ বাড়ায় আরও! 😊 বিশেষ ধন্যবাদ সিলি পয়েন্টকে, লেখাটি প্রকাশের জন্য।

  • Saumick Basu
    July 27, 2020 at 6:08 am

    Professor, you've started something larger than yourself and it has to go on. You must oblige.

  • Arnab Chatteejee
    July 27, 2020 at 3:40 am

    Khub valo laglo Subhankar Da

  • Dipankar Banerjee
    July 26, 2020 at 4:26 pm

    Aamar chele ke regularly Ruskin Bond porte dekhe dekhe aami o suru korechi...kebol e o r aami akta kotha aalochona kori je jara engraji Jane na tara ki Ruskin Bond porte parbe na !! Deprive hobe!! Aapnar kaaj ta dekhe bhison e bhalo laglo!! Plz Ei kaaj ta continue kore jaan!! Bhalo onubaad hoyeche!! Aaini ja ja procedure aache segulo meet kore Jodi boi korte paren tahole khub e bhalo hoy!! Seshe aabar o obhinondon bhalo akta kajer jonne!! Sorry bhalo akta kaaj suru korar jonne!! Continue korte e hobe!!!

  • Soumya
    July 26, 2020 at 2:50 pm

    গল্পটা পড়া আছে বলে আরও ভালভাবে বুঝতে পারছি আপনার অনুবাদটা কতটা সার্থক! খুব ভাল।

  • Ipsita
    July 26, 2020 at 9:33 am

    ভীষণ সুন্দর

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

27

Unique Visitors

225523